
বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রংপুর বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি জেলা হচ্ছে কুড়িগ্রাম। এই জেলাটি ভারতীয় শাসনামলে মহাকুমা হিসেবে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৮৪ সালে কুড়িগ্রামকে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। কুড়ি শব্দের অর্থ ২০ (সংখ্যা) এবং গ্রাম অর্থ হচ্ছে পল্লী এলাকা। সুতরাং, নামকরণ থেকে বুঝা যায় যে ২০ টি গ্রামের সমন্বয়ে এই জেলা গঠিত।
এই এলাকার নামকরণ করা হয়েছে মুন্ডা ভাষা থেকে, যা পূর্বকালে এই এলাকার কথ্য ভাষা ছিল। বাংলাদেশ গঠনের শুরু থেকেই কুড়িগ্রাম একটি সীমান্তবর্তী এলাকা ছিল। সমগ্র কুড়িগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। কুড়িগ্রামের আকর্ষণীয় পর্যটন ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান সমূহ নিয়ে এই পোস্টে আলোচনা করা হলো; যা আপনার কুড়িগ্রাম ভ্রমণে সহায়তা করবে বলে আশা রাখি।
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানার সোনাহাট নামক ইউনিয়নে দুধকুমার নদীর উপর এই ঐতিহ্যবাহী এবং আকর্ষণীয় সেতুটি অবস্থিত। এই সেতুটি নির্মিত হয় ১৮৮৭ সালে। সেতুর নির্মাণকর্তা ছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ভারতের মণিপুর রাজ্য থেকে ইংরেজদের যোগাযোগ, সৈন্য সরবরাহ এবং রেশন স্থানান্তরের জন্য নিকটবর্তী রেললাইনের অংশ হিসেবে এই সেতুটি নির্মিত হয়। এই সেতুটি ১২০০ ফুট দীর্ঘ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা এই সেতু ব্যবহার করে তাদের যুদ্ধের পথ সুগম করে। পাকিস্তানি হানাদারদের যাত্রাপথ বিঘ্নিত করতে মুক্তিসেনারা এই সেতুটি গুড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর পুনরায় এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। সোনাহাট সেতু এবং এর আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ মনমুগ্ধকর হবার কারণে প্রতিবছর সারাদেশ থেকে দর্শনার্থীরা এখানে পিকনিক করতে উপস্থিত হন। সোনাহাট ব্রিজ এর নিকটে রয়েছে মীর জুমলার দ্বারা নির্মিত একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদ। ১৬৬০ সালে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদটি। এটি নিকটবর্তী পাটেশ্বরী বাজার থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আপনি সোনাহাট ব্রিজ ভ্রমণে আসলে, পুরাতাত্ত্বিক এই মসজিদটি ও দেখে আসতে পারেন।
উলিপুর মুন্সি বাড়ি
কুড়িগ্রামের উলিপুর থানার ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে আঠারো শতকের এই মুন্সি বাড়িটি অবস্থিত। সমগ্র মুন্সি বাড়ির আয়তন হচ্ছে প্রায় ৪০ একর এবং এটি উলিপুর বাজার থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিনোদী লাল ১৮ শতকে বিস্ময়কর এই স্থাপনার নির্মাণ করেন। মুন্সি বাড়ির মূল ভবনে রয়েছে ডাইনিং রুম, ড্রয়িং রুম, রান্নাঘর, গেস্টহাউস, এবং বিশ্রামাগার। স্থাপনার গঠন প্রকৃতি বিবেচনা করলে বুঝা যায় যে, মূল ভবনের পেছনের অংশ পুজা- অর্চনার কাজে ব্যবহৃত হতো। ভবনের পেছনের অংশে রয়েছে তুলসী মন্দির, নাট মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মন্দির, তুলসী বেদী, খোলা দোলনা মঞ্চ এবং সাধারন ব্যবহারের জন্য গভীর কূপ ও গোসলখানা।
ভবনের প্রধান ফটকের পাশে কাঁঠালচাঁপা গাছ রয়েছে এবং রয়েছে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। এই মুন্সিবাড়ি সম্পর্কে বিভিন্ন লোককথা প্রচলিত রয়েছে। কথিত রয়েছে যে, বিনোদী লাল একদা এখানে শিকারের জন্য এসেছিলেন। এমন সময় তিনি দেখেন যে, একটি ব্যাং অন্য একটি সাপকে ধরে খেয়ে ফেলে। তখনকার প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সাধারণ মানুষেরা ধারণা পোষণ করতো যে, যেসব স্থানে সাপ ব্যাঙ এর শিকার হয়; সেখানে বসবাস করলে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিকানা পাওয়া যায়।
সেজন্য বিনোদী লাল মহারানী স্বর্ণময়ীর অনুমতি সাপেক্ষে এখানে তার বাসস্থান নির্মাণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিনোদী লাল সপরিবারে ভারতে পাড়ি জমান। বর্তমানে ভবনটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। ভবনের দুটি কক্ষ ধরণীপুর ইউনিয়নের ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়াও এখানকার গোবিন্দ মন্দিরটি পূজা- অর্চনার জন্য প্রতিদিন ব্যবহৃত হয়।
টুপামারী পুকুর
কুড়িগ্রামের উলিপুর থানার দুর্গাপুর ইউনিয়নে এই বিখ্যাত পুকুরটি অবস্থিত, যা এখানকার একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। পুকুরের নিকটবর্তী প্রায় ২৫ একর জায়গা জুড়ে মনোরম এই পিকনিক স্পটটি সাজানো হয়েছে। শুধুমাত্র বনভোজনের জন্যই নয় বরং আশেপাশের অনেক জেলা থেকে মৎস্য শিকারীরা সৌখিনভাবে মৎস্য শিকারের জন্য এই পুকুরে আসেন।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুকুর খননের আগে এটি একটি বিস্তীর্ণ নিচু জলাভূমি ছিল। ১৯৮১ সাল থেকে এই পুকুরটি কার্যকরী হয় এবং এখানে মাছ ও কচ্ছপের চাষাবাদ শুরু করা হয়। ভূমিক্ষয় রোধ করার উদ্দেশ্যে এবং নান্দনিক সৌন্দর্য সংযোগের উদ্দেশ্যে, এলাকাজুড়ে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়। শীতকালে এখানে পর্যটকদের ভিড় তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। তাছাড়াও মৎস্য শিকারের সময়ও এখানে প্রচুর লোকসমাগম ঘটে। এখানকার মৎস্য সম্পদ, কচ্ছপ, ও ফল বিক্রয় করে বছর প্রতি প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় হয়।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফলক
