খাগড়াছড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

খাগড়াছড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

১৭৬০ সালে’র পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য, আরাকান ও সুলতানদের শাসনাধীন ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে আসার পর ব্রিটিশরা ১৭৬১ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব পায়। তবে নামমাত্র কর আদায় ছাড়া তাদের বিশেষ কোনো আধিপত্ত ছিল না এই এলাকার উপরে। দুইজন রাজা চট্টগ্রামের এই অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ শাসন পরিচালনা করতেন ১৮৬০ সাল পর্যন্ত। রাজা নির্বাচন এর প্রক্রিয়া মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই হত কিন্তু ১৮৬০ সালের পর থেকে এই ধারা পরিবরতন হতে থাকে।

মং জ্বাতি থেকে নতুন রাজা চয়ন করতে মানুষ আগ্রহ দেখায় এবং সফল হয়। নতুন রাজা আসে খাগড়াছড়ি এলাকা থেকে এবং সে ছিল মং সম্প্রদায়ের। ১৯০০ সাল থেকে ব্রিটিশরা এই এলাকার শাসন ছেরে দেয় এবং বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা’কে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করে। এখানে গেলে আপনি একই সাথে অনেকগুলো উপজাতি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও রীতি জানতে পারবেন। বিভিন্ন জাতির সামগ্রিক কালচার সম্পর্কে জানতে পারা এবং একই সাথে পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশের সর্বোচ্চ আনন্দ নেয়ার অন্যতম স্থান হল খাগড়াছড়ি।

এখানে একই সাথে বসবাস করে মারমা চাকমা রাখাইন ত্রিপুরী এবং তঞ্চঙ্গ্যা উপজাতি। এখানকার ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ আদিবাসী। এলাকাটির প্রধান নদী ছিল চেঙ্গী নদী এবং এটির পাড়গুলোতে নলখাগড়া বা খাগড়া (স্থানীয় ভাষায়) গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যেত। অন্যদিকে স্থানীয় ভাষায় চেঙ্গী নদীর অপর নাম ছিল ছড়া। খাগড়া এবং নদীর ছড়া মিলিয়ে খাগড়াছড়ি নামটি আসে। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সরকার খাগড়াছড়িকে জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। আপনি যদি খাগড়াছড়িতে পর্যটনের বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যেতে চান তাহলে এই আর্টিকেলটি আপনাকে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত স্থান সমূহ নির্বাচন করতে সাহায্য করবে।

আলুটিলা

আলুটিলা অঞ্চল পরিচিত হচ্ছে এখানকার আলু পাহাড়ের নামে। অনেকে এটিকে আরবারি পাহাড় নামেও চেনে। এই পাহাড়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এই পাহাড়ে রয়েছে একটি রহস্যময় গুহা। এর জন্য অনেকে এটিকে পাহাড় না বলে আলুটিলা গুহা বলেও চেনে। একই সাথে এটির নাম দেওয়া হয়েছে রহস্যময় গুহা। এই গুহার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১০০ মিটারের বেশি, যা ৩ থেকে ৮ মিটার বা ২৫ ফুট পর্যন্ত গভীর।

খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থানার আলুটিলা নামক অঞ্চলে অবস্থিত এই রহস্যময় গুহা। সার্বিকভাবে পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ১০০০ মিটার। পাহাড়ের উপরস্থ এলাকাটি ঘন সবুজ বন দিয়ে আচ্ছাদিত। অদ্ভুত সুন্দর এই পাহাড়ের নীচে প্রবাহিত হচ্ছে হিমশীতল ঠান্ডা জল। পাহাড়ের গুহার মধ্যে পাতাল রেল এর মত কাঠামো রয়েছে। গুহার ভেতরের অংশ সম্পূর্ণরূপে আলোকহীন, এজন্য পর্যটকেরা উহাতে প্রবেশের পূর্বে টর্চ কিনে নিতে পারেন। এতে গুহা ভ্রমণের সম্পূর্ণ মজা এবং চলার উপায় বের করতে পারবেন।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক

প্রাকৃতিক অরণ্য এবং পাহাড়ে ঘেরা চোখ শীতল করা একটি সুন্দর পর্যটন স্থল হচ্ছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ হর্টিকালচার পার্ক। এটি খাগড়াছড়ি শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে পুরো স্থানটি জুড়ে বিনোদনের জন্য এবং সৌন্দর্য উপভোগের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে রয়েছে ঝুলন্ত সেতু, কৃত্রিম হ্রদ, ছোটদের জন্য রাইড, সুইমিং পুল, হর্স রাইডিং, বোট রাইডিং, বিশ্রামের স্থান, নামাজের স্থান, অডিটোরিয়াম, খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ, পিকনিক স্পট, বার্ড পার্ক, গেস্ট হাউস, অবজারভেশন টাওয়ার এবং বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ফলের গাছ।

চতুর্পাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ মনমুগ্ধকর। পারিবারিক ছুটি কাটাতে এবং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। পার্কের লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে পাহাড়ি উপজাতিদের হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিসের দোকান। ছুটির দিনে অসংখ্য বিনোদনপ্রেমী এখানে ছুটে আসেন পরিবার বা বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সময় কাটাতে । এটি এমন একটি জায়গা যে সারাবছর এখানে দর্শকদের ভিড় লেগে থাকে। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত পার্টি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। পার্কে প্রবেশের টিকেটের মূল্য মাত্র ৩০ টাকা।

