কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

কুমিল্লা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

কুমিল্লার নাম বললে প্রথম আমাদের চোখে ভেসে ওঠে ময়নামতির কথা। তবে ময়নামতি ছাড়াও কুমিল্লাতে আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কুমিল্লার দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে এই প্রতিবেদন।

শালবন বিহার (ময়নামতি)

বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে অবস্থিত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের নাম হল শালবন বিহার, যাকে লোকজন সাধারণত ময়নামতি বলে চেনে। ময়নামতি বা শালবন বিহার সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিল। বৌদ্ধভিক্ষুদের নিমিত্তে এখানে ১১৫ টি কক্ষ নির্মিত হয়। মূলত অষ্টম শতাব্দীতে দেব রাজবংশী চতুর্থ সম্রাট ভব দেব এই বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন। পুরো স্থানটি ১৬৮ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত।

এটি নির্মিত হয়েছিল সমতট বঙ্গের রাজধানী দেব পর্বত বা লালন বনের সীমান্তবর্তী এলাকায়। পুরো স্থানটি জুড়ে শালবন রাজার বাড়ি ছিল এবং অনেকগুলো কক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো। সেই সময় পোড়ামাটি এবং তাম্র সভ্যতার প্রচলন ছিল, এ কারণে এখানকার জাদুঘরে পোড়ামাটির শিল্প এবং তামার তৈরি বিভিন্ন বস্তু সামগ্রী দেখা যায়।

ধর্মসাগর

ধর্মসাগর হচ্ছে কুমিল্লায় অবস্থিত প্রকাণ্ড এক দিঘী। এই দীঘির নাম অনুসারে স্থানটিও ধর্ম সাগর নামে পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলাম এবং শচীন দেব বর্মন বাংলাদেশ অবস্থান করার সময় এই স্থানে ছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিতে পুকুরের পাশে স্থাপিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি কেন্দ্র বা জাদুঘর। বিশাল এই জলাশয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ২৫০ মিটার। প্রায় ৬০০ বছর পুরাতন এই জলাশয়টি খননের দায়িত্ব নেন ত্রিপুরার রাজা ধর্ম মাণিক্য। ১৪৫৮ সালে এর খনন কাজ শুরু হয়।

এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। উক্ত সময়ে মানুষের খাবার পানির যোগান দিতে এই জলাশয় খনন করা হয়। সময়ের সাথে সাথে এটি কুমিল্লা জেলার বিনোদন এবং ব্যবসার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এর পাশেই স্থাপন করা হয় কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এবং আধুনিক স্টেডিয়াম। এর উত্তর পাশে রয়েছে শহরের প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থানগুলোর মধ্যে একটি। পুকুরের পাশে অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড দীঘিটির পরিবেশ এবং বাস্তুসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

রূপবান মুড়া

কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় একটি ছোট টিলার উপর অবস্থিত রূপবান মুড়া, কুমিল্লার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বহনকারী স্থান। এখানে অসাধারণ পুরা মন্দির এর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। মন্দিরের গঠন অষ্টভূজাকৃতির এবং আরো কয়েকটি সহায়ক স্থাপনা রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে খ্রিস্টীয় ৬ থেকে ৭ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করা হয়। অনেকে এটিকে খ্রিস্টানদের গির্জা ও বলে থাকেন।

ত্রিরত্ন স্তুপ বা কোটিলা মুড়া

এটি ৭ম শতাব্দী’র একটি পুরাকীর্তি। এর নাম ত্রিরত্ন হবার কারণ হল যে, এখানে তিনটি স্তুপ রয়েছে। বস্তুত বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর উপর ভিত্তি করে তিনটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি রত্নের বা ভিত্তির নাম হল জ্ঞান, ধর্ম বা নৈতিকতা এবং শৃঙ্খলা বা সংগঠন। শালবন বিহারে পাওয়া একটি প্রাচীন প্রতিলিপি থেকে জানা যায় যে কুমিল্লাতে দুটি ত্রিরত্ন মন্দির স্থাপন করা হয়েছিল। সুতরাং, যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা যেতে পারে যে, ত্রিরত্ন স্তুপ বা কোটিলা মুড়া তাদের মধ্যে একটি। এখান থেকে বহু পোড়ামাটির ভাস্কর্য এবং সীলমোহর উদ্ধার করা হয়েছে।

