
বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলার নাম হচ্ছে নাটোর, যা সারাদেশে বিশেষভাবে পরিচিত এখানে অবস্থিত পুরাতাত্ত্বিক রাজবাড়ির জন্য। মুঘল আমলের সময় নাটোরকে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পরবর্তীতে নবাবি আমলের সমাপ্তির সাথে সাথে নাটোরের জমিদারি প্রথা লুপ্ত হতে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর রাজশাহী জেলাকে বিভক্ত করে, নাটোর জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের সবচাইতে বড় বিল চলনবিল নাটোরে অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রধান কয়েকটি নদী নাটোর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নাটোরের নদীগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে পদ্মা নদী, বড়াল নদী, আত্রাই নদী, তুলসী গঙ্গা নদী, নারদ নদ, নাগর নদ।
উত্তরা গণভবন
উত্তরা গণভবন নাটোর তথা বাংলাদেশের একটি অতি পরিচিত ল্যান্ডমার্ক। উত্তরা গণভবন ছিল ভারতের পূর্ববঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের বাসস্থান। এই সম্প্রদায়ের জমিদারি পরিচালনা করতেন রানী ভবানী। এর জন্য এ স্থান রানী ভবানীর জমিদার বাড়ি নামেও পরিচিত। রানী ভবানীর পূর্ব পুরুষেরা ভারতের পূর্ববঙ্গের দিঘাপতিয়া এলাকার শাসক ছিলেন। ১৭৩৪ সালে রানীভবানী তার মন্ত্রীকে দিয়ে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। বর্তমান সময়ে এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পুরাতাত্ত্বিক ভবন যার সম্পূর্ণভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। প্রাসাদটি রোমান স্থাপত্য শিল্পের একটি নিদর্শন।
জমিদার বাড়ি তৈরীর সময় রানী ভবানী ইতালি থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র নিয়ে এসেছিলেন। প্রাসাদের সম্মুখ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইটালিয়ান মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি নারী। মূর্তি তাছাড়াও ইতালির তৈরি অত্যন্ত দামী একটি ঘড়ি রাজ প্রাসাদের অভ্যন্তরের রয়েছে। রাজপ্রাসাদটি তিন দিক থেকে লম্বা দিঘী দিয়ে ঘেরা। রানী ভবানী আশঙ্কা করেছিলেন যে তার রাজপ্রাসাদে যদি কখনো আক্রমণ হয় তাহলে জলাশয় পাড়ি দিয়ে শত্রুদের আঘাত হানা মুশকিল হবে। সেজন্য তিনি জমিদার বাড়ির তিন পাশ জলাশয় খনন করেন।
রাজপ্রাসাদের বাকি এক দিক ছিল প্রাসাদের সম্মুখ দরজা। এই প্রধান ফটকে যাবতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। রাজপ্রাসাদটি এত সুন্দর যে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা এবং আতিথেয়তা জন্য এই প্রাসাদটিকে একটি আনুষ্ঠানিক স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। জমিদার বাড়ির চারপাশে প্রশস্ত বাগান রয়েছে। বাগানগুলো পার হলেই পাওয়া যাবে দিঘী। জমিদার বাড়ির ভিতরে পুরাতন এবং নতুন আন্তর্জাতিক মানের আসবাবপত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাজ বাড়ির পিছনে পুকুরের পাশে একটি দোতলা বসার ঘরে রয়েছে যা কাঠ দিয়ে তৈরি। আপনি রাজবাড়ির যেকোনো জায়গায় বেড়ান না কেন আপনার ভিতরে অকৃত্রিম আনন্দ আসা স্বাভাবিক। রাজবাড়ী বাগান এবং পুকুর মিলিয়ে একটি নৈঃসর্গিক দৃশ্য তৈরি করে।
বাংলাদেশী প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই প্রাসাদটিকে বাংলাদেশে তার সরকারি বাসভবন হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রিপরিষদ, আমলা এবং কূটনৈতিক বৈঠকের জন্য ভবনটির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
উত্তরা গণভবন জাদুঘর
২০১৮ সালের ৯ মার্চ নাটোরের উত্তরা গণভবন নামক স্থানে এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। উত্তরা গণভবনের আর্কাইভে পুরাতাত্ত্বিক বিভিন্ন সামগ্রী, যেমন আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, বর্ম যুদ্ধাস্ত্র ইত্যাদি রাখা হয়েছে।
নাটোর রাজবাড়ি
বাংলাদেশে উপস্থিত অতি অল্প কিছু রোমান স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন এর মধ্যে নাটোর রাজবাড়ি অন্যতম। রাজবাড়ীটি স্থাপিত হয় আঠারো শতকের শুরুর দিকে। পুরো রাজবাড়িটি প্রায় ৫০ একর জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ১৭ শতকে নবাব মুর্শিদ কুলি সারা বাংলা শাসন করতেন। সেই সময়ে সীতারাম নামে এক অপ্রতিরোধ্য জমিদার নাটোর এলাকায় তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব মুর্শিদকুলি তার রাজ্যের সার্বভৌমত্ব বহাল রাখার জন্য রামজীবনের দেওয়ান দোয়ারাম কে প্রভূত ভূমি, সম্পত্তি এবং রায় রায়ান উপাধি প্রদান করেছিলেন।
