বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বান্দরবান হচ্ছে বাংলাদেশ পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। এটি চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত এবং চট্টগ্রাম বিভাগের তালিকাভুক্ত দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে 15% দখল করে রয়েছে। বান্দরবানের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে সবুজে ঘেরা পাহাড় এবং প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। পাহাড় নদী ঝর্ণা সবুজে ঘেরা দিগন্ত কি নেই এখানে। এই এলাকাতে দেখার মত স্থান গুলোর তালিকা এবং তাদের বর্ণনা নিচে তুলে ধরা হলো।

বুদ্ধ ধাতু জাদি বা বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দির

বুদ্ধ ধাতু জাদি এর প্রকৃত নাম কিন্তু সাধারণ মানুষজন একে বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দির নামে চেনে। এটি বান্দরবানের বালাঘাট 1 এর পুল পাড়ায় অবস্থিত। অনেক মানুষই মন্দির কে মহাসুখ মন্দির বলে ডাকে এই মন্দিরের নাম স্বর্ণমন্দির হলেও এতে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতি নেই কিন্তু এই মন্দিরে এক বিশাল বুদ্ধমূর্তি আছে সোনালী রংয়ের এজন্য মানুষজনকে স্বর্ণমন্দির বলে ডাকে।

এটি বান্দরবানের জেলা সদর থেকে 10 মিনিটের পথ। এই মন্দিরটি উঁচু পাহাড়ের উপরে অবস্থিত এবং এটি তৈরি করতে মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে পাথরের নুড়ি বা নুড়িপাথর। এটি একটি সুন্দর গোছানো প্যাগোডা বা বৌদ্ধদের উপাসনালয়। এটিকে বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে ধরা হয়।

শুধু বাংলাদেশ নয় বিদেশের ও বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষজন এই মন্দির দেখতে আসেন এবং এই মন্দিরে প্রার্থনা জানাতে আসেন। এই মন্দির নির্মাণের খরচ হয়েছে ১০ কোটি টাকার ঊর্ধে। যে পাহাড়ের উপর এই মন্দিরটি অবস্থিত সেই পাহাড়ের দেবোটা পুকুর নামে একটি ছোট পুকুর রয়েছে। সামগ্রিকভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সবচাইতে সেরা প্যাগোডাগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এটি বান্দরবান জেলার সবচাইতে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি নির্ধারিত গন্তব্য স্থল।

এর নির্মান শৈলী চীন থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের বৌদ্ধ মন্দির বা প্যাগোডা গুলোর মত। এই বৌদ্ধমন্দির থেকে বালাঘাট এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার সুন্দর পরিবেশ অবলোকন করা যায়। তাছাড়া এখান থেকে বান্দরবানচন্দ্রঘোনার আঁকাবাঁকা রাস্তা, রেডিও স্টেশন এবং সবুজ দিগন্ত দেখার মত। বাংলাদেশের আধুনিক ধর্মীয় স্থাপত্যের মধ্যে এটি অন্যতম। প্রতিবছর এই প্যাগোডাতে মেলা বসে।

পূজা অর্চনার জন্য সারাদিন এই প্যাগোডা খোলা থাকে। তবে আপনি যদি দর্শক হিসেবে বেড়াতে যেতে চান, তবে আপনাকে সকাল সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে যেতে হবে। আপনি যদি সকালে যেতে না চান বা সময় করে উঠতে না পারেন, তাহলে দুপুর পৌনে একটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দর্শন সময়কালের মধ্যে আপনাকে যেতে হবে। এই মন্দিরে প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ফি, মাত্র 10 টাকা।

আমিয়াখুম জলপ্রপাত

আমিয়াখুম জলপ্রপাত বাংলাদেশের ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত। এটি বাংলাদেশমায়ানমার সীমান্তের নিকটবর্তী। এটি বান্দরবান জেলার থানচি থানার অন্তর্ভুক্ত। এই জলপ্রপাতটি নক্ষিয়াং নামক স্থানে অবস্থিত। অমিয়াখুম শব্দটি এসেছে মারমা ভাষা থেকে. খুম মনে হল জলপ্রপাত যার পানি কখনো শুকায় না অর্থাৎ অন্যসব হ্রদ বা জলপ্রপাতের পানি শুকিয়ে গেলেও খুমের পানি শুকাবে না। পাহাড়ি নদী এই জলপ্রপাতের সৃষ্টি। এখানকার জলরাশি এবং তার পাশে ধাপে ধাপে নেমে আসা সবুজ পাহাড় চূড়া সবার মনকে মুগ্ধ করে। অবিরাম জলধারার এই পানির শব্দ, তৈরি করে এক শ্রুতিমধুর জল তরঙ্গ। আপনি বছরের যেকোনো সময়ে এখানে বেড়াতে আসতে পারেন।

কেওক্রাডাং পাহাড়

বাংলাদেশি হাইকার এবং রোমাঞ্চ প্রিয় মানুষদের জন্য কেওক্রাডাং পাহাড় একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাহাড়। এই পাহাড়ের চূড়া থেকে চারিদিকের বৈচিত্র ভাষায় অবর্ণনীয়। এর আশেপাশের উপজাতি এবং আদিবাসীদের জীবনযাত্রা অসভ্যতা এক নতুন অভিজ্ঞতা দেয় মানুষকে

নীলাচল

বান্দরবান জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হল নীলাচল। মূল শহর হতে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নীলাচল পর্যটন কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সটি গড়ে তোলা হয়েছে টাইগারপাড়ায় পাহাড়ের চূড়াতে এবং পর্যটন কেন্দ্র টির নাম দেওয়া হয়েছে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র। অনেকে একে বাংলার দার্জিলিং বলে থাকে। পর্যটন কমপ্লেক্স তিনটি অত্যাধুনিক বিশ্রামাগার রয়েছে।

