পাবনা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

পাবনা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শহর হচ্ছে পাবনা। পাল ও সেন আমলে বাংলা অঞ্চলের রাজধানী ছিল পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রনগর যা বর্তমানের বগুড়া হিসেবে পরিচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক কানিংহামের ধারণা অনুযায়ী, পুণ্ড্র বা পুন্ড্রবর্ধন সভ্যতা থেকে পাবনা শহরের নামটি এসেছে। যদিও পরবর্তীকালীন পণ্ডিতরা এই নামকরণের পিছনের ইতিহাস গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন না। এই পোস্টে পাবনা শহর এবং এর  অন্তর্গত উপজেলাগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

চাটমোহর শাহী মসজিদ

পাবনা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হচ্ছে চাটমোহর। এটি পাবনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি উপজেলা। চাটমোহর শাহী মসজিদটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও পুরাতাত্ত্বিক মসজিদগুলোর একটি। মসজিদের শিলালিপি অনুযায়ী ১৫৮১ সালে নেতা সৈয়দ আবুল মোঃ মাসুম খান তার ছোট ভাই মোহাম্মদ বিন তুর্কি খানকে এই মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেন। মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। এজন্য মসজিদের স্থাপত্যশিল্পে সুলতানি আমলের স্থাপনার গঠনশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায়।

এই মসজিদে রয়েছে তিনটি বড় মাপের গম্বুজ। মসজিদটি ৪৫ ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এবং  প্রস্থে সাড়ে ২২ ফুট। এই মসজিদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, মসজিদটি জাফরি ইট নামে ছোট এবং পাতলা এক ধরনের ইট দিয়ে নির্মিত। তবে মসজিদের সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মসজিদের দেয়ালে প্রাচীন ভাস্কর্য ও বর্ণনাতীত সুন্দর অলংকরণ।

মসজিদটির পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার আশি’র দশকে মসজিদটির পুনঃনির্মাণ এবং সংস্কারকার্য পরিচালনা করে। চাটমোহর মসজিদ থেকে প্রাপ্ত তুঘরা নামক একটি শিলালিপি রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে স্থান পেয়েছে; যা দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলার একটি গবেষণামূলক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন সংকলন হিসেবে পরিচিত।

পাকশী রিসোর্ট

পাবনা জেলার ঈশ্বরদী নামক উপজেলায় পদ্মা নদীর তীরে প্রায় ৩৩ একর  আয়তন জুড়ে মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পাকশী রিসোর্টের। এই রিসোর্টের আতিথেয়তা পাঁচ তারকা মানের, যা সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। আপনি রিসোর্টে গেলে যেসব মনভোলানো সুবিধাসমুহ পাবেন তাদের মধ্যে রয়েছে, সুইমিং পুল, স্পা, মিনি চিড়িয়াখানা, নান্দনিক লেক, ফলের বাগান, মাল্টি কুইজিন রেস্তোরা, ইনডোর গেমস, রিসোর্ট, বার, ইত্যাদি। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিশেষায়িত হয়েছে প্রায় ৪০০ প্রজাতির ফুলের এবং ফলের গাছ দ্বারা।

এখানকার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং স্থাপত্যে আধুনিকতার জাজ্বল্যমান স্পর্শ রিসোর্টের সামগ্রিক সৌন্দর্যতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। এখানে আপনি যেসব ইনডোর গেমস উপভোগ করতে পারবেন সেগুলো হচ্ছে লন টেনিস, টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন, কেরাম, বিলিয়ার্ড, দাবা, ইত্যাদি। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হন, তাহলে আপনি চাইলে হাইকিং এবং ক্যাম্প ফায়ারে যেতে পারেন। তাছাড়া রিসোর্ট থেকে ভাড়া নিতে পারেন টেণ্ট নাইট সামগ্রী। এখানকার কটেজে অবস্থানকালে লেকের পাড়ে আপনি মনোরম প্রকৃতির উপভোগ করতে পারেন।

গাজনার বিল

ভ্রমণপ্রিয়দের জন্য পাবনার একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হচ্ছে গাজনার বিল। এটি পাবনা শহরের সুজানগর থানায় অবস্থিত। বিশাল এই বিলের বুক চিরে তৈরি হয়েছে আকর্ষণীয় একটি সরু পাকা রাস্তা। যার দুই পাশে প্রবহমান রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। এখানকার স্থানীয় অর্থনীতি অনেকটাই এই বিলের উপর নির্ভরশীল। কারণ, এখানকার বেশিরভাগ মানুষজন মৎস্য শিকারকে তাদের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

বিলের আশেপাশে ভ্রমণরত রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির পাখি এবং শীতকালে বিভিন্ন অতিথি পাখিরা এখানে আশ্রয়ের সন্ধানে আসে। সাধারণত বর্ষার সময় পাকা রাস্তাটি ডুবে যায়। এজন্য বর্ষাকালে এখানে ভ্রমণ করলে, আপনাকে নৌকা নিয়ে ভ্রমণ করতে হবে। তবে বছরের যে কোন সময় এই বিলের  সৌন্দর্য মানুষের মনে দাগ কাটার মত।

তাড়াশ রাজবাড়ী

তাড়াশ রাজবাড়িটি পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি পুরাতাত্ত্বিক ভবন। এই রাজবাড়িটি জমিদার বনমালী রায় এর ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদে হিসেবে পরিচিত। এই ভবনটি ঐতিহাসিক রেনেসাঁ আমলের স্থাপত্য শিল্পের অনুকরনে তৈরি করা হয়েছে। ভবনটি গঠনগত দিক থেকে আয়তাকার; যার দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট এবং প্রস্থ ৬০ ফুট। ভবনটিকে কাঠামোগত দৃঢ়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে চারটি কারিন্থিয়ান পিলারের সাহায্যে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে, যা ভবনটির সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।

