রংপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

Rate this post

বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের কেন্দ্রীয় এবং প্রধান শহরের নাম হল রংপুর। আয়তনে ছোট একটি শহর হলেও রংপুরে অনেকগুলো আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান রয়েছে। তার মধ্যে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, জমিদার বাড়ি, ঐতিহাসিক ভবন এবং গঙ্গা নদীর সৌন্দর্য উল্লেখযোগ্য। যদি আপনি দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেতে চান তাহলে রংপুর হতে পারে আপনার ছুটির দিনে উপযুক্ত ভ্রমণস্থল।

১৭৬৯ সালে রংপুর জেলা সদর হিসেবে ঘোষণা করা হয়, পরবর্তীতে ১৮৬৯ সালে শহরটি পৌরসভা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। উল্লেখ্য যে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় এই স্থানে প্রচুর নীল চাষ করা হতো যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল রঙ্গো হিসেবে; সেখান থেকে জেলাটির নাম হয় রংপুর। আপনি রংপুর যেতে চাইলে যেসব দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসতে পারেন সেসব স্থানসমূহের বিবরণ এই পোস্টে তুলে ধরা হলো।

তাজহাট রাজবাড়ী

মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হল তাজহাট রাজবাড়ী, যা রংপুর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণ- পূর্বে তাজহাট নামক এলাকায় অবস্থিত। বর্তমানে প্রাসাদের ভেতরে একটি জাদুঘর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে খাজা আহসানুল্লাহ নামক একজন প্রভাবশালী জমিদার দ্বারা তাজহাট জমিদার বাড়ি নির্মিত হয়েছিল। জানা যায় যে, জমিদারের মুকুটটি ছিল রত্নখচিত, যার জন্য তার মুকুট কে তাজ হিসেবে গণ্য করা হতো; যা থেকে তাজহাট নামটি এসেছে। প্রাসাদটি হল একটি দ্বিতল ভবন এবং ছোট টিলার উপর নির্মিত।

মূলত ইট এবং কাঠ দ্বারা এই প্রাসাদটি নির্মিত। প্রাসাদের দেওয়ালে দেখতে পাওয়া যায় পোড়ামাটির কারুকাজ এবং বিস্তীর্ণভাবে অঙ্কিত খোদাই। প্রাসাদের সম্মুখ কেন্দ্রে সাদা মার্বেল পাথর দ্বারা তৈরি প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে মূল জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। দুই তলা মিলে এখানে সর্বমোট ২২ টি কক্ষ রয়েছে। ১৮৮৪ থেকে ১৮৯১ সাল পর্যন্ত রাজবাড়ীটি রংপুর হাইকোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

২০০৫ সালে এর দ্বিতীয় তলা সাধারণ জনগণের জন্য মিউজিয়াম হিসেবে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বর্তমানে মিউজিয়ামে রয়েছে কুরআনের প্রতিলিপি, রামায়ণ, মহাভারত, আরবি রচনা, অনুলিপি এবং অন্যান্য গ্রন্থসমূহ। গ্রন্থের পাশাপাশি রয়েছে জাদুঘরে রয়েছে পোড়ামাটির ফলক, খোদাইয়ের কাজ এবং কিছু হিন্দু দেবতার মূর্তি। তবে জাদুঘরটিতে ছবি তোলা নিষেধ।

রংপুর চিড়িয়াখানা

উত্তর বঙ্গের বৃহত্তম চিড়িয়াখানা হল রংপুর চিড়িয়াখানা। এটি একই সাথে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, পিকনিক স্পট এবং চিড়িয়াখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রংপুরের পুলিশ লাইন রোডে, হনুমান টোলা সড়কের পূর্বদিকে চিড়িয়াখানার অবস্থান। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে পার্কটিতে উপস্থিত প্রাণীসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কুমির, সিংহ, জলহস্তী, ময়ূর, ভাল্লুক, ঘোড়া, শকুন, বলগা হরিণ, তোতা পাখি, টার্কি এবং আরো অন্যান্য পাখি। তাছাড়াও চিড়িয়াখানায় রয়েছে একটি রেস্তোরাঁ, একটি পার্ক, বিভিন্ন স্থানীয় গাছপালা এবং একটি লেক। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) রংপুর চিড়িয়াখানার উন্নয়ন সম্ভাবনা’র উপরে সমীক্ষা চালাচ্ছে যাতে একে একটি আন্তর্জাতিক মানের চিড়িয়াখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

