সমুদ্র উপকূল, পাহাড়, নদী, বন ও উপত্যকা নিয়ে গঠিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে চট্টগ্রামকে দেশের সবচেয়ে সুন্দর জেলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চট্টগ্রাম ঢাকার দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি প্রধান বন্দর শহর যেখানে রাজধানী থেকে ভালো পরিবহন সংযোগ রয়েছে।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণ অবস্থিত পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রামের দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর এই সমুদ্র সৈকতটি মারাত্মক রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তবে বর্তমান সময়ে সিমেন্ট এবং কংক্রিট দিয়ে তৈরি বাঁধের দ্বারা এর অবস্থা অনুকূলে আনা হয়েছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের খুব কাছাকাছি অবস্থিত বাংলাদেশ নৌবাহিনী’র ঘাঁটি “বিএনএস ঈসা খান”, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশ নেভাল একাডেমি।
এগুলো আপনি একই সাথে দেখে আসতে পারবেন। সৈকতের আশেপাশে রয়েছে বিভিন্ন রকমের খাবার রেস্তোরা এবং রাত্রিকালীন কৃত্তিম আলোর ব্যবস্থা যা পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করা।স্থানীয় লোকজনের মধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সুস্বাদু খাবারের জায়গা হচ্ছে পতেঙ্গা। এখানে যেমন বিভিন্ন ধরনের খাবার পাওয়া যায় ঠিক তেমনি এখানকার খাবারের বৈচিত্র অনেক বেশি।
অনেক মানুষজন এখানে মসলাদার কাঁকড়া খেতে আসেন যা কাবাব হিসেবে বা ভেজে পরিবেশন করা হয়, সাথে থাকে সসেজ ও সালাদ। সৈকত রয়েছে পর্যটকদের জন্য মনোরম বসার ব্যবস্থা এবং প্রকৃতি উপভোগ এর উপায়। সন্ধ্যার পর এখানকার প্রকৃতি অনেক শীতল হয়ে যায় এবং দর্শকেরা এই মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে ছুটে আসেন। জোয়ারের সময় তীরে আছড়ে পড়া বিশাল বিশাল ঢেউ দর্শকদের মনে অনেক লম্বা সময় দাগ কেটে রাখে। তাছাড়াও ভ্রমণের জন্য এখানে অনেক ছোট– বড় জাহাজ এবং স্পিড বোট রয়েছে। সমুদ্রের পাশে গড়ে উঠেছে বার্মিজ বাজার যেখানে বার্মা বা মিয়ানমার থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। তাছাড়াও সি বাইক এবং ঘোড়ার চড়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর
চট্টগ্রামের সবচাইতে আকর্ষণীয় নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক জাদুঘর হল চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। এই জাদুঘর এর প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের অতীতকে সংরক্ষণ করে এবং সময়ের সাথে কিভাবে সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে তার রূপরেখা বর্ণনা করে। এই জাদুঘর বর্তমান প্রজন্মকে পূর্বের প্রজন্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের ভাষা, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি কিভাবে বিকশিত হয়েছে বা বিকাশ লাভ করেছে এবং বর্তমান রূপ লাভ করেছে তার চিহ্নসমূহ এখানে নথিভুক্ত।
