রাজশাহী জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

রাজশাহী জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

রাজ অর্থ হল রাজকীয় এবং শাহী অর্থ হল আভিজাত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। অনেক পৌরাণিক শিল্প কর্ম ও রাজবাড়ী’র আশ্রয়দাতা হল রাজশাহী শহর। এই রচনাতে রাজশাহীর উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ এবং ভ্রমণ স্থানসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে।

বরেন্দ্র জাদুঘর

দক্ষিণ এশিয়া’র প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার একটি নিউক্লিয়াস হিসেবে বিবেচনা করতে গেলে, রাজশাহী’র বরেন্দ্র জাদুঘরকে প্রথম তিন এর মধ্যে স্থান দিতে হবে। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলার সাধারণভাবে এবং বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস-সংস্কৃতি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য উপরে বাংলার বিশিষ্ট জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বরেন্দ্র (বা বরেন্দ্র) হল বাংলাদেশের একটি অঞ্চল। তৎকালীন ভারতের বাংলা অংশে প্রথম রাজধানী স্থাপিত হয় পুন্ড্রবর্ধনে যা পুন্ড্র রাজ্য অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত ছিল। বরেন্দ্রের সীমানা ছিল পশ্চিমে গঙ্গা ও মহানন্দা, পূর্বে করতোয়া, দক্ষিণে পদ্মা এবং উত্তরে কোচবিহার ও তরাইয়ের মধ্যবর্তী ভূমি। এই অঞ্চল থেকে বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের উৎপত্তি।

জনকভু (পিতৃভূমি) নামে পরিচিত বরেন্দ্র বসতি ছিল প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল। নথী- পত্রও ও এপিগ্রাফিক এর প্রমাণ দেয় যে পাল রাজবংশের রাজত্বকালে কারিগরদের একটি পৃথক বিদ্যালয় এখানে তৈরি হয়েছিল এবং ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। সেন রাজবংশের বিলুপ্তি পর্যন্ত শিল্প- সামগ্রী তৈরির ধারা অব্যাহত ছিল। ‘দ্য বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি’ ১৯১০ সাল থেকে পৌরাণিক শিল্পসমূহ সংগ্রহের ধারা চালু করে।

রাজশাহীতে ১৯১০ সালে বরেন্দ্র জাদুঘর ও রিসার্চ সোসাইটি স্থাপিত হয়। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯১৪ সালের ভারতীয় সমাজ আইন অনুসারে নিবন্ধিত হয়েছিল। বরেন্দ্র জাদুঘর ছিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রতিষ্ঠিত প্রথম জাদুঘর। বরেন্দ্র একটি প্রাচীন জনপদকে বোঝায় যা আধুনিক উত্তর বাংলাদেশ’কে বুঝায়। সোমপুর বিহারে খননকার্য ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা চালু করা হয়েছিল। জাদুঘরটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে যুক্ত হয় ১৯৬৪ সালে।

পুঠিয়া রাজবাড়ী

পুঠিয়া রাজবাড়ী (পাঁচআনি জমিদারবাড়ী) হল মহারানী হেমন্তকুমারী দেবীর আদি বাসভবন। পুঠিয়া রাজবাড়ী বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম। মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী ১৮৯৫ সালে ইন্দো ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে আকর্ষনীয় এই দ্বিতল রাজবাড়ীটি নির্মাণ করেন। রাজশাহী জেলা সদর হতে উত্তর- পূর্বে নাটোর মহাসড়কে ৩২ কি.মি. দূরত্বে পুঠিয়া এলাকায় অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ী।

সপ্তদশ শতকে মুঘল আমলে প্রাচীনতম জমিদারি ছিল পুঠিয়া জমিদারি। নীলাম্বর মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা উপাধি লাভ করার পর এই রাজবাড়িটি পুঠিয়া রাজবাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৪৪ সালে পুঠিয়ার জমিদারি ভাগাভাগি হয়। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা টিকেছিল। এরপর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার সাথে সাথে পুঠিয়া রাজবাড়ির জমিদারীও বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারপর প্রায় আরও এক শতাব্দী কেটে গেলও, সেই আমলে নির্মিত মন্দির, প্রাসাদ এবং অন্যান্য স্থাপনাসমূহ এখনো টিকে আছে।

