
বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শহর হল যশোর। ১৭৮১ সালে প্রথমবারের মতো এলাকাটি জেলার মর্যাদা পায়। পুরাতাত্ত্বিক কাহিনী অনুসারে, গৌর শাসনামলে রাজা প্রতাপ আদিত্যের পিতা বিক্রম আদিত্য আরাজকতার মাধ্যমে অনেক সম্পদ জড়ো করে নৌপথে এই বন ঘেরা অঞ্চলে প্রেরণ করেন।
গৌড়ের যশ হরণের মাধ্যমে এলাকাটি খ্যাতি পায় ও বিস্তৃতি লাভ করে বলে, এর নাম রাখা হয় যশোহর। কালের পরিক্রমায় যশোহর নামের অপভ্রংশ রুপান্তর করে যশোর নামটি আসে। যশোর শহরের পর্যটন ও পুরাতাত্ত্বিক স্থানসমূহের সংকলন করে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো যা আপনাকে যশোর ভ্রমণে সাহায্য করবে এবং দিকনির্দেশনা দিবে বলে আশা করছি।
মধুপল্লী (মাইকেল মধূসূদন দত্তের আবাস)
যশোরের সাগরদাড়ি উপজেলায় কপোতাক্ষ নদের তীরে কেশবপুর নামক স্থানে অবস্থিত মধুপল্লী, যা অনেকের কাছে মাইকেল মধূসূদন দত্তের আবাস বলে পরিচিত। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন আধুনিক কবি এবং বাংলা ভাষায় সনেট কাব্যধারার প্রথম রচয়িতা। তার বাড়িটি নির্মিত হয় ১৯৬৫ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এর ব্যাপক সংস্করণ করা হয়।
বর্তমানে এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি অংশ এবং এটি জনসাধারণের জন্য মিউজিয়াম বা জাদুঘর হিসেবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। এটি দুই তলা একটি ভবন যার প্রত্যেকটি তলায় তিনটি করে কক্ষ রয়েছে। জানা যায় যে, বাড়ির নিচ তলা মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে নিচতলায় স্থাপন করা হয়েছে একটি পাঠাগার এবং কবির নিজের হাতে লিখা কবিতা এবং অন্যান্য দস্তাবেজ। বাড়ির সামনে রয়েছে উঠান এবং সবুজে ঘেরা পুকুর। বাড়ির এক কোণে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে কবির একটি ভাস্কর্য। বর্তমানে কবির বাসভবনের সাথে স্থাপিত হয়েছে একটি ছোট অডিটরিয়াম।
চাঁচড়া শিব মন্দির
৩২২ বছরের পুরাতন এই মন্দির যশোর সদরের নিকটবর্তী চাঁচড়া গ্রামে অবস্থিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয় এবং একই সাথে ইউনেস্কোর প্রত্নতাত্ত্বিক কোড অনুসারে সংস্কার করা পুরাকীর্তি এই মন্দির। এই শিব মন্দীরের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী মনোহর রায়, যিনি বাংলার মহান শাসকগোষ্ঠী বারো ভূঁইয়াদের একজন ছিলেন। গৌড় রাজা প্রতাপ আদিত্যকে যুদ্ধে হারানোর পর তিনি রাজা উপাধি নিয়ে অত্র অঞ্চলে শাসনকার্য শুরু করেন। তার রাজা হিসেবে অভিষেক করার জন্য এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
মন্দিরটি দ্বিতল বিশিষ্ট এবং মন্দিরের চারটি দেয়ালের মধ্যে তিনটি দেয়াল কারুকার্য দিয়ে পূর্ণ। মন্দিরের ভিতরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা শিবের একটি বড় মূর্তি রয়েছে। মন্দিওে তিনটি খিলান উপস্থিত এবং বাইরের অংশের নান্দনিকতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়েছে কারুকার্যময় পোড়ামাটির অলঙ্করণ। মন্দিরের চারপাশে উন্মুক্ত স্থান রয়েছে এবং এলাকাটি সুরক্ষা বেষ্টনী দ্বারা ঘেরা। প্রত্যেক পূর্ণিমা এবং অমাবস্যার সময় এখানে পুজা- অর্চনা অনুষ্ঠিত হয় এবং অনেক শিব ভক্ত তাদের দেবতাকে সম্মান জানাতে এখানে আসেন। মন্দিরের নিকটে রাজার একটি পরিত্যক্ত বাসভবন ছিল বলে জানা যায় কিন্তু এখন তা সম্পূর্ণরুপে বিলুপ্ত।