জনসাধারণকে শিক্ষিত করতে এবং একে অপরের বোঝাপড়া এবং সহনশীলতা প্রচার করতে এখানেই বাংলাদেশের সকল উপজাতি, অতীত এবং বর্তমান একত্রিত হয়। নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর বাংলাদেশের অন্যতম বিশেষ জাদুঘর এবং এটি ঐক্য ও অগ্রগতির প্রতীক। জাদুঘরের এগারোটি গ্যালারি শ্বাসরুদ্ধকর চিত্রকর্ম, মডেল, পরিবেশ পুনর্গঠন, মানচিত্র, ফটোগ্রাফ এবং বিভিন্ন আইটেমের মাধ্যমে এই উপজাতিদের প্রাণবন্ত করে তোলে। নৃতাত্ত্বিক জাদুঘরের অভ্যন্তরে, দর্শনার্থীদের যুগ যুগ ধরে নিয়ে যাওয়া হবে, চট্টগ্রামের বারোটি উপজাতি এবং বাংলাদেশে পাওয়া ২৯ নৃ–গোষ্ঠীর বিকাশের আবিষ্কার।
প্রতিটি প্রদর্শনে একটি ফলক রয়েছে যা উপজাতিদের বর্ণনা করে এবং দর্শকদের প্রদর্শনীটি ব্যাখ্যা করার জন্য পটভূমির তথ্য দেয়। ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং পাকিস্তানে অবস্থিত উপজাতিদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাদুঘরটি বাড়ানোও হয়েছে। প্রদর্শনীতে থাকা কিছু জিনিসের মধ্যে রয়েছে ফুলদানি, অস্ত্র, বয়ন, নৌকা, কাঁচি, পোশাক, কাঠের তাক, বাঁশের পাইপ, এবং অলঙ্কার। বাংলাদেশে মানুষ কিভাবে প্রতিটি উপজাতির মানুষ বসবাস করত, খেলা করত এবং ঐতিহ্যের চর্চা করত সে সম্পর্কে একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে এই জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর । এটি বাংলাদেশের জনগণের বৃদ্ধি ও উন্নয়নকেও নথিভুক্ত করে এবং আশা রাখা যায় যে, এই উপজাতিরা ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তাদের প্রদর্শনী বৃদ্ধি করতে থাকবে।
ফয়’স লেক
ফয়’স লেক অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড একটি থিম পার্ক যা চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে ফয়’স লেকে অবস্থিত। ফয়’স লেক থিম পার্কগুলি প্রায় ৩০০ একর জমিতে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত পাহাড়, একটি হ্রদ এবং সবুজ বন দ্বারা বেষ্টিত একটি মনোরম পরিবেশে অবস্থিত। বিনোদন ওয়ার্ল্ড, সি ওয়ার্ল্ড এবং ফয়’স লেক রিসোর্টের মতো নির্মাণগুলো একই কমপ্লেক্সে অবস্থিত। অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড হল একটি পার্ক যেখানে সাধারণ থিম পার্ক রাইড, হ্রদে বোট রাইডিং, ল্যান্ডস্কেপিং, রেস্তোরাঁ, ভাসমান স্টেজ, সহ কনসার্ট, নৈসর্গিক হাঁটার পথ এবং অন্যান্য বিনোদনমূলক কার্যকলাপ রয়েছে।
এমনকি এটি একটি রিসর্ট হোটেল হিসেবে ও আদর্শ। এখানে প্রতিটি বয়স এবং পেশা’র মানুষ এর জন্য কিছু না কিছু আনন্দদায়ক ব্যবস্থা আছে। এখানকার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হ্রদ এবং এর আশেপাশের পাহাড়ের সৌন্দর্য। যাতে আপনি ফয়‘স লেকের নির্মলতা এবং প্রশান্তি উপভোগ করতে পারেন সেজন্য পার্কটি আরণ্যের মাঝামাঝি। এখানে অনেক কর্পোরেট পিকনিক এবং অন্যান্য ইভেন্টের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আপনি ফয়’স লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এর দুটি থিম পার্কের বিনোদন উপভোগ করার সময় এখানকার বিলাসবহুল বাসস্থানে থাকতে পারেন।
বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার
চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সেনানিবাসের কাছে “বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার” নামে পরিচিত একটি বিখ্যাত মাজার রয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বায়েজিদ বোস্তামী বাংলাদেশে আসার ইতিহাস নেই। চট্টগ্রামে এই নামে পরিচিত মাজার শুধুই প্রতিকৃতি বা প্রতীক হিসেবে অনেকে বিশ্বাস করে। আবার অনেকেই মনে করেন বায়েজিদ বোস্তামী বাংলাদেশে এসেছিলেন। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে আরব বণিকরা চট্টগ্রাম উপকূলে যেতেন।