দোয়ারাম সফল হওয়ার পর তিনি নিজস্ব রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দিঘাপতিয়া প্রাসাদ নির্মাণ করেন। দোয়ারাম মারা যাবার পর তার দত্তক নেওয়া পুত্র রামকান্ত রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। রাজা রামকান্ত মারা যাবার পর তার বিধবা স্ত্রী রানী ভবানী নাটোরের রাজকার্যের শাসন নিজ হাতে তুলে নেন। তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন এই এলাকার মানুষজনের উন্নতির জন্য। তার সৎ কর্মের জন্য তার নাম ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি জনগণের প্রিয় একজন শাসক হয়ে ওঠেন।
গ্রীন ভ্যালী পার্ক
নাটোরের লালপুর থানা থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রীন ভ্যালি পার্ক। স্থানীয় যেকোনো বাহন এর সাহায্যে আপনি খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন গ্রীন ভ্যালি পার্কে। এটি একটি অত্যন্ত নান্দনিক এবং বৃহদাকার বিনোদনের স্থান। সম্পূর্ণ পার্কের বিস্তৃতি ১২৩ বিঘা জায়গা জুড়ে। সুতরাং শুধুমাত্র শিশু- কিশোরদের নয় বরং সকল বয়সের মানুষের জন্য এটি একটি উত্তম পর্যটন কেন্দ্র। পুরো পার্কটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে ঠাসা এবং একই সাথে প্রায় ৩০ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে অত্যন্ত মনোরম একটি লেক। পার্কে ভ্রমণকারীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় রাইড।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বুলেট ট্রেন, মিনি ট্রেন, মেরি গো রাউন্ড, নাগরদোলা, হানি সুইং, স্পিডবোট, পাইরেট শিপ, প্যাডেল বোট, ইত্যাদি। পার্কে দীর্ঘসময় ভ্রমণের জন্য বা পিকনিকের জন্য যাবতীয় সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে শুটিং স্পট। অন্যান্য আকর্ষণীয় সুবিধাগুলো হচ্ছে অডিটোরিয়াম, ক্যাফেটেরিয়া, নামাজের স্থান, কনসার্ট এরিয়া, প্লেগ্রাউন্ড, অ্যাডভেঞ্চার রাইড, কার পার্কিং, সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা, আবাসন ব্যবস্থা, ইত্যাদি।
পার্কটি সারা বছর জুড়ে খোলা থাকে। পার্কের সময়সূচী হচ্ছে সকাল .৯টা থেকে বিকাল ৫ টা। পার্কে প্রবেশের মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। এখানকার ওয়াটার পার্ক আপনি মাত্র ৩০০ টাকায় উপভোগ করতে পারবেন। অন্যান্য রাইডসমূহের টিকেট ৩০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যে। আপনি চাইলে ওয়াটার পার্কে ইউজ করতে পারবেন লকার। লকারগুলোর জন্য বিভিন্ন রেঞ্জের ফি রয়েছে। সাধারণভাবে আপনি ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আপনার বাজেট উপভোগ করতে পারবেন। তবে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পার্ক খোলার সময় সূচি কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। আপনার পরিবার নিয়ে ভ্রমণের জন্য এটি একটি অত্যন্ত উপযুক্ত জায়গা।
গ্রীন ভ্যালী পার্কে যাবার জন্য ঢাকা থেকে ঈশ্বরদীগামী বাসে আপনাকে বাঘা নামক স্থানে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা অটো রিক্সা নিয়ে লালপুর যাওয়া যায়। তাছাড়াও আপনি রাজশাহী থেকে বাসে চড়ে বাঘা যেতে পারবেন। আর আপনি যদি ট্রেনে ভ্রমণ করতে চান তাহলে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ট্রেনে চড়ে আপনাকে আব্দুলপুর রেলওয়ে জংশনে নামতে হবে। সেখান থেকে গ্রীন ভ্যালি পার্ক এর দূরত্ব মাত্র ১২ কিলোমিটার।
নাটোরে থাকার জন্য ভালো হোটেল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নাটোর সার্কিট হাউস, হোটেল প্রিন্স, নাটোর সদর ডাকবাংলো, হোটেল রাজ এবং হোটেলে মিল্লাত। নাটোরে থাকার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। আপনি আড়াইশো টাকা থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে মোটামুটি ভালো মানের হোটেল পেয়ে যাবেন। তাছাড়াও আপনারও বাজেট একটু কম হলে ও চিন্তার কিছু নাই। নাটোরে কিছু আবাসিক হোটেল এবং বোডিং রয়েছে যাতে খুব কম খরচে থাকা যায়।
নাটোরের খাদ্যসমূহ সারাদেশে পরিচিত। এখানকার খাদ্যের মান যেমন ভাল ঠিক তেমনি বিভিন্ন ধরনের খাবারও আপনি উপভোগ করতে পারেন। নাটোর ভ্রমণকালে আপনি চলনবিল যেতে পারেন এবং সেখানকার মাছ টেস্ট করে দেখতে পারেন। এই সুযোগ নষ্ট করার মত নয়। তাছাড়াও নাটোর কাচা গোল্লার জন্য বিখ্যাত। পুরো শহরব্যাপী কাঁচাগোল্লার বিভিন্ন দোকান রয়েছে।
আপনি নাটোর শহর থেকে কাঁচাগোল্লা খেতে পারেন এবং সাথে আপনার পরিচিতদের জন্য নিয়ে যেতে পারেন।নাটোর শহর পৌঁছানোর জন্য আপনি ঢাকা থেকে সরাসরি বাস সার্ভিস পেয়ে যাবেন। তাছাড়াও রেলপথে আপনি নাটক পৌছাতে পারেন আর আপনি যদি মনে করে থাকেন আকাশপথে ভ্রমণ করবেন সে ক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে বিমানে রাজশাহীতে আসতে হবে। সেখান থেকে বাসে বা সিএনজিতে আপনি নাটোর আসতে পারবেন। তাছাড়াও রাজশাহী থেকে আপনি সরাসরি কার বা গাড়ি ভাড়া করে নাটোর পৌঁছাতে পারেন।
Leave a Reply