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী অত্র এলাকায় বারংবার অভিযান চালায় এবং স্থানীয়দের উপর প্রচুর নির্যাতন ঘটায়। একই সাথে এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৭১ এর মানবেতর হামলার শিকার হওয়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে ও স্মৃতিচারণে এই স্মৃতিফলকটি নির্মিত হয় যা ফ্রিডম ফাইটার মেমোরিয়াল ব্লক নামেও পরিচিত। এই স্মৃতি ফলক স্থাপনের পিছনে একটি বেদনাদায়ক স্মৃতি রয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা কুড়িগ্রাম জেলায় ব্যাপক হামলা ও নির্যাতন চালায়।
অত্যাচারের শিকার হয়ে এখানকার গ্রামবাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ৩১শে সে মার্চ কুড়িগ্রামে সম্মিলিত একটি মুক্তি বাহিনী গঠন করা হয়, যাদের কয়েকজন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী রাজাকার সমেত নিকটবর্তী লালমনিরহাট ও রংপুর জেলার দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি বাহিনীকে সরে যেতে দেখে মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বলেন।
কিন্তু পাকিস্তানীরা তাদের মিশন ত্যাগ করে পুনরায় কুড়িগ্রামে ফিরে আসে এবং বাধাহীনভাবে এলাকায় প্রবেশ করে। এরপর তারা নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে চারজন কারারক্ষীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এখানকার সকল শহীদদের উদ্দেশ্যে এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়েছে।
ধরলা ব্রিজ বা ধলা ব্রিজ
বাংলাদেশ এবং ভারতের আন্তঃসীমান্তবর্তী একটি নদী হচ্ছে ধরলা নদী যা কুড়িগ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ড ধরলা নদীর উত্তর- পশ্চিম প্রান্তের নদীতীরে একটি আকর্ষণীয় পার্ক স্থাপন করেছে। অন্যদিকে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ যা মদনের মাঠ নামে পরিচিত। দর্শনার্থীরা এখানে প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে, সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে, নৌকা ভ্রমন করতে, এবং পিকনিকের সময় এখানে আসেন।
ভেতরবন্দ জমিদার বাড়ি
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে ভেতরবাঁধ পরগণার সদর দপ্তর ছিল রাজশাহীতে। ব্রিটিশ শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় সদর দপ্তর নাগেশ্বরী থানার ভেতরবাঁধ গ্রামে স্থানান্তর করা হয়। যদিও কালের পরিক্রমায় এই জমিদার বাড়ির অর্ধেকের বেশি অংশ বিলুপ্ত হয়েছে এবং বাকি অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই জমিদার বাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে ভবনটি কাঠ দ্বারা নির্মিত এবং এটি দর্শনীয় একটি স্থান।
নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়ি
নাওডাঙ্গা জমিদার বাড়িটি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থানায় অবস্থিত। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের নাওডাঙ্গা পরগনার জমিদার বাহাদুর প্রমদারঞ্জন বক্সী এই জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে জমিদারের উত্তরসূরী বীরেশ্বর প্রসাদ বক্সী স্থানীয় এই জমিদার বাড়িতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ছোট একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি নওডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নওডাঙ্গা স্কুল এন্ড কলেজ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর দোল পূর্ণিমার উৎসবের সময় জমিদারবাড়ির মাঠে ঝুলন মেলা আয়োজন করা হয়। মূলত দোল পূর্ণিমা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা শ্রী কৃষ্ণের জন্মবার্ষিকী।
চান্দামারী মসজিদ
কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানার মন্ডলপাড়া নামক গ্রামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি স্থাপিত। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী নির্দেশ করে যে, এটির স্থাপনা হয়েছিল সুলতানি ও মুঘল আমলে। মসজিদটিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে এবং অভ্যন্তরভাগে তিনটি দর্শনীয় মেহরাব রয়েছে। যদিও মসজিদটিতে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি কিন্তু ধারণা করা হয় যে ১৫৮৪ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে এই প্রাচীন মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে বাসে ও ট্রেনে কুড়িগ্রাম যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। তাছাড়া সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার ব্যতীত প্রতিদিন একটি করে আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস বর্তমান।
কুড়িগ্রামে থাকার জন্য কয়েকটি আধুনিক মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, হোটেল অর্ণব প্যালেস, হোটেল মেহেদী, হোটেল রয়েল প্যালেস, হোটেল স্মৃতি, মেসার্স মিতা রেস্ট হাউস, ইত্যাদি।
Leave a Reply