নোয়াখালী জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

Rate this post

নোয়াখালী বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের একটি জেলা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ আমলে ১৮২১ সালে এই জেলাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেই সময় এই জেলার নাম দেওয়া হয়েছিল ভুলুয়া। পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে জেলাটির নাম নোয়াখালী রাখা হয়। জেলার  নামকরণের পিছনে ইতিহাস হল ১৬৬০ সালে এই অঞ্চল এবং এর আশেপাশের জেলাগুলোতে ভয়ানক বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। এলাকা পানিমুক্ত করতে একটি বড় খাল কাটা হয়, যার নাম সুধারাম। সেই সময় এই খালটি এলাকার বদ্ধ পানিকে মেঘনা ও ফেনী নদীতে প্রবাহিত করত।

আঞ্চলিক ভাষা অনুসারে নোয়া অর্থ হচ্ছে নতুন এবং খালি অর্থ খাল। নতুন এই সুধারাম খালকে অনেকে নোয়া খালি বলতো। ফলে ভুলুয়া থেকে নাম পরিবর্তন হয়ে অঞ্চলটির নাম নোয়াখালী হয়ে যায়। নোয়াখালী জেলাটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই পোস্টে নোয়াখালীর গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান সমূহ নিয়ে আলোচনা করা হলো, যা আপনার নোয়াখালী ভ্রমণকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তুলবে।

নিঝুম দ্বীপ

নোয়াখালী জেলার হাতিয়া থানার ছোট্ট একটি দ্বীপ হচ্ছে নিঝুম দ্বীপ। এই দ্বীপের আরো কিছু  পুরাতন নাম রয়েছে, যেমন স্বর্ণদ্বীপ, বালুর চর ও চর ওসমানী। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে এই এলাকাতে পলি মাটি দিয়ে কয়েকটি নতুন দ্বীপ আবির্ভূত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নিকটবর্তী স্থানসমূহও পলি মাটি দিয়ে ভরাট হতে থাকে এবং কয়েকটি  দ্বীপ একটি সামগ্রিক দ্বীপ হয়ে ওঠে; যা বর্তমানে নিঝুম দ্বীপ নামে পরিচিত। শীতকালীন সময়ে হাজার হাজার অতিথি পাখি এই দ্বীপে জমা হয়। পুরো দ্বীপটির আয়তন প্রায় নয় হাজার একর এবং সমগ্র দ্বীপটি গভীর বনাঞ্চল দিয়ে ঘেরা।

বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই বনে। সবচাইতে বেশি যেসব প্রজাতির গাছপালা এখানে দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেওয়া বাইন, কেওড়া, করমচা, ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের বন বিভাগ এই দ্বীপে বনায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়, যা যথাযথভাবে তার উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জীববৈচিত্র এবং বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণ।

এই দ্বীপের বসবাসকারীদের প্রধান পেশা হচ্ছে মাছ ধরা, পশুপালন এবং চাষাবাদ। এখানে বিভিন্ন ধরনের সবজিরও চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু এখানের মানুষজনের জীবন রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং। কারণ তারা প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয় এবং তাদেরকে বেঁচে থাকার উপার্জনের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করতে হয়।

সরকারের সফল উদ্যোগে এখানে একটি প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই বনাঞ্চলে প্রায় ৫০০০ চিতল হরিণ এর পাল রয়েছে। এখানকার প্রধান উদ্ভিদ হল কেওরা, যা বেলে মাটিতে খুব দ্রুত বর্ধনশীল হিসেবে পরিচিত। কেওড়া অনেক উপকারী একটি উদ্ভিদ। এটি দিয়ে বাসস্থানের পিলার, কৃষি উপকরণ এবং নৌকা তৈরি করা যায়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। এই দ্বীপে ৬ টি বাজার রয়েছে।

এখানকার দোকানগুলো মূলত মুদির দোকান, ওষুধের দোকান এবং ছোট খাবার দোকান বা রেস্তোরাঁ। নিঝুম দ্বীপে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে যা এখানকার পর্যটনকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তুলেছে। তাছাড়াও  বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের একটি হোটেল এখানে রয়েছে যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এখানে সরাসরি বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই কিন্তু জেনারেটরের সাহায্যে যাবতীয় বৈদ্যুতিক চাহিদা পূরণ করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিন স্মৃতি পাঠাগার ও জাদুঘর

নোয়াখালী জেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরবর্তী সোনাইমুড়ি থানার পশ্চিমাঞ্চলে বাগপাচারা নামক স্থানে রুহুল আমিন নগর অবস্থিত। এখানে যেতে হলে সোনাইমুড়ী থানা থাকে অটোরিক্সার দ্বারা ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নান্দিয়াপাড়া বাজারে যেতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি  বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ রুহুল আমিনের জন্মস্থান দেখা যায়। ২০০৬ সালের ২০ জুলাই এই জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধার বাসস্থানে জাদুঘর এবং পাঠাগার স্থাপন করা হয়। জাদুঘর এবং পাঠাগার ছাড়াও এখানে রয়েছে অভ্যর্থনা কক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক গ্রন্থাগারিকের কক্ষ, এবং সুসজ্জিত পাঠ কক্ষ।

