
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর হল গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জ শহরটি গড়ে উঠেছে মধুমতি নদীর তীরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের আক্রমনের অন্যতম কেন্দ্র ছিল গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী গোপালগঞ্জের প্রায় ১৫০ জন নিরীহ লোককে হত্যা করে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আরও প্রায় ২০০ জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পরবর্তীতে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্যকে হত্যা করে। গোপালগঞ্জ জেলাকে পাঁচটি থানায় ভাগ করা হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী’র “একসেস টু ইনফরমেশন” প্রকল্পের আওতায় একটি ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা হয়েছে। গোপালগঞ্জ জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ে এই পোস্টটি শেয়ার করা হলো যা আপনার গোপালগঞ্জ ভ্রমণকে কার্যত সুবিধা পূর্ণ করে তুলবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কর্ণধার ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার একক নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধা বাহিনী। যুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ডের প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে অর্থ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হচ্ছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় থানায়। তিনি মারা যাবার পর তাকে এখানে তার পিতা-মাতার সাথে কবরস্থ করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর সমাধি কে বর্তমান সময়ে একটি আধুনিক কমপ্লেক্সে উন্নীত করা হয়েছে। কমপ্লেক্সটির সম্মুখে প্রবেশদ্বার এর বাম পাশের ভবনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর পিতা- মাতার আদি বাসস্থান আর ডান পাশে রয়েছে এই মহান নেতার কবরস্থান। কমপ্লেক্স এর প্রধান ভবনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি আধুনিক গ্যালারি। গ্যালারি থেকে মাজার পর্যন্ত যেতে কিছুটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে সমাধিস্থল এর উপরে রয়েছে নকশা করা কাঠামো। সমাধিস্থল এবং গ্যালারি সকলের জন্য উন্মুক্ত কিন্তু উভয় স্থলে ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কমপ্লেক্সে একটি সুসজ্জিত জাদুঘর রয়েছে।
সেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরল কিছু ছবি এবং আলোকচিত্র। জাদুঘরের অভ্যন্তরে ছোট একটি লাইব্রেরী ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাছাড়াও ভ্রমণকারীদের জন্য রয়েছে একটি বড় এবং উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া। কমপ্লেক্স এর বাইরে গেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ধান ক্ষেতের প্রাকৃতিক পরিবেশও উপভোগ করার মত।
শেখ রাসেল শিশু পার্ক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলের নাম ছিল শেখ রাসেল। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত শেখ রাসেল শিশু পার্ক হচ্ছে একটি পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র। সমগ্র পার্কের বিস্তৃতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ একর। এখানে রয়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য স্থাপন করা ১৫ টি রাইড। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মাল্টি স্লাইড, স্প্রিং কার, প্যাডেল বোট, ওয়ান্ডার হুইল, মেরি গো রাউন্ড, ইত্যাদি। পার্কের টিকেটের জন্য মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা। প্রত্যেকদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে পার্কটি। তবে শুধু শিশু-কিশোররাই নয় বরং সকল বয়সের মানুষজন এই পার্কে বিনোদনের জন্য ভিড় জমান।
ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি
ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানায় অবস্থিত। আঠারো শতকের শুরুর দিকে কাশিয়ানী থানায় শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন এবং সহজ সরলভাবে প্রভুভক্তি, প্রেম ও শান্তির কথা প্রচার করতেন। বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয়।
ঠাকুর ঘরের পাশে রয়েছে একটি বড় দীঘি, যাকে কামনা সাগর বলা হয়। মানুষজন বিশ্বাস করে যে এই পুকুরে গোসল করলে বা পুণ্যস্নান সম্পন্ন করলে তার কামনা বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। প্রতিবছর এখানে অনেক বড় উৎসব পালন করা হয় এবং সেই উৎসবে যোগ দিতে আসেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাংলাদেশ ছাড়াও প্রায় দশটি দেশের মানুষ জন্য এখানে পূজা অর্চনার জন্য আসেন।