বিশ্রামাগার গুলোর নাম হচ্ছে নীহারিকা, শুভ্রনীলা এবং ঝুলন্ত নীলা। এই পয়েন্টের মাঝামাঝি রয়েছে বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় খেলার ব্যবস্থা এবং বড়দের জন্য বসার স্থান। পাহাড়ের ঢালে বিভিন্ন উচ্চতায় সাজানো হয়েছে এই স্থানগুলো। প্রত্যেকটি পয়েন্ট স্বতন্ত্র এবং কমপ্লেক্সটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এজন্য এখান থেকে মেয়ে হওয়া যায় ছোঁয়া যায়।

ঋজুক জলপ্রপাত

ঋজুক জলপ্রপাত বা ঋজুক ঝর্ণা, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পর্যটন স্থল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর এই জলপ্রপাত বান্দরবান থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরে রুমা থানায় অবস্থিত।  এই জলপ্রপাত ৩০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং এর পানি প্রবাহিত হয়ে সাঙ্গু নদীতে যায়। সারা বছর ধরে এই জলপ্রপাতে পানি থাকে। এর পানি শীতল এবং স্বচ্ছ। সাধারণত গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে এই জলপ্রপাতের পানি সবচাইতে বেশি থাকে।

বগা লেক

এটিও বান্দরবানের রুমা উপজেলার একটি দর্শনীয় গন্তব্যস্থল। এটি একটি সাদু মিষ্টি পানির হ্রদ। এখানকার পানি স্বচ্ছ এবং গভীর। এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ মিটার বা বারোশো পঞ্চাশ ফিট। স্থানীয় লোকজন পানিতে এই পানিতে তেলাপিয়া মাছ চাষ করে। এর চার পাশের এলাকার নাম সৈকত পাড়া। এই লেকটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পার্শ্ববর্তী গ্রাম।

বগালেক নিয়ে প্রচলিত আছে নানা কল্পকাহিনী। স্থানীয় কিংবদন্তির মতে একটি উপকথা হলো, খুমি গ্রামের বাসিন্দাদের হত্যা করার পরে তাদের আত্মা একটি দেবতার দ্বারা গ্রাসকৃত হয়। পরে যিনি ড্রাগনের আকারে তাদের কাছে ফিরে এসেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি ভূমিকম্প হল, পাহাড়ের ঢাল ভেসে গেল এবং গ্রামটি অদৃশ্য হয়ে একটি গভীর হ্রদ তৈরি করল।

নাফাখুম জলপ্রপাত

নাফাখুম জলপ্রপাত, সাঙ্গু নদীর উপনদী রেমাইক্রি নদী থেকে বয়ে যাওয়া একটি জলপ্রপাত। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত গুলোর মধ্যে একটি। এই জলপ্রপাতটি প্রায় তিরিশ ফুট 10 মিটার উঁচু থেকে নেমে আসে এখানে বিশেষ ধরনের একটি উড়ন্ত মাছ পাওয়া যায়। এই উড়ন্ত মাছের নাম হলো নাটিং।

চিম্বুক পাহাড়

চিম্বুক পাহাড় হল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় এবং বান্দরবানের একটি বিখ্যাত পর্যটন স্থান বান্দরবান থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চিম্বুক পাহাড় চিম্বুক পাহাড়ের চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 2500 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এখানকার রাস্তাটি আঁকাবাঁকা এই পাহাড়ে ওঠার জন্য ব্যবহার করা হয়। পাহাড়ের চারদিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে জিপে চড়ে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা একটি অবর্ণনীয় আনন্দ দেয় পর্যটকদের।

পাশাপাশি ওঠার সময় সাধারণ মানুষের সরল অভিব্যক্তি আমাদেরকে পূর্বকালের মানুষদের জীবনযাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে যে, বেঁচে থাকার জন্য সাধারন মানুষদের কতখানি সংগ্রাম করতে হয়! তারা যেন প্রকৃতিরই এক অংশ। চিম্বুক পাহাড় থেকে নিচে তাকালে মেঘ ভেসে যেতে দেখা যায়। যদি আবহাওয়া পরিষ্কার হয় তাহলে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের ঢেউ এর দৃশ্য আপনার চোখে পড়বে। এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে ছুটে আসে সারাদেশ এবং দেশের বাইরের অনেক মানুষজন।

বান্দরবান জেলার নামকরন

প্রচলিত আছে যে এক সময় এই অঞ্চলে প্রচুর বানর বসবাস করত। এই বানরের দল গুলো ছড়ার পাহাড়ে লবণ খেতে আসতো। একবার বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বেড়ে যায় এবং বানরেরা পাহাড়ে যেতে পারছিল না। এইজন্য তারা একে অপরকে ধরে সারিবদ্ধ ভাবে পানি পার হয়। স্থানীয় লোকজনের চোখে পড়ে এটি। এরপর যখনই পানি বেড়ে যেত তখনই বানরেরা এই পদ্ধতিতে পানি পার করত। এজন্য এলাকার নাম হয়ে যায় ম্যাক অছি ছড়া নামে। মারমা ভাসায় ম্যাক অর্থ ছিল বানর আর ছি অর্থ বাঁধ। পরবর্তীতে বাংলা ভাষা প্রচলন লাভ করার পর স্থানীয় এলাকাটি বান্দরবানে পরিচিতি লাভ করে।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*