চাঁদপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

চাঁদপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা হচ্ছে চাঁদপুর। ব্রিটিশ উপনিবেশিক  শাসনকালে ১৮৭৮ সালে সমগ্র ভারত উপমহাদেশকে পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠন চলাকালীন সময় চাঁদপুরকে মহকুমা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৮৯৬ সালের পহেলা অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটি পৌরসভা হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, চাঁদপুর বাংলাদেশের প্রশাসনিক জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। আপনার চাঁদপুর ভ্রমণের সুবিধার্থে, এখানকার পর্যটন স্পটগুলো এবং পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনাসমূহ সম্পর্ক এই পোস্টে আলোচনা করা হলো।

হযরত শাহ রাস্তির মাজার

১২৩৮ সালে ইরাকের বাগদাদে রাস্তি শাহ জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্মের একজন বিখ্যাত সংস্কারক এবং প্রচারক হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর বংশধর ছিলেন রাস্তি শাহ। সুলতানি শাসনামলে বাংলাদেশের ১২ জন আউলিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, যারা ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এই উপমহাদেশে এসেছিলেন। রাস্তি শাহ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। রাস্তি শাহ তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার কারণে পরিচিত ছিলেন। লোকমুখে শোনা যায় যে, এই মাজারের উত্তর পাশে যে বড় হ্রদটি রয়েছে তা রাস্তি শাহ তার অধীনস্থ জিনদের সাহায্যে মাত্র এক রাতের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন। তার অন্যান্য অলৌকিক ঘটনার সাথেও মানুষের পরিচিত রয়েছে।

রাস্তি শাহ এর ধর্মপ্রচারকালীন সময় ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে ৬৪ একর জমির ব্যবস্থা করেছিল এবং বার্ষিক ভাতা প্রদান করতো। তার মাজারের কাছে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল যা তিন গম্বুজবিশিষ্ট ছিল। ১৩৮৮ সালের রাস্তি শাহ মারা যান। তার মৃত্যুর প্রায় ৩৫০ বছর পর বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানের কন্যা পরী বিবি তার স্মরণে ও  সম্মানার্থে এই মাজার প্রতিষ্ঠা করেন।

লোহাগড়া মঠ

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার চন্দ্র বাজার নামক স্থানে লোহাগড় মঠ অবস্থিত যা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। এটি প্রায় দুইশ বছরের পুরাতন একটি মঠ, যার সামগ্রিক এলাকার মধ্যে তিনটি উপাসনালয় রয়েছে। প্রাসাদের অভ্যন্তরের ভূগর্ভস্থ গুহাও উদ্ধার করা হয়েছে। এই  মঠের দেয়ালে শৈল্পিক কারুকার্য খচিত রয়েছে যা খুবই বিরল।

তৎকালীন সময় অত্র এলাকার জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী ছিলেন লোহার এবং গহরা নামক দুই ভাই। তারা এই মঠের স্থাপনা করেন। মঠটি নির্মিত হয়েছে ধোদিয়া নদীর তীরে এবং এর নামকরণ হয়েছে সেই দুই ভাইয়ের নামানুসারে। ব্রিটিশ শাসনামলে এই জমিদার বংশের বিভিন্ন অত্যাচার এবং নির্যাতনের নীরব সাক্ষী হয়ে লোহাগড় মঠ। লোকমুখে শোনা যায় যে, জমিদার তার আর্থিক সক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এই মঠের শীর্ষে ১০০ কেজি ওজনের সোনার বার যুক্ত করেছিলেন। স্থানীয়  অনেক লোকজন এই সোনার খন্ড চুরি করার উদ্দেশ্যে মঠের চূড়াতে উঠতে যায় এবং দুর্ঘটনাকবলিত হয় মারা যায়। পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে,   মঠের চূড়া থেকে এটি বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীগর্ভে তলিয়ে যায়।

অঙ্গীকার ভাস্কর্য

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে এবং সম্মানার্থে চাঁদপুর জেলা সদরে মুক্তিযোদ্ধা রোডের নিকটবর্তী লেকের উপরে অঙ্গীকার ভাস্কর্য স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের প্রত্যক্ষ প্রচেষ্টায় দৃষ্টিনন্দন এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থপতি সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ এই ভাস্কর্যের নির্মাতা ছিলেন। তিনি একই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটিও নির্মাণ করেছিলেন।

এটি একটি প্লেজ ভাস্কর্য যা প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। এই ভাস্কর্যের শীর্ষের মুষ্টিবদ্ধ হস্ত, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও সংকল্পের প্রতীক। অন্য হাতে থাকা অস্ত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংরক্ষিত শক্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলোতে অঙ্গীকার ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পিত হয়। তাছাড়াও সারা দেশ থেকে আগত অসংখ্য দর্শনার্থী বিকেলের পর থেকে এখানে জমা হয় এবং কিছু আনন্দময় সময় কাটান।

