বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের রাজধানী’র হলো ময়মনসিংহ। ব্রক্ষপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত ময়মনসিংহ শহরটি ঢাকা থেকে ১২০ কি.মি. বা ৭৫ মাইল উত্তরে অবস্থিত। প্রথম ১৭৮৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শহরটিকে একটি বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রও ছিল। ময়মনসিংহ নামটি আসে মোমেন সিং বা মোমেন শাহী নাম থেকে, যিনি মোঘল আমলে বঙ্গের এই অংশ শাসন করতেন।
ময়মনসিংহ বিখ্যাত এখানকার নকশীকাঁথা’র জন্য এবং এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক গান ”ময়মনসিংহ গীতিকা’র জন্য। তাছাড়াও আরও অনেক দেখার মতো স্থান ও পুরাকীর্তি রয়েছে ময়মনসিংহে। পাশাপাশি এটি একটি স্বাস্থ্যকর স্থানও বটে। ময়মনসিংহের দর্শনীয় স্থান ও সেসবের বিবরণ নিয়ে এই পোস্ট।
ময়মনসিংহ জাদুঘর
ময়মনসিংহ শহরে অমৃত বাবু রোডে অবস্থিত ময়মনসিংহ জাদুঘর। এটি ছিল মুঘল জমিদার মদন বাবুর বাগানবাড়ি। স্থানীয় ইতিহাস নিবন্ধিত এবং সংগ্রহ করে প্রদর্শনী’র উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়; পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে এটি গেজেটে’র অনÍর্ভুক্ত হয়। এখানে প্রদর্শিত রয়েছে ভাস্কর্য, ধাতুর কাজ, স্থানীয় স্থাপত্য, হস্তলিপি, ফলক ইত্যাদি। মদন বাবুর প্রাসাদ থেকে ২৪১ টি প্রবন্ধ পাওয়া যায়। সেসব প্রবন্ধ জাদুঘরের তিনটি কক্ষ জুড়ে সাজানো রয়েছে।
কর্তৃপক্ষের নিকট আরো সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা ও পান্ডুলিপি, কিন্তু যথাযথ স্থানের অভাবে তা প্রদর্শনীতে অবর্তমান। ১৯৯৯ সালে এই জাদুঘর সংস্করণের কাজ হাতে নেওয়া হয় এবং আরও কিছু সামগ্রী এই জাদুঘরের অন্তর্ভুক্ত হয়, যেমন- প্রাচীন তাঁত যন্ত্র, ঘড়ি, কম্পাস, মোমবাতি’র স্ট্যান্ড, শোভাময় ফুলের টব, মূর্তি, ভাস্কর্য (সরস্বতী দেবী, ড্রাগন এবং বিষ্ণু দেব), বিভিন্ন প্রাচীন খেলনা, ইত্যাদি।
প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত বস্তুসমূহের মধ্যে রয়েছে, একটি ষাঁড়ের মাথা, দুটি হরিণের মাথা, একটি হাতির মাথা, একটি মার্বেল পাথরের টেবিল, ইতালীয় মূর্তি, সোফা সেট, ইত্যাদি। তাছাড়াও এখানে দেখানো হয়েছে গ্রামবাংলার অনেক পুরাতন চিত্রকর্মসমূহ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন জাদুঘর
বাংলাদেশের শিল্পের মহান শিক্ষক হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। শিল্পাচার্য জয়নুল শাহ্ আলী আবেদীন এর শিল্পকর্মসমূহ সংকলন করে তৈরি হয়েছে জয়নুল আবেদীন জাদুঘর। এর প্রতিস্থাপনা হয় ১৯৭৫ সালে। ১৯১৪ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত শিল্পাচার্যে’র গড়া সকল কর্মসমূহ এখানকার গ্যালারীতে স্থান পেয়েছে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের পথিকৃৎ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষে গড়া তার চেতনামূলক শিল্পকর্ম এবং ১৯৪৩ সালে বাংলা’র দুর্ভিক্ষের উপর তার তৈরি কর্মসমূহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জাদুঘরটি ময়মনসিংহ শহরের ব্রক্ষপুত্র নদীর তীরে কোয়ার্টার পার্ক নামক এলাকায় স্থাপিত।