নোয়াখালী ড্রিম ওয়ার্ল্ড পার্ক

নোয়াখালী জেলা সদরের ধর্মপুর নামক এলাকায় এই বিনোদন কেন্দ্রটি প্রায় ২৫ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই পার্কটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে এবং সকল বয়সের মানুষের জন্য এই পার্কে বিনোদনের ব্যাপক সুযোগ- সুবিধা ও সরঞ্জাম রয়েছে। এখানকার আকর্ষণীয় রাইডগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো প্যাডেল বোট, সুইং চেয়ার, মেরি গো রাউন্ড, সোয়ান বোট, ফ্যামিলি ট্রেন, কিডস ট্রেন, বাম্পার কার, ফেরিস হুইল, এবং নাগরদোলা। এখানে আরো রয়েছে বিস্তৃত সবুজ পাহাড়, ঝরনা, সুইমিং পুল, লেক, পার্কিং স্পেস এবং পিকনিক স্পট।

দর্শনার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে এখানে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পার্কটি সারা বছর  জুড়ে খোলা থাকে এবং পার্কের প্রাত্যহিক সময়সূচী হচ্ছে সকাল ৯ টা ৩০ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৬ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। এটি অত্যন্ত উন্নত মানের পার্ক বলে, এর টিকেট মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি; যা হচ্ছে জনপ্রতি ১৫০ টাকা। তাছাড়াও আপনি যদি গ্রুপে ভ্রমণ করতে চান, সে ক্ষেত্রে পিকনিক প্যাকেজ  ও ফ্যামিলি প্যাকেজ রয়েছে।

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট

গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট হচ্ছে একটি জনকল্যাণমূলক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। ১৯৪৬ সাল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষজনের মধ্যে গান্ধীবাদী দর্শন ছড়িয়ে দেওয়া। অম্বিকা কালিগঙ্গা নামক ট্রাস্ট এখানে দাতব্য কার্যক্রম শুরু করেছিল যার উপরে মালিকানা ছিল ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষের; কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আশ্রমটি পুনরায় চালু করা হয়। গান্ধীবাদের লক্ষ্য হচ্ছে  শাশ্বত এবং বস্তুগত জীবনের মান উন্নয়ন। তাছাড়াও যুদ্ধের বিভীষিকা আশ্রমকে তাদের কার্যক্রম বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে শান্তি প্রচার, মানবাধিকার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবিক উন্নয়ন, হস্তশিল্প, শিক্ষা, ইত্যাদি। বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলে পাঁচটি জেলা জুড়ে এই ট্রাস্টের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বজরা শাহী মসজিদ

নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী থানায় বজরা নামক গ্রামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি স্থাপিত। অত্র মসজিদটি ১৮ শতকে স্থাপিত এবং নোয়াখালীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ। মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ ১৭৪১ সালে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু করেন, যা ১৭৪২ সালে সমাপ্ত হয়। পরবর্তীতে স্থানীয় জমিদার বাহাদুর আলী আহমেদ (১৯১১-১৯২৮) এর সময়কালে এই মসজিদের যাবতীয় মেরামত এবং সংস্কার করা হয়।

এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সুরক্ষিত স্থানগুলোর মধ্যে একটি। মসজিদের পূর্ব দিকে তিনটি দরজা রয়েছে এবং একটি অলংকৃত গেটওয়ে রয়েছে। মসজিদের পাশেই রয়েছে একটি বড় জলাশয় বা দিঘী। মসজিদে মোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে এবং চার কোণে চারটি অষ্টভূজাকার টাওয়ার রয়েছে। মসজিদের পূর্ব দিকের দরজার অনুকরনে উত্তর এবং দক্ষিণেও দুটি দরজা রয়েছে। মসজিদের বাইরে এলাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং প্রাচীর গুলোতে বিভিন্ন ধরনের অলংকরণ রয়েছে।

যাত্রা ও আবাসন

ঢাকা সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি নোয়াখালী পর্যন্ত এক্সপ্রেস বাস সার্ভিস রয়েছে। তাছাড়াও বিকেল ৪ টা ২০ মিনিটে ঢাকার কমলাপুর থেকে নোয়াখালী পর্যন্ত কমিউটার ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। কিন্তু এই ট্রেন বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে। বাসের ভাড়া ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে এবং ট্রেনের ভাড়া ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পড়বে। ভাড়াগুলো পরিবর্তন হয় মূলত এসি বা নন এসি সার্ভিসের উপর ভিত্তি করে। নোয়াখালীতে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি উন্নত মানের আবাসিক হোটেল বিদ্যমান। হোটেল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রয়েল হোটেল, সার্কিট হাউস, পুবালি হোটেল, আল মোরশেদ হোটেল, রাফসান হোটেল, নোয়াখালী গেস্ট হাউস, হোটেল লিটন, ইত্যাদি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button