রাজবাড়ী’র সামনের ভাগের স্তম্ভ, কাঠের কাজ, অলংকরন, কক্ষের দেয়ালে ও দরজার উপর চিত্রকর্ম ও চমৎকার নির্মাণ শৈলীর পরিচয় দেয়। নিরাপত্তার স্বার্থে রাজবাড়ির চারপাশে পরিখা খনন করা হয়েছিল। রাজবাড়ী’কে ঘিরে ছয়টি বড় দিঘী আছে। প্রত্যেকটা দিঘীর আয়তন ছয় একর। রাজবাড়ী সংলগ্ন মন্দির রয়েছে ছয়টি। সবচেয়ে বড় শিব মন্দির ছাড়া বাকিগুলো হল জোড়াবাংলা মন্দির, গোপাল মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, দোলমঞ্চ, গোবিন্দ মন্দির ইত্যাদি।

প্রতিটি মন্দিরের দেয়ালেই অপূর্ব পোড়ামাটির ফলকের কারুকাজ দেখা যায়। এই স্থাপত্যশিল্পের সুচারুতা দেখতে বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শক’রা এখানে আসেন। তাছাড়া রাজবাড়ির ভিতরে রয়েছে বাংলো মন্দির এবং একটি আলাদা নির্মাণশৈলী রয়েছে যার নাম হচ্ছে পঞ্চরত্ন। এই স্থাপত্য’কে পঞ্চরত্ন বলার কারণ হচ্ছে এটি ৫ কোণাবিশিষ্ট একটি স্থাপত্যকর্ম। অনেকে বিশ্বাস করে যে এটিকে মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও রানীর স্নানের জন্য আলাদা পুকুর রয়েছে। অনেক বড়ই এই প্রাঙ্গণটিতে বনোভজন এবং শিক্ষা সফরে বছরজুড়ে আসেন বহু মানুষ।

বাঘা মসজিদ

১৫২৪ সালে শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নুসরাত শাহ দ্বারা এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হলেও মসজিদের গম্বুজ ভেঙ্গে পড়ায় ১৮৯৭ সালে মসজিদটি পুনঃনির্মাণ করা হয়। ২৫৫ বিঘা’র উপর অবস্থিত মসজিদটি সমতল ভূমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু। প্রধান ফটকের উত্তর পাশে স্তম্ভ ও খোদাইগুলো বিস্ময়কর। মসজিদের ভিতরে স্তম্ভ রয়েছে ৬টি। মসজিদটিতে দুর্দান্ত শিল্পকর্ম দিয়ে খোদাই করা 4টি খিলান রয়েছে।

বাঘা মসজিদটিতে 5টি প্রবেশপথ রয়েছে। মোট ১০ টি গম্বুজ, ৪ টি মিনার দ্বারা গঠিত মসজিদটি। মসজিদটি চারদিক দিয়ে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দুপাশে’র দেয়ালে দুটি করে মোট ৪ টিপ্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভিতরে ও বাইরে সর্বত্র টেরাকোটার নকশা আছে। এছাড়া মসজিদের বিশাল লেকটিও অনেকের পছন্দের স্থান। মসজিদ চত্বরের উত্তর পাশে শাহদৌলা ও তার পাঁচ সঙ্গীর মাজার রয়েছে।

নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ জনকল্যাণের জন্য মসজিদের সামনে ৫২ বিঘা জমির উপর একটি বড় আকারের দিঘি নির্মাণ করেন। এই দিঘি’র চারপাশে রয়েছে সারি সারি সাজানো নারিকেল গাছ। শীতকালে বহু অতিথি পাখি এখানে আসে এবং তাদের কিচিরমিচির শব্দ এলাকা কোলাহলপূর্ণ হয়ে থাকে। অনেক মানুষ- জন শীতকালে পাখি দেখতেও এখানে আসেন। মসজিদের উত্তর পাশে খাটি পীরের মাজার রয়েছে। বাঘা মসজিদের বাইরে ও ভেতরে রয়েছে স্তম্ভ ও খিলান। এছাড়াও অসংখ্য পোড়ামাটির শিল্পকর্ম রয়েছে।