শিল্পাচার্য আবেদীন তার তরুণ বয়সে ব্রক্ষপুত্র নদের তীরে বসে চিত্রাঙ্কন করতেন। দ্য বম্বে ক্রনিকল আর্ট প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার দরুন তার শিক্ষকরা তাঁকে কলকাতায় চিত্রশিল্পে’র উপর পড়াশুনার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৫০ এর দশকে গ্রাম বাংলা’র মানুষের নিপীড়িত জীবন যাত্রা এবং তাদের দুরাবস্থা দেখে তিনি সক্রিয়ভাবে তুলি হাতে নেন। তিনি তাঁর শিল্পকর্মেও মাধ্যমে মানুষের মনে আন্দোলনের চেতনা গড়ে তোলেন।
বর্তমানে জাদুঘরে রয়েছে ৫৩ টি তৈলচিত্র, ৭৫ টি আলোকচিত্র এবং ১৬ টি প্রতিলিপি। এসব প্রধান চিত্রকর্মসমূহ ছাড়াও এখানে প্রদর্শিত হয়েছে শিল্পী’র তুলি, তুলি’র হোল্ডার, তিসি তেলের বোতল, তার্পিন, রঙের টিউব, মোম, কার্বন বাক্স, ধাতব ক্লিপ, কলম ও স্ক্র্যাপারের মতো ৬৯ টি পুরাতন স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর শেষদিকের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি আর্ট স্কুল। তাছাড়াও রয়েছে একটি আর্ট কটেজ, যেখানে আপনি চাইলে থাকতে পারেন য হল তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি ভবন। থাকার জন্য আপনাকে এটি আগেই ভাড়া করতে হবে। তাছাড়া শিক্ষাসফরের জন্যেও আপনি চাইলে আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে এটি ভাড়া নিতে পারেন।
আলেকজান্ডার ক্যাসেল
ময়মনসিংহ শহরের প্রাচীন স্থাপনাসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো আলেকজান্ডার ক্যাসেল। এটি শহরের কোর্ট-কাচারী এলাকায় নির্মীত একটি প্রাসাদ যা ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি স্থাপনা। মূলত এই প্রাসাদ নির্মীত হয় ১৮৭৯ সালে একটি সুরম্য বাংলোরুপে যা লোহা’র কুঠি হিসেবেও পরিচিত ছিল। এর মেঝে তৈরি হয় শ্বেত পাথর দিয়ে এবং প্রচুর রাজকীয় আসবাবপত্র দ্বারা এই বাংলো সুসজ্জিত করা হয়। ভবনের সামনে রয়েছে সুসজ্জিত বাগান এবং দীঘি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বোটানিক্যাল গার্ডেন
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শিক্ষাবিদদের গবেষণার সুবিধার্থে ১৯৬৩ সালে ২৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত হয় এই বোটানিক্যাল গার্ডেন। বিভিন্ন বিরল প্রজাতি’র উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে এখানে সংরক্ষিত রয়েছে প্রায় ১৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই বোটানিক্যাল গার্ডেনটি। গবেষণাতাত্বিক দিক থেকে দেখতে গেলে উদ্ভিদগুলো মোট ২৮৭ টি গণ এবং ১৯৮ টি ফ্যামিলিতে (পরিবার) বিভক্ত। এটি একই সাথে প্রকৃতি প্রেমীদের প্রকৃতি’র সাথে সংযোগ ঘটায় এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
উদ্ভিদগুলোকে ক্লাস হিসেবে বিভক্ত করতে গেলে; এখানে সংরক্ষিত রয়েছে ঔষধি বাগান, পাম, বহিরাগত ফল বাগান, দেশী ফল বাগান, বেত বাগান, বাঁশ বাগান, ফার্ন বাগান, ক্যাকটাস বাগান, অর্কিড বাগান, ম্যানগ্রোভ বাগান, চা বাগান, একটি আর্বোরেটাম ও সাইক্যাড বাগান। ডি এন এ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এবং ভবিষ্যত গবেষণার রেফারেন্সে’র জন্য সম্প্রতি বাগানে হার্বেরিয়াম সংকলন করা শুরু হয়েছে।