উল্লেখ্য যে এই জমিদার গোষ্ঠীর আয়ত্তে প্রায় ২০০ একর জমি ছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়  জমিদারের পরিবারবর্গ তাড়াশ রাজবাড়ীতে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকারি অফিস হিসেবে জমিদার বাড়িটি ব্যবহৃত হয়েছিল। ভবনটি এখনো গঠনগত দিক থেকে  সবলতা ধরে রেখেছে। বর্তমানে ভবনটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি পুরাকীর্তি হিসেবে পরিগণিত হয়।

জোড় বাংলা মন্দির

পাবনার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত ঐতিহাসিক পর্যটন আকর্ষণ হচ্ছে জোড় বাংলা মন্দির। এটি পাবনা জেলা সদরের রাঘবপুর গ্রামে অবস্থিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী জানা যায় যে, মন্দিরটি আঠারো শতকের মাঝামাঝি নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই মন্দিরের নির্মাতা ও নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য শিলালিপি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্ত অনুসারে জানা যায় যে, মুর্শিদাবাদের নবাবের তহশিলদার ব্রজমোহন ক্রোরেই এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।

মন্দিরের দেয়ালের ধরন, পোড়ামাটির ফলক এবং ফলকে উন্মোচিত অলংকরণসমূহ অনেকটাই দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মন্দিরের সামনের দিকে তিনটি প্রবেশপথ আছে এবং প্রধান রাস্তায় দুটি বিশাল আকারের স্তম্ভ বিদ্যমান। এর প্রবেশদ্বার দেখলেই বুঝা যায় যে এটি রাজকীয় ঘরানার সাথে সম্পৃক্ত। মন্দিরের প্রধান বেদিটি ইটের তৈরি এবং মন্দিরের পেছনভাগে বেরিয়ে যাবার জন্য দরজা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে ভবনটি সংরক্ষিত।

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ

ব্রিটিশ শাসন আমলে  বাংলা অঞ্চলে যে  অল্প কটি ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল তাদের মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অন্যতম  1915 সালের 4 মার্চ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এই সেতু উদ্বোধন করেন পদ্মা নদীর উপর নির্মিত এ বৃষ্টি কুষ্টিয়া এবং পাবনার ঈশ্বরদী অঞ্চল কে যোগাযোগের মধ্যে এনেছে  এই সেতুটি মূলত রেল চলাচলের জন্য তৈরি যার পিলারের দৈর্ঘ্য ৩৫০ ফুট পর্যন্ত এই ব্রিজের চারপাশের নদীর অববাহিকা ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত মনোরম এবং পাবনা ভ্রমণকারীদের  চেকলিস্ট স্থান করে নেওয়ার মতো আকর্ষণীয় একটি জায়গা

দুবলিয়া মেলা

এটি পাবনা জেলায় ঐতিহাসিকভাবে উদযাপিত একটি মেলা যা প্রায় শতাধিক বছর ধরে চলে আসছে। পাবনা সদর উপজেলার দুবলিয়া নামক গ্রামে প্রতিবছর এই মেলাটির আয়োজন করা হয়, যা স্থানীয় সাধারণ জনগণের জন্য অনেক বড় একটি উৎসব ও বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পূর্ববর্তীকালে এখানকার যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা এবং এটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতো বর্ষাকালে। তৎকালীন সময় থেকে নৌবিহারকে কেন্দ্র করে এই মেলাতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প ও বাণিজ্য মেলা উদযাপিত হত। বর্তমান কালেও এখানে বানিজ্য মেলা নিয়মিতভাবে পালন করা হয়, যাতে থাকে স্থানীয় এবং বহিরাগতদের ব্যাপক জনসমারোহ।

এই মেলাটি মূলত হাজী জসিম উদ্দিন ডিগ্রী কলেজ ও দুবলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতি অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গাপূজার সময় সারা মাস ব্যাপী জমজমাট এই মেলার আসর চলে। কালের পরিক্রমায় মেলায় শিল্পজাত দ্রব্য সমূহের ধরনের মধ্যেও প্রকট হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তনের। ইদানিংকালে মেলাতে পাওয়া যায় সিরামিক, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত দ্রব্য, শীতবস্ত্র, হস্তশিল্প, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী,গৃহস্থালীর আসবাবপত্র এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় নিত্য নতুন সামগ্রী।

এটি শুধু বিক্রয় কেন্দ্রিক বা ব্যবসাকেন্দ্রিক মেলা নয় বরং এটি সাধারণ মানুষের জন্য একটি আবেগের বিষয়। এখানে বিনোদনের জন্য প্রতিবছর আয়োজন করা হয় নাগরদোলা, ট্রেন, দোলনা, নৌকা, জাদু প্রদর্শনী, এবং অন্যান্য বিনোদনের ব্যবস্থা। ছোট বড় সকল বয়সের মানুষেরা এই মেলাতে যোগ দেয় এবং মেলা প্রাঙ্গণে দেখা যায় অসংখ্য দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের উৎসবমুখর পদচারণা।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে, ট্রেনে ও বিমানে আপনি পাবনা যেতে পারবেন।
পাবনাতে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানের হোটেল রয়েছে। আপনি ভ্রমণের সময় যেসব হোটেলগুলো পছন্দ করতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছে, হোটেল প্রবাসী ইন্টারন্যাশনাল, রুপকথা ইকো রিসোর্ট, রত্নদ্বীপ রিসোর্ট, খাইরুল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল নুর ইন্টারন্যাশনাল, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*