বর্তমানে পর্যটনকারীদের মনোরঞ্জনের জন্য পার্কটির আধুনিকায়ন করা হয়েছে। পার্কের দুই পাহাড়ের ভাজে কয়েকটি জনপ্রিয় অ্যাক্টিভিটি স্পট তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো হলো লাভ পয়েন্ট, কিডস জোন, নতুন পিকনিক স্পট এবং নৌকায় চড়ার সুবিধা। পার্কটির ভবিষ্যৎ মানোন্নয়ন করার জন্য আরো নতুন কিছু স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে এবং একই সাথে দর্শকদের নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে সকল স্থানে। তারা একই সাথে উর্দিতে এবং সাদা পোশাকে এখানে ভ্রমণ করেন ও প্রত্যেক দর্শনার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্ক

খাগড়াছড়ির জিরো মাইল এলাকায় অবস্থিত খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্ক মূল শহর থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে, পাহাড়ের উপর এই পার্ক নির্মিত। এই পার্ক নির্মিত হয় ২০১১ সালে এবং পার্কে দুটি পাহাড়কে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ এর মাধ্যমে সংযোগ করা হয়েছে। পাহাড় গুলোর মাঝে রয়েছে অদ্ভুত সুন্দর বন। পার্কের হ্রদগুলোতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে। মাত্র ২০ টাকা হচ্ছে এখানকার প্রবেশ মূল্য। প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা অরণ্যের পাশাপাশি জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে এখানে বিভিন্ন ফলজ গাছ লাগানো হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জলপাই, লেবু, নারিকেল, কামরাঙ্গা, সুপারি, ইত্যাদি। এই পার্কের সবচাইতে আকর্ষণীয় জায়গা হচ্ছে এর ঝুলন্ত ব্রিজ। এটি প্রায় ২৫০ ফুট লম্বা। অনেকে এই ব্রিজে চড়তে ভয় পেতে পারেন কারণ, চলাচলের সময় সেতুটি অনুভূমিকভাবে নড়াচড়া করে। কিন্তু এর চারপাশে নাইলনের নেটিং বা রেলিং থাকার কারণে সেতুটি সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ। এখানে অনেক সময় বিভিন্ন সিনেমা বা নাটকের বা শর্টফিল্মের শুটিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিজটি পার হলেই পাওয়া যায় ছোটদের জন্য নির্মিত কিডস কর্নার এবং ট্রেন রাইড। সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত পার্কটি খোলা থাকে। এসব ছাড়াও এখানে রয়েছে কটেজ, পিকনিক কর্নার এবং গোলঘর।

হাতি মুড়া (স্বর্গের সিঁড়ি)

খাগড়াছড়ির পানছড়ি এলাকায় একটি উঁচু পাহাড়ি পথের নাম হচ্ছে হাতিমুড়া। অনেকে এটিকে স্বর্গের সিঁড়ি বলে থাকে। এই সিঁড়িটি লোহা দিয়ে তৈরি এবং প্রায় ৩০৮ ফুট দীর্ঘ। এটি একই সাথে প্রায় ১৫ টি গ্রামকে সংযুক্ত করে এবং তাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই পাহাড়ী রাস্তার এবং আশপাশের সৌন্দর্য অনেক পর্যটক কে এখানে আসতে বাধ্য করে।

রিছাং জলপ্রপাত

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা জলের প্রবাহ দ্বারা তৈরি হয়েছে রিছাং জলপ্রপাত। এটি খাগড়াছড়ির আলুটিলা’র পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। অনেকে এটিকে হাইকিং এর জন্যও উপযুক্ত স্থান মনে করেন। জলপ্রপাতের প্রবেশদ্বার থেকে মূল জলপ্রপাতের পৌঁছাতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সময় লাগে। তবে এটি স্লাইডিং এর জন্য পরিচিত একটি স্থান। তাছাড়া এখানে সারি সারি সিঁড়ি রয়েছে যা সরাসরি জলপ্রপাতের নিচ পর্যন্ত পৌঁছায়। এখানে হাইকিং এবং ভ্রমণ করতে হলে ভালো গ্রিপযুক্ত জুতা সাথে নিতে হবে এবং নিচে অবতরণের সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে আপনি পিছলে না যান।

এই জলপ্রপাতের উচ্চতা হচ্ছে প্রায় ৩০ মিটার এবং এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কল্পনাতীত। ২০০৩ সাল থেকে এটি মানুষের নজরে পড়ে এবং বর্তমানে খাগড়াছড়ি ভ্রমণকারীদের জন্য একটি অনন্য দর্শনীয় স্থান। তবে এখানকার সবচাইতে বেশি যে কারনে মানুষ আসেন তা হল, জলপ্রপাত এর পানিতে গোসল করা।

ঢাকার বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড থেকে সরাসরি খাগড়াছড়ি এর উদ্দেশ্যে বাস চলাচল করে এসব বাসে চড়ে প্রায় ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে খাগড়াছড়ি চলে আসা যায়। খাগড়াছড়িতে থাকার জন্য বেশকিছু হোটেল রয়েছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেল, ফরেস্ট রেস্ট হাউস, ইকো ছরি ইন, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*