হার্বেরিয়াম হলো কোনো গুল্মের নরম কান্ড ও পাতা শুকিয়ে, তা ফ্রেম বা কাগজে সংযুক্ত করে ভবিষ্যতে রেফারেন্সে’র জন্য সংকলন করা। সারা বিশ্বে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সম্প্রসারণের সাথে তাল মিলিয়ে এই প্রকাশনায় জিমনোস্পার্ম, ঔষধি গাছ, দেশী ও বিদেশী ফলের গাছ, শোভাময় উদ্ভিদ, খেজুর ক্যাকটাস, বাঁশ ও বেতের উপর একটি উদ্ভিদ জীববৈচিত্র ডেটাবেস তৈরি করার কাজ করা হচ্ছে। একই সাথে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ সামনা- সামনি দেখার ফলে ছাত্রদের গাছপালার আঙ্গিক গঠনের উপর শিক্ষা পরিপূর্ণতা পাচ্ছে এবং ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়ছে।
গৌরীপুর লজ
ময়মনসিংহ শহরের একটি প্রাচীন স্থাপনা’র নাম হলো গৌরীপুর লজ। এর প্রতিষ্ঠা’র ইতিহাস মানুষের কাছে এখনো অজানা। ভবনটি লোহা, কাঠ এবং টিন ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। স্থানটি ময়মনসিংহ শহরেই বোরো বাজারে অবস্থিত এবং সহজেই যাতায়াতযোগ্য। এর ভিতরে ২০ টি প্রাচীন কক্ষ রয়েছে যা আপনি চাইলে ঘুরে দেখতে পারেন, কিন্তু আপনার পূর্ব অনুমতি প্রয়োজন; তাছাড়া আপনি ভবনে প্রবেশের অনুমতি নাও পেতে পারেন।
শশী লজ
মুক্তাগাছা এলাকার পূর্বকালীন জমিদার বংশের উত্তরসূরী সূর্যৃকান্ত আচার্য চৌধুরী’র পুত্র শশীকান্তের নামে জমিদার সূর্যৃকান্ত এই বিলাসবহুল প্রসাদটি নির্মান করেন। প্রাসাদটি মূলত দ্বিতল এবং এই প্রাসাদ তৎকালীন আমলে ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন স্থান থেকে নিয়ে আসা আসবাবপত্রে পরিপূর্ণ ছিল। হঠাৎ এক প্রবল ভ‚মিকম্পের কারণে ১৮৯৭ সালে এই স্থাপনাটি ধ্বংস হয়ে যায়, পরবর্তীতে ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত শশীকান্ত নিচ তলা পুন:নির্মানের কাজ করেন এবং সফল হন। এটি প্রায় ৯ একর জমির উপর অবস্থিত এবং এর প্রবেশ দুয়ার অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত ও আকর্ষণীয়।
লজের পশ্চিম পাশে একটি মনোরম পুকুর রয়েছে। পুকুরটির মাঝখানে দোতলা একটি মন্ডপ রয়েছে। প্রধান ফটক থেকে ভবনের দিকে অগ্রসর হলে পাওয়া যাবে একটি সুন্দর ফোয়ারা। আলোকসজ্জার নিমিত্তে এখানকার বলরুমে সাজানো আছে মনমুগ্ধকর ঝাড়বাতি। প্রাচীন হলেও দরজা ও জানালাগুলো রঙিন কাঁচ দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। এই ভবনের গুরুত্ব অম্লান রাখতে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এই লজকে একটি সুরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে মূল্যায়িত করে।
আপনি ময়মনসিংহ ভ্রমণ করতে চাইলে আপনার থাকার জন্য পাবেন বেশ কিছু বিলাসবহুল হোটেল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল হেরা, হোটেল আমির ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল লা ম্যারিয়ান, হোটেল সিলভার ক্যাসেল, ঈশা খাঁ, হোটেল আসাদ, ইত্যাদি। আপনার বাজেট অনুসারে আপনি যে কোনো হোটেলে থাকতে পারবেন। তবে সকল ভ্রমণস্থল গুলোতে একা না যাওয়াটাই ভালো হবে কারণ আপনি সুরক্ষা সংকটে পড়তে পারেন। এজন্য পরিবারের সাথে বা অন্য পর্যটকদের সাথে একত্রে ভ্রমণ করুন।
Leave a Reply