মৌলভীবাজার জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

মৌলভীবাজার জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

সিলেট বিভাগের অন্যতম দর্শনীয় একটি পর্যটন গন্তব্যস্থান হচ্ছে মৌলভীবাজার। মৌলভী সৈয়দ কুদরতুল্লাহ নামক একজন ইসলাম ধর্ম প্রচারক এবং স্থানীয় বিচারক এই এলাকাতে তার কর্মের জন্য ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি একই সাথে ১৭ তম শতাব্দীতে অত্র এলাকার জমিদার ছিলেন। অন্যান্য সকল কর্মের পাশাপাশি তিনি এই স্থানে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম অনুসারে তখন থেকেই স্থানটি মৌলভীবাজার নামে পরিচিত। মৌলভীবাজারে সারি সারি পর্যটন স্থল রয়েছে। এখানকার পর্যটন স্পটসমূহ সম্পর্কে এই পোস্টে তুলে ধরা হলো।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ থানায় অবস্থিত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রায় সাত হাজার একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এই বিশাল জাতীয় উদ্যানটি। এটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইনের অধীনে এই স্থানটির সরকারি রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদবৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এখানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রায় ৩০০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে।

মাধবপুর লেক

মৌলভীবাজার বিস্তীর্ণ চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। এগুলোর মধ্যে কমলগঞ্জ উপজেলায় চা বাগানের মধ্যস্থ অঞ্চলে একটি অত্যন্ত মনোরম প্রাকৃতিক জলাশয়ে নাম হচ্ছে মাধবপুর লেক। চা বাগানের ভিতরে অবস্থান হওয়ার কারণে লেকের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম এবং সবুজে পরিপূর্ণ। একই সাথে এই হ্রদের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে জলের উপর থেকে পানির গভীরে দৃষ্টিপাত করা যায়।

যেহেতু চা বাগানগুলো ছোট ছোট টিলার উপর অবস্থিত, সেজন্য আপনি টিলার উপর বসে লেকের পানিতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়কার আলোর বিকিরণের মধুর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। তাছাড়াও লেকের পানিতে বিভিন্ন জাতের শাপলা ফুলগুলো, এখানকার সার্বিক সৌন্দর্যে নতুন এক মাপকাঠি  যোগ করেছে।

বাইক্কা বিল

মৌলভীবাজার এবং শ্রীমঙ্গলের মাঝপথে হাইল হাওরের দক্ষিণ প্রান্তে বাইক্কা হচ্ছে একটি অগভীর জলাশয় বা হ্রদ। ২০০৩ সালে জলাভূমি অভয়ারণ্য হিসেবে এটি নথিভূক্ত হয়। অপরূপ এই জলাশয়ের আয়তন প্রায় ১৭০ হেক্টর। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শীতকালে প্রচুর পরিমাণে অতিথি পাখি এখানে আসে। এটি ধরে নেওয়া যায় যে, অতিথি পাখিদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক পাখি এখানে শীতকালে পাড়ি জমায়।

প্রকৃতিপ্রেমী এবং বিজ্ঞানীদের মতানুসারে, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলাশয় ভর্তি মাছের উপস্থিতি, অতিথি পাখিদের আগমনের প্রধান কারণ। সকল বয়সের মানুষ এবং সমগ্র পরিবারের বিনোদনের জন্য এটি একটি অপূর্ব পর্যটন গন্তব্যস্থল। এই অভায়ারণ্যে দুটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। জীব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও এখানে প্রাণীবৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করতে আসেন এবং পাশাপাশি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ উপভোগ করেন।

যদিও  এই বিলে বোটিং করা সম্ভব কিন্তু অতিথি পাখিদের বা অন্যান্য পাখি ও প্রাণীদের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধা দেওয়া সরকারের পক্ষ থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা থাকার জন্য পাখিরা  এখানে তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে। অতিথি পাখির আগমনের কারণে এখানকার প্রাণীবৈচিত্র্যে প্রজাতির সংখ্যা বেড়েছে, যা সার্বিকভাবে ইতিবাচক।

হামহাম জলপ্রপাত

আপনি যদি হাইকিং, ট্রাকিং এবং অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে থাকেন, তবে হামহাম জলপ্রপাত হচ্ছে আপনার জন্য উপযুক্ত একটি পর্যটন স্থান। এখানে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে রাজকান্দি বনের মধ্যে দিয়ে হাইকিং বা ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে যাত্রা করতে হবে। যাত্রাপথে আপনি বিভিন্ন প্রাণীর চলাফেরাও লক্ষ্য করতে পারেন; যা সত্যিই আকর্ষণীয়। মৌলভীবাজার জেলায়  রাজাকান্দি নামক স্থানে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। প্রথমবারের মতো ২০০৯ সালে স্থানীয় জনগণ এই জলপ্রপাতটি আবিষ্কার করে। প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু থেকে এই জলপ্রপাতের পানি প্রবাহিত হয়। স্থানটি ভ্রমণের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত সময় হচ্ছে বর্ষা এবং শরৎকাল।

বরশিজোড়া ইকো পার্ক

এই ইকো পার্কটি মৌলভীবাজার সদরে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যেই আপনি এখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। এটি মানব সৃষ্ট একটি ইকো পার্ক এবং দর্শনার্থীদের তথ্য প্রদানের উদ্দেশ্যে জানাচ্ছি যে, মানবসৃষ্ট সকল বনাঞ্চল গঠনের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। এই পার্কটি এখনো সম্পূর্ণ সৌন্দর্যে প্রক্ষেপিত হয়নি, কিন্তু আপনার সংক্ষিপ্ত পরিদর্শনের জন্য এই পার্কটি একটি আদর্শ স্থান।