বর্তমানে হ্রদের চারপাশ পাকা করা হয়েছে। তাছাড়াও মসজিদের পাশে আবিষ্কৃত হয়েছে মহল পুকুর, যা মাটির নিচে পাওয়া গেছে। এই পুকুরের দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট ও প্রস্থ ২০ ফুট এবং একটি অভ্যন্তরীণ সুরঙ্গ দ্বারা প্রাসাদের সাথে সংযুক্ত। মসজিদের আশপাশে রয়েছে অনেক পোড়ামাটির ফলক। মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোনাতে রয়েছে একটি বিশেষ প্রার্থনা কক্ষ। ৫০০ বছরের পুরাতন ঐতিহ্য’কে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের সময় তিনদিন ব্যাপী “বাঘা’র মেলা আয়োজন করা হয়।

শহীদ স্মৃতি জাদুঘর

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল চত্বরের পাশে অবস্থিত শহীদ স্মৃতি জাদুঘর। এই জাদুঘরটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে। এই জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নবীন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে ১৯৭৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার কমপ্লেক্সে’র পাশে জাদুঘরটির নির্মাণ করা হয়। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী জাদুঘরে আসেন।

৬,৬০০ বর্গফুট স্থান নিয়ে নির্মিত চমৎকার স্থাপত্য শিল্পে’র উদাহরণস্বরূপ, শহীদ স্মৃতি জাদুঘরটি তিনটি গ্যালারিতে বিভক্ত। ১৯৫০ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন শিল্পকর্ম গ্যালারিতে প্রদর্শিত রয়েছে। গ্যালারিতে রয়েছে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের বিভিন্ন ছবি, রাজশাহীর প্রথম শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন আলোকচিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত পোশাক, শিল্পীদের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, প্রতিকৃতি এবং আরও অসংখ্য দুর্লভ সংগ্রহ।

রাজশাহী চিড়িয়াখানা

রাজশাহী কেন্দ্রীয় পার্ক এবং চিড়িয়াখানা প্রায় 33 একর জমির উপর নির্মিত এটি শহরের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সুবিধাজনক। চিড়িয়াখানাটি ১৯৭২ সালে নির্মিত হলেও এর সাথে শিশুপার্ক সংযুক্ত করা হয় ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে।

চিড়িয়াখানার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ গুলোর মধ্যে রয়েছে হরিণ, কুমি্‌ বানর, বলিহার, পেলিকেন, বাঘ, ভাল্লুক, গাধা, অজগর সাপ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং আরো অনেক স্থলজ ও জলজ প্রাণী। তাছাড়াও চিড়িয়াখানার মধ্যে তৈরি করা হয়েছে একটি কৃত্রিম হ্রদ। স্পিডবোটের সাহায্য এই হ্রদ ভ্রমন এর পাসাপাশি পুরো চিড়িয়াখানা খুব সহজে ঘুরে আসা যায়।

তাছাড়া বাচ্চাদের খেলার জন্য রয়েছে নাগরদোলা, প্যাডেল বোট, বিভিন্ন রাইড, মিনি গলফ কোর্স, ইত্যাদি।
দীর্ঘ সময় ধরে এই শিশু পার্কটি রাজশাহী শহরের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। রাজশাহী’র স্থানীয় দর্শনার্থী ছাড়াও, বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও পর্যটকরা প্রতিদিন শিক্ষা সফর এবং বনভোজনের জন্য এখানে আসেন।

তাছাড়াও রাজশাহীতে এসে দেখতে পারেন পদ্মা নদী, টি বাঁধ, আই- বাঁধ, শহীদ জিয়া শিশু পার্ক, সাফিনা পার্ক এবং রাজশাহী শহরের শান্ত প্রকৃতি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*