ইটখোলা মুরা

ময়নামতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের নাম হচ্ছে ইটখোলা মুড়া। ধারণা করা হয় এটিও কোটিলা মুড়া স্থাপনের সমসাময়িক একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। তবে ইটখোলা মুরা’কে অন্যতম চিত্তাকর্ষক ধ্বংসাবশেষ হিসেবে ধরা হয়। এটিও কুমিল্লার কোটবাড়ি রোডের পাশে অবস্থিত এবং এটি রূপবান মুড়া’র ঠিক বিপরীত দিকে স্থাপিত। ইটখোলা মুরা’র সাথে এর সম্পর্ক হচ্ছে যে, এটিও তিনটি সোপান দ্বারা গঠিত।

অনেক দীর্ঘ সময় ধরে এখান থেকে ইট সংগ্রহ করার জন্য স্থানটির নাম হয়েছে ইটখোলা মুড়া। ধারণা করা হয় এটিও খ্রিস্টানদের একটি চ্যাপেল বা গির্জা। এখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন ধরণের পুরাকীর্তি, তিনটি বৃত্তাকার সোনার খাঁচা, শিলালিপি, পোড়ামাটির ভাস্কর্য ইত্যাদি।

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি বা কুমিল্লা ওয়ার সিমেট্রি

এটি কুমিল্লা শহরে অবস্থিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি স্মারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিকটবর্তী এলাকা সমূহে যারা প্রাণ হারান তাদের এখানে কবরস্থ করা হয়েছে। এখানকার কবরস্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৭৩৬ জন যোদ্ধা সমাহিত আছেন। তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এই সিমেট্রি নির্মিত। এর অবস্থান হচ্ছে কুমিল্লা সেনানিবাস এর ভেতরে।

কুমিল্লা জগন্নাথ মন্দির বা 17 রত্ন মন্দির

স্থানীয় অনেক মানুষ এই মন্দির কে নতুন শালবন বিহার বা বৌদ্ধ মন্দির নামে অভিহিত করেন। এটিও কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এই মন্দির তৈরীর উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দু দেবতা জগন্নাথ কে ভক্তি-শ্রদ্ধা উৎসর্গ করা। ত্রিপুরার রাজা দ্বিতীয় রত্ন মানিক্য খ্রিস্টীয় ১৮ শতকে এটি নির্মাণ করেন। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি পবিত্র স্থান এবং কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত অন্যতম প্রাচীন উপাসনালয়। এখান থেকে আদর্শ বাংলা রীতি অনুযায়ী লিখিত পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করা হয়েছে।

রুপ সাগর পার্ক

কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত হচ্ছে রুপসাগর পার্ক। এটি পরিচিত এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সুন্দর লেক এবং মুক্ত বাতাসের জন্য। পুরো পরিবার নিয়ে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সময় কাটানোর জন্য এটি একটি উপযুক্ত জায়গা। সেনানিবাসে অবস্থিত হলেও স্থানটি সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। তবে এখানে প্রবেশের জন্য টিকিটের মূল্য হচ্ছে ৫০ টাকা, আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য টিকিট এর মূল্য ৩০ টাকা।

এখানকার কৃত্রিম ঝর্ণা এবং তার উপরে নির্মিত প্রতিমূর্তি গুলো শ্বাসরুদ্ধকর ও ভয়াবহ রকমের সুন্দর। বিনদনের জন্য আপনি এখানকার লেকে প্যাডেল বোট চালাতে পারেন। পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বসার ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া এখানে খাবার রেস্তোরাঁ আছে এবং এখানে শহরের সবচাইতে সুস্বাদু পিজা এখানে পাওয়া যায়। যদিও এখানকার খাদ্য সমূহ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল।

ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক

বাংলাদেশের ডিজনি ওয়ার্ল্ড ওয়াল্ড নামে খ্যাত হচ্ছে এই ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক। এটি কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত। এখানে ২০ টিরও বেশি রাইড রয়েছে। তাছাড়া রয়েছে ওয়াটার পার্ক, ডাইনোসর পার্ক এবং আকর্ষণীয় পিকনিক স্পটসমূহ। এই পার্কের প্রবেশদ্বার অনেকটা ডিজনি ওয়ার্ল্ড এর নকল করে করা হয়েছে এবং স্থানটি অনেক আকর্ষণীয়। পার্কে প্রবেশের জন্য ২০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে আপনি আপনার প্যাকেজ নির্ধারণ করতে পারবেন। এর ভেতরে রয়েছে খাবার দোকান ও রেস্তোরা।

লালমাই পাহাড়

প্লাইস্টোসিন যুগে গঠিত হওয়া পাহাড় গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে লালমাই পাহাড়। প্রত্নতাত্ত্বিক দের মতে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে এই পাহাড় গঠন সম্পন্ন হয়েছিল। এই পাহাড় তৈরি হয়েছে লাল রঙের মাটি দিয়ে, এজন্য এর নাম হচ্ছে লালমাই পাহাড়। লালমাই পাহাড় নিয়ে একটি পৌরাণিক গল্প রয়েছে সেটি হল নিম্নরূপ,

রাম ও রাবণের মহাযুদ্ধের সময় লক্ষণ (রামের ছোট ভাই) গুরুতরভাবে আহত হয়। ক্ষত সারানোর অন্য উপায় না দেখে বৈদ্য পরামর্শ দেন যে, হিমালয় পর্বতে জন্মানো বৈশল্যকরণী বৃক্ষের পাতার রস লক্ষণ এর ক্ষতস্থানে লাগালে কাজ হবে। তাকে সুস্থ দেখবার আশায় হনুমান হিমালয়ের পথে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু হিমালয় পৌঁছে সে গাছটি চিনতে পেরে না ওঠায়, সে পুরো পর্বত তুলে নিয়ে আসে।

চিকিৎসা কার্য শেষে হনুমান আবার পর্বত কে যথাস্থানে রেখে আসার জন্য উড়ে যেতে থাকে। পথিমধ্যে পর্বতের একটি খন্ডাংশ এই অঞ্চলে পরে এবং সেখানে এই পাহাড় এর আবির্ভাব ঘটে। কাহিনী অনুসারে সেই সময় এই এলাকার স্থানীয় নাম ছিল লমলম এবং সেখান থেকে লালমাই নামটি এসেছে। উল্লেখযোগ্য যে এখানকার রাজার দুই কন্যা ছিল, তাদের একজনের নাম ময়নামতি এবং আরেকজনের নাম লালমতি। তাদের নাম অনুসারে ও লালমাই পাহাড় নামকরণ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বর্তমানে স্থানীয় ভূমিদস্যু ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এখানকার ঐতিহ্য ধ্বংসের মুখে।

রাণী ময়নামতি প্রাসাদ ও মন্দির

কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার সাহেবের বাজার এলাকায় অবস্থিত রাণী ময়নামতির প্রাসাদ। ১৯৮৮ সালে এই স্থানের খননকার্য শুরু করা হয়। এই প্রাসাদের অবস্থান ময়নামতি পাহাড়ের উত্তর দিকে বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চলে। সমতল থেকে প্রায় ১৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই প্রাসাদ। ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই প্রাচীন স্থাপনা নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়। এখান থেকে বিভিন্ন ধরনের কারুকাজ করা অলংকৃত ইট এবং পোড়ামাটির ফলক উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে এই স্থানটিকে সংস্কার করা হয়েছে এবং ভ্রমণের জন্য এটি একটি উপযুক্ত গন্তব্য স্থল।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*