চিকলি পার্ক

এই পার্কের প্রধান আকর্ষণ হলো, এর বাহারি রং এবং বিভিন্ন রঙের আলো দিয়ে সজ্জিত কৃত্রিম ঝর্ণা। রাতের বেলায় এই ঝর্ণাটি দেখতে আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে এবং তরুণ প্রজন্মের দর্শকরা ছবি তুলতে মগ্ন থাকে। ঝরনার পাশের ছোট পুকুরে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের মাছ রয়েছে। তাছাড়াও পার্কে রয়েছে একটি রেস্তোরাঁ, যাতে আপনি আপনার পছন্দের খাবারসমূহ পেয়ে যাবেন। পার্কে প্রবেশের মূল্য ১০০ টাকা। এই পার্কের আরেকটি আকর্ষণীয় স্পট হল বৈদ্যুতিক ক্যারোজেল, যেখান থেকে সমগ্র রংপুর শহর দেখা যায়। রংপুর শহর থেকে অদূরে হনুমান টোলা রোডের পাশে পার্কটি অবস্থিত।

ভিন্ন জগত পার্ক

রংপুরের একটি বৃহৎ পাবলিক পার্ক হচ্ছে ভিন্ন জগত পার্ক। প্রায় ১.৫ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই পার্কটি রংপুর ভ্রমণকারীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থল। পার্কটিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য, ফোয়ারা, পিকনিক এলাকা, জগিং ট্রেইল, খেলার মাঠ, লেক এবং গাছগাছালিতে ঢাকা হাঁটার জায়গা। লেকটিতে রয়েছে বিভিন্ন রকমের জলজ উদ্ভিদ এবং মাছ। প্রচুর পর্যটক সমাগম এর কারণে পার্কে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

চিকলি ওয়াটার পার্ক

রংপুরের হনুমান টোলা রোডে চিকলি পার্ক এর নিকটেই অবস্থিত চিকলি ওয়াটার পার্ক। এই পার্কে প্রবেশের জন্য আলাদাভাবে আপনাকে ১০০ টাকা মূল্যমানের টিকিট কাটতে হবে। এই ওয়াটার পার্কে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওয়াটার রাইড। তার মধ্যে যেমন জেট স্কি চালানোর জন্য টিকেটের মূল্য ৩০০ টাকা, প্যাডেল বোট চালানোর জন্য প্রতি ১৫ মিনিটে আপনাকে দিতে হবে ১০০ টাকা, তাছাড়া বিভিন্ন সময়ের ভিত্তিতে আপনি স্পিড বোট ভাড়া নিতে পারেন। ওয়াটার পার্কের ভিতরে রয়েছে একটি আকর্ষণীয় রেস্তোরাঁ, যা থেকে আপনি খাবার নিয়ে পার্কের ভিতর অথবা ভাসমান টেবিলে বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে খাবার খেতে পারবেন। তবে সব মিলিয়ে পার্কটি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল।

ইটাকুমারী জমিদার বাড়ি

১৭৮৩ সালে ঐতিহাসিক প্রজা বিদ্রোহের মূল নায়ক ইটাকুমারী রাজা রঘুনাথ রায় পীরগাছা উপজেলায় এই জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখিত সময়ে এই এলাকাটি শিক্ষা এবং সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল। যথেষ্ট সংস্করণ এবং সংরক্ষণের অভাবে জমিদার বাড়িটি প্রায় ধবংসের পথে। তাছাড়াও জমিদার বাড়ির অনেক মূল্যবান সামগ্রী চুরি হয়ে গেছে। বর্তমানে স্থানটি তার বেশিরভাগ জৌলুসই হারিয়ে ফেলেছে।

