বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হল নওগাঁ। নওগাঁকে বর্তমানে বাংলাদেশের রুটির ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ এখানে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য শস্য উৎপাদিত হয়। নওগাঁতে যে পরিমান ধান এবং গম উৎপাদিত হয় তার মূল্যমান বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ (২০০৯-১০ এর সমিক্ষা অনুযায়ী)। খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিক থেকে নওগাঁ বাংলাদেশের প্রথম। শুধুমাত্র খাদ্যশস্য নয় বরং আরো বিভিন্ন সবজি এবং ফল এখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। আপনি নওগাঁ ভ্রমন করতে গেলে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয় বরং আরো অনেক পুরাকীর্তি ও আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান দেখতে পাবেন। আপনার নওগাঁ ভ্রমণকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে এই পোস্টটি আপনাদের সাহায্য করবে বলে আশা রাখি।
পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
নওগাঁ জেলার বদলগাছী থানাতে সোমপুর বিহারটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বলে এই স্থানটি পরিচিত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এই পুরাতাত্ত্বিক স্থাপত্যকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত করে। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। এটি প্রাক ইসলামী স্থাপত্য শিল্পের একটি নিদর্শন। এই বৌদ্ধবিহারটি তৈরি হয় পাল আমলে যা খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত কার্যকারী ভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
ভারতের পূর্বাঞ্চলে বাংলা ও মগধ নিয়ে বেশকিছু মঠ নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমান কালের সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেই সময় মোট পাঁচটি মহাবিহার অর্থাৎ উচ্চশিক্ষার নিমিত্তে কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সোমপুর বিহার বা পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রত্যেকটি মহাবিহারই তৎকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাল সাম্রাজ্য মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল। সেজন্য প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায় যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জানা যায় যে চীন থেকেও পন্ডিত এখানে পাঠদানের জন্য এসেছেন এবং সমসাময়িক পণ্ডিতদের মধ্যে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
পাহাড়পুর খননের সময় বৌদ্ধদের শিলালিপি, সীলমোহর ও পোড়া মাটির ফলক পাওয়া যায়। এই বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেছিলেন পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল, যা সেই আমলের শিলালিপি থেকে জানা যায়। বিহারটি ৭৮০ থেকে ৮২০ খ্রিস্টীয় শতকের মাঝামাঝি নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ধর্মপালের উত্তরসূরী মহিপাল ৯৯৫ থেকে ১০৪৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এর সংস্করণ করেছিলেন বলে জানা যায়। সমগ্র বিহারটি প্রায় ১৮০ টি ঘর এবং কেন্দ্রে একটি ঐতিহাসিক বৌদ্ধস্তূপ সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। এই বিহারটি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যান করার জন্য, আবাসনের জন্য এবং জ্ঞান চর্চার জন্য ব্যবহার করত। সমগ্র স্থানটি প্রায় ১১ হেক্টর জুড়ে বিস্তৃত।
ডানা পার্ক
নওগাঁ শহরের নিকটবর্তী ভবানীপুর গ্রামে এই আকর্ষণীয় এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে ছোট-বড় সকল মানুষের জন্য আকর্ষণীয় রাইড এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। পার্কে উল্লেখযোগ্য রাইডগুলো হল নাগরদোলা, দোলনা, মেরি গো হর্স, চরকি, জীবিত ঘোড়া, টয় ট্রেন, সুইমিং পুল, কটেজ, কিডস কর্নার, প্যাডেল বোট, স্লিপার, কমিউনিটি সেন্টার, রেস্টুরেন্ট এবং পিকনিক স্পট রয়েছে। তাছাড়াও পার্কে শিশুদের আনন্দের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য রয়েছে, যেমন বাঘ, হরিণ, ক্যাঙ্গারু, জিরাফ, ঘোড়া, বক, হাতি, ইত্যাদি।
এটি অত্যন্ত আধুনিক মানের একটি পার্ক। পার্কের প্রবেশ মূল্য মাত্র ২০ টাকা। আপনি যদি সুইমিংপুল ব্যবহার করতে চান তাহলে আপনাকে ৫০ টাকা ফি দিতে হবে। রাইডগুলোর টিকেট মাত্র ১০ টাকা। সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ভ্রমণকারীদের জন্য পার্ক খোলা থাকে। নওগাঁ শহর থেকে রিক্সা বা অটোরিক্সা নিয়ে খুব সহজেই এই পার্কে চলে আসা যায়। আপনি যদি থাকতে চান সে ক্ষেত্রে ডানা পার্কে বাংলো ও কটেজ রয়েছে।
কুসুম্বা মসজিদ