তাই নবম শতাব্দীতে বায়েজিদ বোস্তামীর চট্টগ্রামে আগমন অসম্ভব নয়। কিন্তু এটা শুধু একটি ধারণা. এখন পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এটি একটি সাধারন মাজার। এখানে ছোট একটি পুকুর রয়েছে যাতে কচ্ছপ পালন করা হয়। অনেকে এসব কচ্ছপকে জীন বা অতিপ্রাকৃত আত্মা মনে করেন এবং তাদের কে খাবার খাওয়ান।
চট্টগ্রাম শিপ ইয়ার্ড / ডক ইয়ার্ড
বিশ্বের বৃহত্তম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড হল চট্টগ্রাম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড যা সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে অবস্থিত। সারা বিশ্বের এক পঞ্চমাংশ জাহাজ মেরামত ভাঙ্গনের কাজ এখানে সম্পাদন করা হয়। শত শত মিটার দীর্ঘ, বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ টন পণ্য বহন করা এই বিশাল আকারের জাহাজগুলির এখানে এসে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই ইস্পাত দৈত্যদের ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত বিশ্রামের জায়গা হল এটি। এই শিল্পের সাথে সম্পর্কযুক্ত মানুষদের কাছে স্থানটি কাছে আরও বেশী আকর্ষণীয়। আপনি বাংলাদেশে থাকাকালীন সময়ে এটি না দেখে থাকলে অনেক বড় একটি সুযোগ হারাবেন। এই জায়গায় সুপারহিট মুভি অ্যাভেঞ্জার্স এর এজ অফ আল্ট্রনের একটি দৃশ্যের শুটিং হয়েছে।
জিয়া স্মৃতি জাদুঘর
যে ভবনটিতে বর্তমানে জিয়া স্মৃতি জাদুঘর রয়েছে সেটি আগে ওল্ড সার্কিট হাউস নামে পরিচিত ছিল। এটি ১৯১৩ সালে চট্টগ্রাম শহরের একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল একটি দুর্দান্ত বিল্ডিং যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনন্য দালানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সরকারি আধিকারিকদের বাসস্থান হিসেবে এটি ব্যবহৃত হত। ভবনটি পরে একটি জাদুঘরে সংস্কার করা হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে এটি সাধারন মানুষদের জন্য এর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছিল৷
যাদুঘরের দর্শকরা সাত শতাধিক প্রদর্শনী সহ, বিভিন্ন ধরণের স্মারক এবং শিল্প দেখতে আসেন৷ জিয়া স্মৃতি জাদুঘর বারোটি গ্যালারি নিয়ে গঠিত; যার সবকটিই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই গ্যালারিতে পাওয়া আইটেমগুলির মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রপতির প্রতিকৃতি, প্রকৃত মাইক্রোফোন এবং ট্রান্সমিটার যার উপরে রাষ্ট্রপতি তার স্বাধীনতার ঘোষণার ভাষণ দিয়েছিলেন, যে টেবিল এবং চেয়ার থেকে তিনি দেশ শাসন করেছিলেন, ব্যক্তিগত ডায়েরি, নথি, স্মৃতিচিহ্ন এবং উপহারগুলো যা তিনি তাঁর শাসনামলে পেয়েছিলেন।
শেষ গ্যালারিতে দর্শকরা তার অকাল মৃত্যুর একটি পুনর্গঠন দেখতে পাবেন। জাদুঘরটিতে একটি শ্বাসরুদ্ধকর লাইব্রেরি এবং একটি সম্মেলন কক্ষ রয়েছে যা উপস্থাপনা এবং সভাগুলিতে ব্যবহারের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত। এই ভবনে রাষ্ট্রপতিকে খুন করায় জাদুঘরটি তার জীবনের এক অসাধারণ স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত হয়েছে। দর্শনার্থীরা জিয়া স্মৃতি জাদুঘরটিকে চট্টগ্রামের একটি দর্শনীয় আকর্ষণ হিসেবে দেখতে পাবেন, যা শুধু এই অবিস্মরণীয় নেতার জীবনই নয়, বাংলাদেশের বর্ণিল ইতিহাসকেও তুলে ধরে।
Leave a Reply