একই সাথে পার্শ্ববর্তী এলাকায় মেলার আয়োজন করা হয়। এত মানুষকে জায়গা দিতে ঠাকুরবাড়ি সহ তার আশেপাশের ৬০ একর জায়গা জুড়ে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। এখানে থাকার জায়গা ছাড়াও ওয়াশরুম, কাপড় পরিবর্তন এবং যাবতীয় সুবিধার জন্য বাড়তি ঘর স্থাপন করা হয়েছে। আয়োজিত মেলাতে বাংলাদেশের কুটির শিল্পের উৎপাদিত বিভিন্ন সামগ্রী পাওয়া যায়, যা বাংলার সভ্যতা কে চিত্রিত করে। মেলার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত করা হয়।
পদ্মবিল
গোপালগঞ্জের সদর উপজেলার বলাকইড় নামক গ্রামটি হচ্ছে একটি বিল বেষ্টিত গ্রাম, যা সদর উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নের অংশ। শহর থেকে মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে গ্রামের বিলটি ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী সারা ফেলেছে। এই বিলের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ পদ্ম ফুল দিয়ে বেষ্টিত। আশ্চর্যজনকভাবে ১৯৮৮ সালের বন্যা পরবর্তী সময় থেকে প্রকৃতিগতভাবে এই বিলের পদ্ম ফুল ফোটা শুরু হয়।
যা এখন সমগ্র বিলকে ছেয়ে ফেলেছে। এই বিলে রয়েছে প্রচুর সাদা এবং লাল পদ্ম ফুল। নৌকা নিয়ে বিলে ভ্রমণের সময় চারদিকের পরিবেশ দেখা যেন এক নৈসর্গিক দৃশ্য। বর্তমানে এই বিলকে ঘিরে স্থানীয় অনেক মানুষের অর্থনীতি পরিচালিত হয়। এখানে দর্শকদের নৌকাভ্রমণ করিয়ে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বর্ষার সময় সবচাইতে বেশি পদ্মফুল পাওয়া যায়। স্থানীয়রা এই সময় স্বল্পমূল্যে পর্যটকদের কাছে পদ্ম ফুল বিক্রি করেন।
কোর্ট মসজিদ
গোপালগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই মসজিদটি। কোর্ট মসজিদ কে অনেকে গোপালগঞ্জ কেন্দ্রীয় মসজিদ ও বলে। ১৯৪৯ সালে পূর্ব- পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন এই মসজিদটি উদ্বোধন করেন। এই মসজিদে রয়েছে একটি বড় মিনার এবং কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একটি গোলাকার গম্বুজ। মিনারটি ছোট ছোট তারাঙ্কিত নকশা দ্বারা সজ্জিত। এই মসজিদটি এত সুন্দর যে শহরের প্রায় সকলেই মসজিদটি চেনেন এবং দর্শনার্থীদের যথাযথ আতিথেয়তা প্রদান করেন।
শাপলার রাজ্য (শাতলা গ্রাম)
গোপালগঞ্জের উজিরপুরের নয়ন কান্দি গ্রামে অবস্থিত এই বিশাল বিল স্থানীয়দের কাছে শাপলা বিল নামে পরিচিত। কবে থেকে এই বিলে শাপলা ফোটা শুরু করেছে তার সম্পর্কে সঠিক ধারণা কারো কাছে নেই। তবে প্রায় ১০ হাজার একর জমি বিস্তৃত এই বিলটি শাপলা চাষের জন্য বিখ্যাত। সব মিলিয়ে তিন ধরনের শাপলা ফুল এখানে পাওয়া যায় (সাদা, লাল এবং বেগুনি)। তবে সবচাইতে বেশি দেখা যায় লাল শাপলা। এখান থেকে বাংলাদেশের সকল এলাকায় শাপলা ফুল সরবরাহ করা হয়। গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ শাপলা ফুল এবং তার বিপণনের উপর ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এখানে সারাবছর শাপলা চাষ করা হয় তবে বাংলাদেশের গ্রীষ্ম এবং বর্ষা মৌসুমে সবচাইতে বেশি শাপলা ফুল এর দেখা মেলে। সারাদেশ থেকে অনেক মানুষ এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে এখানে আসেন। স্থানীয়রা দর্শকদের ভাড়া করা নৌকায় এই বিলটি দেখিয়ে থাকেন। নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে এখানে ছবি তোলা একটি অন্যতম কার্যক্রম হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া এখানে শাপলা ফুল কিনতে পাওয়া যায়, তবে শাপলা ফুল কিনতে হলে আপনাকে সকালের দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে। গ্রামটি তুলনামূলকভাবে অনুন্নত বলে এখানে খুব ভালো থাকার এবং খাবার ব্যবস্থা নেই। তবে এখানকার মানুষ অনেক অতিথিপরায়ণ। যদিও কিছু স্থানীয় খাবার দোকান এখানে আছে কিন্তু থাকতে চাইলে আপনাকে গোপালগঞ্জ শহরে যেতে হবে।
গোপালগঞ্জ শহরে থাকার মত বেশ কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল রয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হোটেল রানা, হোটেল সোহাগ, হোটেল পলাশ, হোটেল শিমুল এবং হোটেলে রিফাত। আপনার বাজেট অনুযায়ী ৫০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে আপনি এক রাত থাকতে পারবেন। তবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের অধীনস্থ মধুমতি মোটেল হচ্ছে সবচাইতে জনপ্রিয়। ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার এবং সবচাইতে জনপ্রিয় গণপরিবহন হচ্ছে বাস। সাধারণত তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে আপনি ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জ পৌঁছে যেতে পারবেন এবং ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে আপনার যাত্রার খরচ সম্পন্ন করা সম্ভব।
Leave a Reply