নওগাঁ জেলার মান্দা থানার কুসুম্বা গ্রামে এই পৌরাণিক মসজিদটি অবস্থিত। শিলালিপি থেকে জানা যায় যে ১৫৫৮ সালে এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং পরবর্তী সাল থেকে মসজিদটি ব্যবহারের উপযুক্ত হয়। এই মসজিদটিকে অনেকে “বাংলাদেশের কালো মনি” বলে ডাকে; কারণ মসজিদ তৈরির সময় কালো রঙের পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল। বাংলাদেশের বর্তমান পাঁচ টাকার নোটে এই মসজিদটির ছবি দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের সামনে রয়েছে খোলা জায়গা এবং তার সামনে রয়েছে বিশাল দীঘি।
কুসুম্বা মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানকার একাধিক মেহরাব। সেই সময়কার স্থানীয় প্রথা ছিল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাধারণ জনগণের থেকে আলাদা স্থানে বসা। এজন্য মূল মেহরাব ছাড়াও কিছুটা উচ্চতায় আরেকটি মেহরাব স্থাপন করা হয়েছে যাতে সিঁড়ির সাহায্যে উঠা যায়।
আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান
নওগাঁ জেলার ধামরাই হাট থানায় ২৬৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আলতাদিঘী বাংলাদেশের একটি জাতীয় উদ্যান রূপে পরিচিত। উক্ত স্থানে আলতাদিঘী নামে একটি দীঘিকে কেন্দ্র করে বিশাল বনভূমি গড়ে উঠেছে এবং পুরো এলাকাটি কেন্দ্রীয় দীঘিটির নামে নামকরণ করা হয়েছে। এটি প্রধানত একটি শালবন এবং ২০১১ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় একে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেছে।
দিঘির আয়তন প্রায় ৪৩ একর পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ বন অধিদপ্তর আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানকে জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে। এই জাতীয় উদ্যানে পাওয়া যায় মেছো বাঘ, শিয়াল, অজগর, বানর ও গন্ধ গোকুল। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের জীব বৈচিত্র সমগ্র উদ্যানকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই স্থানকে অতিথি পাখি এবং দেশীয় পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ও বিবেচনা করা হয়।
সম্ভবত পাল আমলে এই দিঘীটি খনন করা হয়েছিল। এই দিঘি সম্পর্কে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। জানা যায় যে, এখানকার স্থানীয় লোকেরা পানীয় জলের সংকটে ভুগত। তাদের সংকট নিরসনে রাজা বিশ্বনাথ রাজমাতার কাছে প্রার্থনা জানান। তার প্রার্থনার জবাবে রাজমাতা বলেন; রাজমাতা এক স্থান থেকে শুরু করে যতদূর পর্যন্ত হেঁটে যাবে ততদূর পর্যন্ত একটি দীঘি খনন করতে হবে, যাতে তার প্রজারা প্রয়োজনীয় পানি পায়।
রাজমাতার শর্তানুযায়ী রাজা বিশ্বনাথ মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাথে পরামর্শ করেন এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজমাতা হাটা শুরু করেন। কিন্তু হাঁটা শুরু করার পর তিনি থামতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে সভাসদ তার পায়ে আলতা ছিটিয়ে দেন এবং বলেন আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, এর জন্য আর আপনি হাঁটতে পারবেন না। সুতরাং যতদূর পর্যন্ত তিনি হেঁটেছিলেন ততদূর পর্যন্ত রাজা বিশ্বনাথ দীঘি খনন করেন এবং সেই অনুসারে দিঘির নাম হয়ে ওঠে আলতাদিঘী।
দুবলহাটি রাজবাড়ি
দুবলহাটি রাজবাড়ি নওগাঁ জেলার দুবলহাটি থানার একটি ঐতিহ্যবাহী ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত। এটি ছিল রাজা হরনাথ রায়ের বাসভবন ছিল। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো ভবনটি প্রায় পাঁচ একর জমির উপর বিস্তৃত। রাজবাড়ীটি রোমান ঐতিহ্যের বাহক এবং মূল ফটকের সামনে বড় বড় পিলারগুলো রাজবংশের রুচির পরিচয়দাতা। জানা যায়, দুবলহাটি রাজপ্রাসাদের প্রায় ৩৫০ টি কক্ষ ও সাতটি আঙিনা ছিল।
প্রাসাদের বিভিন্ন জায়গা তিন তলা এবং চারতলা ভবন বিশিষ্ট। প্রাসাদের মধ্যে ছিল একটি হাতির দাঁতের তৈরি সিংহাসন এবং একটি স্বর্ণ ও রৌপ্য মিশ্রিত সিংহাসন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা এই সিংহাসন দুটি লুট করে নিয়ে যায়। ১৮৯২ সালে হরনাথ রায়ের জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হয় এবং তিনি সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। সুরম্য অট্টালিকাটি তৎকালীন রাজবংশের স্মৃতি বহন করে এবং সপরিবারে ভ্রমণের জন্য এটি একটি অত্যন্ত রোমাঞ্চকর স্থান।
আপনি যদি ঢাকা থেকে নওগাঁ যেতে চান সে ক্ষেত্রে গাবতলী, কল্যাণপুর এবং আব্দুল্লাহপুর থেকে সরাসরি এসি এবং নন এসি বাস সার্ভিস পেয়ে যাবেন। তাছাড়াও আপনি ট্রেনে নওগাঁ যেতে পারেন। আর আপনি যদি আকাশ পথে যেতে চান সে ক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত বিমানে যেতে হবে এবং সেখান থেকে গাড়ি বা বাসে চড়ে নওগাঁ যেতে হবে।
নওগাঁতে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি উন্নত মানের হোটেল রয়েছে এবং খরচ তুলনামূলকভাবে কম। হোটেলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল যমুনা, হোটেল প্লাবন, হোটেল অবকাশ, হোটেল রাজ, মল্লিকা ইন, ইত্যাদি। নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে আপনি বিভিন্ন খাবার উপভোগ করতে পারবেন। তবে গোস্তহাটির মোড়ে খাবার দোকানগুলো বেশী জনপ্রিয়।
Leave a Reply