জেস গার্ডেন পার্ক
যশোর শহরের অদূরে বাহাদুরপুর নামক গ্রামে বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত হচ্ছে জেস গার্ডেন পার্ক। ১৯৯২ সালে এ. এস. হাবিবুল হক চুনি এই পার্কের প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি আধুনিক মানের পার্ক এবং দূর- দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে প্রতিদিন বেড়াতে আসেন। পার্কেও ফটক পেরোতেই রয়েছে কৃত্রিম জলাশয় যেখানে পদ্মফুল ফুটে রয়েছে। জলাশয়ের মাঝামাঝি রয়েছে কয়েকটি কৃত্রিম ভাস্কর্য। এর পর দেখা যায় কিছু খেলনা হাঁস তার উপর একটি পরিবারকে নিয়ে ভ্রমণ করাচ্ছে যা মূলত গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার একটি চেষ্টা।
পার্কে রয়েছে বেশ কিছু রাইড যা বাচ্চাদের জন্য প্রধান আকর্ষণ। প্রত্যেক রাইডের জন্য আলাদা আলাদাভাবে টিকেট কাটতে হয়। তবে আপনি যদি সবগুলো রাইডে চড়তে না পারেন, তাহলে কাউন্টারে টিকেট ফেরত দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। রাইডগুলোর মধ্যে রয়েছে ঘোড়ার চড়কি, নাগরদোলা, ছোটদের ট্রেন, নাগরদোলা ইত্যাদি।
পার্কের বিভন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য যেগুলোতে ছোট বাচ্চারা চড়ে আনন্দ পায় এবং এগুলোতে তারা বিনামূল্যে চড়তে পারে। পার্কের পূর্ব কোণে রয়েছে একটি ছোট চিড়িয়াখানা যাতে রয়েছে বাঘ, হরিণ, ভাল্লুক, ময়ুর, খরগোশ, কুমির, অজগর ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। আপনি চাইলে পুকুওে প্যাডেল বোটিং ও করতে পারেন।
বিনোদিয়া পার্ক
যশোর শহরতলী থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে যশোর সেনানিবাসে’র অভ্যন্তরীণ শানতলা নামক স্থানে অবস্থিত এই পার্কটি। লে: কর্ণেল ফয়েজ আহমেদ এই পার্কটি স্থাপন করেন ১৯৯৮ সালে যা এখনো যশোরের অন্যতম প্রধান বিনোদন গন্তব্যস্থল। পার্কটির ভিতর একটি ছোট চিড়িয়াখানাও স্থাপন করা হয় এবং সাধারণ মানুষের জন্য এই পার্ক উন্মুক্ত। পার্কটিতে আরও রয়েছে কৃত্তিম ঝর্ণা, পিকনিক স্পট, দুটি খাবার রেস্তোরা, শিশুদের জন্য ম্যনুয়াল রাইড, রবীনহুডের ঘর ইত্যাদি।
সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকে এবং মজার বিষয় হচ্ছে যে কোনো বন্ধের দিন নেই। পার্কে প্রবেশের মূল্য যৎসামান্য এবং পিকনিক আয়োজনের খরচও নগণ্য। বেসামরিক প্রপ্তবয়স্কদের জন্য টিকিট ফি হচ্ছে ২০ টাকা এবং শিশু ও সামরিক বাহিনীর সাথে সম্পর্কযুক্তদের জন্য ফি মাত্র ১০ টাকা। তাছাড়া পিকনিকের জন্য স্পট বুকিং ফি এক হাজার টাকা থেকে শুরু।
এই পার্কে অনেক বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় যেমন, বৈশাখী মেলা, ঈদ পুনর্মিলনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, ইত্যাদি। আপনি চাইলে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজনও করতে পারেন এখানে যেমন, জন্মদিন, গায়ে হলুদ, বিয়ে, অন্নপ্রাসন ইত্যাদি। বিশেষ আপ্যায়নের জন্য রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম যেখানে ৫০ থেকে ৬০ জনের জন্য আয়োজন করা সম্ভব।