মিঠাপুকুর বড় মসজিদ

১৬০৭ সালে মুঘল সুবেদার খন্দকার আবদুর রহমান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় এই বৃহদাকার মসজিদটি নির্মাণ করেন। এই মসজিদে রয়েছে পাঁচটি গম্বুজ এবং চারটি মিনার। মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে ইট এবং পাথর দিয়ে। মসজিদের সামনের অংশ ওযু করার জন্য একটি চৌবাচ্চা বসানো রয়েছে। তাছাড়াও মসজিদের সামনের অংশে রয়েছে বিশাল ময়দান। মসজিদের অভ্যন্তরীণ দেয়াল সুন্দর ক্যালিগ্রাফি দ্বারা সুসজ্জিত। অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা এখানে তীর্থযাত্রায় আসেন এবং রংপুরের মানুষের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উপাসনালয়।

কেল্লাবন্দ মসজিদ

খ্রিস্টীয়.১৬ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আকবর এই মসজিদের নির্মাণ করেন। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানে একসাথে ৫ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। মূল উপাসনালয় ছাড়াও মসজিদে বেশ কয়েকটি ছোট প্রার্থনা কক্ষ এবং মাঝারি মানের একটি ময়দান রয়েছে। কেল্লাবন্দ মসজিদ রংপুর শহরের সদর পাড়া রোডে অবস্থিত।

চিকলি ভাটা

চিকলি নদীতে বাঁধ স্থাপনের ফলে পনেরশো হেক্টর এলাকাজুড়ে একটি কৃত্রিম লেক তৈরি হয়। এই লেকের নাম হল চি্কলি ভাটা। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে মাছ ধরা এবং বোটিং এর জন্য অনেক মানুষ এখানে ভিড় জমান।

সেনা প্রয়াস বিনোদন পার্ক

শহরের ব্যস্ত জীবন যখন কর্মজীবী মানুষের জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে, তখন প্রকৃতি এর সমাধান দিতে সক্ষম। সেই প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে এবং নির্মল পরিবেশে ক্লান্তি দূর করার জন্য মানুষজন সেনা প্রয়াস বিনোদন পার্কে বেড়াতে যান। রংপুর শহরের অদূরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত রক্ত গৌরব চত্বরে ঘাঘট নদীর দুপাশে নিসবেতগঞ্জ নামক এলাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে মনোরম এই পার্কটি।

পার্কের প্রবেশ পথে রয়েছে একটি বিশাল ডাইনোসরের প্রতিমূর্তি এবং অদূরে রয়েছে নৌকার সারি ও কাশবন। সমগ্র এলাকাটির বিস্তৃতি প্রায় এগারশ একর এবং ভিতরে রয়েছে কৃত্তিম ভাবে সাজানো লতাগুল্মের বাগান। রংপুর ভ্রমণ করতে গেলে অপরূপ এই স্থানটি ঘুরে আসতে ভুলবেন না।

মন্থনা জমিদার বাড়ি

১৯ তম শতাব্দীর শুরুর দিকে জমিদার মন্থনা এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। এটি একটি দুই তলা বিশিষ্ট ভবন এবং এর ভেতরের অংশে টেরাকোটা এবং পোড়ামাটির কারুকাজ রয়েছে। প্রাসাদের সামনে একটি নির্মল ফোয়ারা এবং কেন্দ্রীয় উদ্যান রয়েছে। জমিদার বাড়িটির উভয় তলায় চারটি করে কক্ষ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।

রংপুর পৌঁছানোর জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি বাস এবং ট্রেন সার্ভিস রয়েছে। রংপুরে অবস্থানের জন্য ভালো হোটেল গুলোর মধ্যে রয়েছে লিটল রংপুর ইন, কাশপিয়া, হোটেল নর্থ ভিউ, গ্র্যান্ড প্যালেস হোটেল, রায়ান হোটেল, খান হোটেল এবং হোটেল কেটিএস।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button