বড় স্টেশন

চাঁদপুরের একটি ল্যান্ডমার্ক হচ্ছে বড় স্টেশন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী বড় স্টেশন এলাকায় অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি রক্ষার্থে এবং সম্মান প্রদর্শনে এখানে রক্তধারা নামক একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। বড় স্টেশন এলাকায় পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নামক তিনটি বড় নদী একত্রে মিলিত হয়। এই মোহনাকে অনেকে মোলহেড বলে। এই মোহনায় ছোট ছোট নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। নদীর স্রোতগুলো একত্রে মিলিত হয়ে একটি অপূর্ব সুন্দর কলতানের সৃষ্টি করে।

প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে এই কলতান, মানব স্মৃতিতে দীর্ঘকাল স্মরনীয় হয়ে থাকে। সাধারণ নৌকা ছাড়াও স্পিডবোট, ট্রলার এবং ডিঙ্গি ভাড়া করে, এই  জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বড় স্টেশনের নিকটে ইলিশ মাছের পাইকারি বাজার রয়েছে যার নাম “মাছের ঘাট”। এখানে প্রচুর পরিমানে মাছ আসে এবং আপনি চাইলে তাজা ইলিশের স্বাদ নিতে পারবেন ও পরিবারবর্গের জন্য নিয়ে যেতে পারবেন।

হাজিগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ

হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ গুলোর একটি। ১৩৩৭ সালে হাজী আহমদ আলী পাটোয়ারী এই ঐতিহাসিক মসজিদটি স্থাপন করেন। মসজিদটির আয়তন প্রায় ৩০ হাজার বর্গফুট। এই মসজিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে একসাথে প্রায় ১০ হাজার ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রার্থনা করতে পারেন বা নামাজ পড়তে পারেন। এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম মসজিদ এবং এটিতে প্রায় ১৯০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট নান্দনিক একটি মিনার রয়েছে। মসজিদটি তার ঐতিহ্য ধরে রয়েছে ১১ শতাব্দীর শুরু থেকে, যখন এটি শুধুমাত্র একটি খড়ে তৈরি একটি সাধারন উপাসনালয় ছিল।

কালের প্রবর্তনে মসজিদটি ক্রমান্বয়ে বড় হয় এবং ১৩৪৪ সালের ১০ অগ্রহায়ণ মসজিদটি পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য লাভ করে। মসজিদটি স্থাপন করা হয় মার্বেল পাথরের সমন্বয়ে। ঐতিহাসিক এই মসজিদে জুমার নামাজে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. এম. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নবাব মোশাররফ হোসেন, নবাবজাদা খাজা নাসরুল্লাহ সহ আরো অনেকে।

রূপসা জমিদার বাড়ি

আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় তৎকালীন রাজা আহমদ গাজী অত্র এলাকার জমিদারিত্ব লাভ করেন এবং তার বাসস্থান হিসেবে রূপসা জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে রাজা আহমদের পুত্র, মোহাম্মদ গাজী এই জমিদার বাড়ির উত্তরাধিকারী হিসেবে মালিকানা পান। এই জমিদারবাড়িতে তিনটি আলাদা আলাদা ভবন রয়েছে। ভবনগুলো ছাড়াও এখানে রয়েছে মসজিদ, পুকুর, কবরস্থান, টিনের ঘর এবং বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। জমিদার আহমদ গাজী নিকটবর্তী এলাকায় বেশ কয়েকটি মসজিদ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেছিলেন। আশেপাশের এলাকায় তিনি প্রখ্যাত সমাজসেবক এবং দানবীর হিসেবে  সম্মানিত ছিলেন।

ত্রিমোহনা থিম পার্ক

এই আধুনিক থিম পার্কটি  চাঁদপুর- কুমিল্লা হাইওয়ের নিকটে অবস্থিত। পরিবার নিয়ে ভ্রমন করার জন্য এটি একটি উপযুক্ত স্থান। এখানকার প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা। পার্কের ভিতরে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশ কয়েকটি রাইড রয়েছে, যার জন্য আপনাকে আলাদাভাবে টিকিট কাটতে হবে। পার্কের ভিতরে রয়েছে খাবার রেস্তোরাঁ, কিন্তু এই রেস্তোরাঁর খাবারের মূল্য তুলনামূলকভাবে বেশি। সেজন্য আপনি সাথে খাবার প্যাক করে নিয়ে যেতে পারেন। পার্কটিতে কৃত্রিম আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেজন্য রাতের বেলা পার্কটি আরো সুন্দর ও আলো ঝলমলে হয়ে ওঠে।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাওয়ার সবচাইতে জনপ্রিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে লঞ্চ। মাত্র আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে লঞ্চে চাঁদপুর যাওয়া যায়। তাছাড়া আপনি চাইলে প্রায় সমান সময়ে বাসে চাঁদপুর যেতে পারবেন। আর আপনি যদি অগ্রিম যাত্রা পরিকল্পনা করতে পারেন, তাহলে ট্রেনে ভ্রমণ করতে পারেন। কারণ অগ্রিম টিকেট না কাটলে, যাত্রা মুহূর্তে ট্রেনের টিকেট পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

চাঁদপুরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি আধুনিক মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হোটেল গ্র্যান্ড হিলসা, তাজ হোটেল, রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, ওয়েস্টার্ন রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, হোটেল প্রিন্স, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*