বুকভরা বাওড়
যশোর সেনানিবাসের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত বুকভরা বাওড় যা প্রায় ৩৫২ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। যশোর সদর উপজেলার পাঁচটি গ্রাম দিয়ে ঘের এই বাওড়টি বা হ্রদটি একটি ছোট খাল দ্বারা কপোতাক্ষ নদের সাথে সংযুক্ত। এই খালটি প্রায় ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট এবং এটি কাটাখাল নামে পরিচিত। জলাশয়টিকে ঘিরে অবস্থিত গ্রামগুলো হল আরিচপুর, হালসা, চান্দুটিয়া, ইছাপুর এবং মঠবাড়ি।
এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য যা মানুষকে কাছে টানে তা হল এর অদ্ভুত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য। বিপুল জনসমাগমের ভিড় জমে এখানে যা প্রায় সারা বছর দেখা যায় এবং এখানে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়, যা বিনোদনপ্রিয় মাছ শিকারীদের কাছে অনেক আনন্দের বিষয়। তাছাড়াও অন্যান্য বিনোদনমূলক কর্মকান্ডসমূহের মধ্যে রয়েছে হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটা, ক্যানোয়িং, বোটিং এবং শীতকালে অতিথি পাখি দর্শন।
এই বাওড়টি’র অবস্থান সেনানিবাসের নিকটে বলে, এখানে ৫৫ তম পদাতিক ডিভিশনের শীতকালীন মহড়া ও অনুশীলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এখানকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে জুনিয়র অফিসারদেরকে কমিশনও দিয়েছেন।
যশোর পৌর পার্ক
যশোরের এই পার্কটি প্রায় দেড়শ বছরের পুরাতন। এখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে স্থাপিত শহীদ মসিউর রহমান এর স্মৃতি ফলক। পার্কের ভিতরে রয়েছে দুটি বৃহদাকার পুকুর যা একজন সাঁতার কেটে অন্য পাশে পৌঁছাতে পারে না। এই পুকুর থেকে অনেকে ছিপ ফেলে বড় বড় মাছ আহরণ করে যা স্থানীয় খবরের কাগজের অংশ হয়ে ওঠে। তবে পুকুরে মাছ ধরতে হলে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়।
পুকুর দুইটি ঘিরে রয়েছে বড় বড় নারিকেল গাছ। পার্কে রয়েছে একটি ছাদ দিয়ে ঢাকা সেতু। অনেকে সেখানে বসে সময় কাটায়। প্রতি বছর বৈশাখে শহরের মূল অনুষ্ঠান এখানে অনুষ্ঠিত হয়। দু:খের বিষয় হচ্ছে যে, সন্ধ্যার পর পার্কটি নিরাপদ নয়। আঁধার প্রহরে পার্কটি হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের আড্ডার স্থান। সেজন্য এখানে কয়েকজন একসাথে বেড়াতে যাবার পরামর্শ রইল। তবে উপযুক্ত সংস্কার করা হলে এটি যশোর শহরের পর্যটনের অন্যতম মূল কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
যশোরে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল এবং রেস্টহাউসগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল ও হোটেল সিটি প্লাজা। তবে আপনি যদি উন্নতমানের আতিথেয়তা চান তাহলে আপনার জন্য খুলনাতে থাকাই ভালো হবে কারণ সেখানে ৩ তারকা এবং চার তারকাবিশিষ্ট হোটেল ও আন্তর্জাতিক মানের সেবা রয়েছে। যশোর পৌঁছানোর জন্য আপনি ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেন এর মাধ্যমে যাত্রা করতে পারেন।
Leave a Reply