এখানে প্রধানত বৃক্ষ এবং ঔষধি জাতীয় গাছ রোপণ করা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য এখানে স্থাপন করা হয়েছে চারটি পিকনিক স্পট, দুইটি কটেজ, দুইটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পাঁচটি পাবলিক টয়লেট এবং নিরাপত্তা পোস্ট। প্রাণীবৈচিত্র্য সংকলনের উদ্দেশ্যে এখানে কিছু সাধারণ প্রাণী রাখা হয়েছে।

ক্যামেলিয়া লেক

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে দৃষ্টিনন্দন এই প্রাকৃতিক লেকটি সাম্প্রতিক সময়ে মানুষজনের ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি পর্যটন স্পট হয়ে উঠেছে। এখানে একই সাথে প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ লক্ষ্য করা যায়। এখানকার চারপাশে রয়েছে সবুজ প্রকৃতি, ঠিক সোজা উপরে প্রতীয়মান হয় তুলোর মতো মেঘ এবং স্থির নীল আকাশ- যার প্রতিচ্ছবি বিম্বিত হয় লেকের স্বচ্ছ পানির উপরে। সবুজ বৃক্ষমালা ভরে থাকে পাখির আনাগোনায়, যার কোলাহল সারাক্ষণ প্রকৃতিকে মাতিয়ে রাখে। মৌলভীবাজারে এসে এমন সুন্দর একটি স্থান না দেখে ফিরে ফিরে গেলে আপনি অনেক বড় মিস করবেন।

যদিও এখানে বড় বড় গ্রুপকে ভ্রমণের জন্য অনুমতি দেওয়া হয় না, তবে আপনি যদি পরিবার নিয়ে বা ছোট গ্রুপে স্থানটি ভ্রমণ করতে চান তাহলে প্রারম্ভিক অনুমতি সাপেক্ষে আপনি এখানে দর্শনার্থী হিসেবে আসতে পারেন। উল্লেখ্য যে, এখানে আপনাকে পূর্বে প্রস্তুতকৃত খাবার নিয়ে আসতে হবে এবং শমশেরনগর চা বাগানের কর্তৃপক্ষের বিশেষ কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে।

তারপরেও আপনি যদি এখানে দর্শনার্থী হিসেবে আসতে পারেন, তবে আপনি মনে রাখার মত স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। ক্যামেলিয়া লেকের পাশে রয়েছে শমশেরনগর গলফ ক্লাব। মূলত গলফ ক্লাবগুলোর সৌন্দর্য  ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তবে গলফ খেলা অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি খেলা এবং এর মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার জন্য প্রচুর জনবল ও শ্রমের দরকার পড়ে। ফলশ্রুতিতে এই বিশাল ক্লাবগুলো হয়ে ওঠে খেলোয়ার ও পর্যটকদের  অন্তরে নাড়া দেয়ার মত স্থান।

পদ্ম ছড়া লেক

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পী বিপুল সম্ভাবনাময় একটি  প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হচ্ছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে অবস্থিত পদ্ম ছড়া লেক। পিকনিক, আনন্দভ্রমণ বা বেড়ানোর জন্য বন্ধু- বান্ধব ও পরিবার- পরিজনদের নিয়ে বছরের যে কোনো সময় এই লেকে আসতে পারেন। এখানে আসলে আপনি চা বাগানের সৌন্দর্য এবং লেকের মোহনীয় স্নিগ্ধতায়, এক অপরূপ মানসিক প্রশান্তি পাবেন।

শুধু বাংলাদেশ নয় বরং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও এই লেকটি তার সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। আশেপাশের ছোট টিলা থেকে অথবা লেকের নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে এখানকার সবুজ দিগন্ত মানুষকে তার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসায় মোহিত করে তোলে। এখানে স্থানীয় বাংলাদেশী মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন উপজাতীয়দের বসবাস রয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও এখানকার  জনজীবন ও ঐতিহ্য সকলের জন্য আর এক নতুন অভিজ্ঞতা বয়ে আনতে সক্ষম।

কীভাবে যাবেন কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বাস সার্ভিস সরাসরি মৌলভীবাজার পর্যন্ত প্রতিনিয়ত যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে  রয়েছে গ্রীন লাইন পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন এবং হানিফ এন্টারপ্রাইজ। আর আপনি যদি আকাশপথে মৌলভীবাজার যেতে চান, তবে আপনাকে ঢাকা থেকে বিমানে সিলেট শাহজালাল এয়ারপোর্ট আসতে হবে এবং সেখান থেকে স্থানীয় যাতায়াত ব্যবস্থার মাধ্যমে খুব সহজে পৌঁছে যেতে পারবেন মৌলভীবাজার।

মৌলভীবাজারে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল শেরাটন প্লাজা (কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার সদর), হোটেল সোনারগাঁও (শ্রীমঙ্গল রোড, মৌলভীবাজার সদর), হোটেল হেলাল (সাইফুর রহমান রোড, মৌলভীবাজার), পর্যটন রেস্ট হাউস (কুসুমবাগ, মৌলভীবাজার সদর), গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এবং গলফ ক্লাব (রাধানগর, মৌলভীবাজার)।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*