পটুয়াখালী শহর বরিশাল বিভাগের একটি জেলা, যাকে বলা হয় সাগরকন্যা বা সমুদ্রের মেয়ে। উপকূলবর্তী নদী সমৃদ্ধ এলাকা হল পটুয়াখালী। এই জেলা দিয়ে দুইটি নদী প্রবাহিত হয়েছে, এগুলো হল লাউকাঠি নদী ও লোহালিয়া নদী। পটুয়াখালীতে প্রবেশের পথে পায়রা সেতুটি পটুয়াখালী ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত কে বরিশালের সাথে যুক্ত করেছে। বর্ষা কবলিত সময় এলাকাটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য সময় বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় বিভিন্ন দুর্যোগের সাথে লড়তে হয়। তবে শহরটিতে এবং এর আশেপাশে দেখার মত সুন্দর জায়গার অভাব নেই। আজকের এই আলোচনা পটুয়াখালী, কুয়াকাটা এবং এর আশেপাশের দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে।
পানি জাদুঘর (সমগ্র এশিয়াতে প্রথম)
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এই দেশের জীবন- জীবিকা এবং রীতি- নীতি, নদ- নদী’র সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। নদী ও বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এর সাথে জড়িত সংস্কৃতি তুলে ধরতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় তৈরি করা হয়েছে এশিয়ার প্রথম পানি জাদুঘর। উল্লেখ্য যে, সারাবিশ্বে মাত্র আটটি পানি জাদুঘর রয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে “অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ” নামক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান এই জাদুঘরটি স্থাপনা করে। বাংলাদেশের ৮৭ টি নদ- নদীর পানি আলাদা আলাদাভাবে স্বচ্ছ কাঁচের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
শুধু পানি নয়, ঐতিহ্য বিভাগেও রয়েছে বৈচিত্র। জাদুঘরটিকে প্রাচীন ধাঁচের দেখানোর জন্য জাদুঘরটি তৈরি হয়েছে টিনের চালা দিয়ে। এখানে রয়েছে মাছ শিকার এর যাবতীয় দেশি উপকরণ ও সামগ্রী; যেমন- জাল, কাঁকড়া শিকারের ফ্রেম, ঝাঁকি, জাল, খচানি জাল, ইত্যাদি। গ্রামীণ ঐতিহ্যের ও জীবিকার সাথে নিবিড় ভাবে সম্পর্কিত নৌকা, তাঁত বোনার যন্ত্র, হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, বাশের ডোলা, থালা, বাটি, মগ, ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রাচীন দেশি কর্মকাণ্ডের ছবি রয়েছে এই জাদুঘরে।
বিশ্বের শতকরা ৩% স্বাদুপানির মধ্যে সবচাইতে বেশি পরিমাণে মজুদ রয়েছে বাংলাদেশে। নদী সমূহের পরিবেশ অবক্ষয়ের কারণে যাতে আমাদেরকে এই প্রয়োজনীয় পানির অভাবে পরতে না হয়, তার গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে এবং পানি সংরক্ষণ এ সাধারণ মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে এটি একটি সুদৃঢ় চেষ্টা করা হয়েছে। জাদুঘরে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা এবং দর্শনার্থীদের জন্য ২০ টাকা রাখা হয়েছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার ফলে মানুষ যে বন্যা ঘঠিত অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে, এই বিষয়ে এখানে জ্ঞান পিপাসু মানুষদের জন্য নদীর চিত্র ও তথ্য- উপাত্ত পেশ করা হয়েছে। জাদুঘরটি সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে (শুধুমাত্র মঙ্গলবার ব্যতীত)।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
পটুয়াখালীতে ভ্রমণের জন্য সবচাইতে উত্তম এবং জনপ্রিয় স্থান হচ্ছে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। এটি এমন একটি সমুদ্র সৈকত, যেখানে একই দিনে একই দিগন্তে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য কুয়াকাটা পৃথিবীজুড়ে খ্যাত। অতীতকালে এই অঞ্চলে প্রচন্ড পানিসংকট ছিল। এজন্য মানুষজন পানীয় জলের সংকট মেটাতে প্রচুর কুপ বা কুয়া খনন করেন। এখান থেকেই এই স্থানের নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা। পটুয়াখালীর কলাপাড়া নামক থানা তে অবস্থিত কুয়াকাটা একই সাথে হিন্দু এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থস্থান।
অনেকেই তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে এবং পানিতে অস্থি বিসর্জন এর উদ্দেশ্য এখানকার সমারহে যোগ দেন। পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কুয়াকাটা গমনের জন্য উপস্থিত যোগাযোগ মাধ্যম হল সড়ক পথ ও নদী পথ। সৈকতের পাশে উপজাতীয়রা তাদের নিজেদের তৈরি বিভিন্ন মনোহারী জিনিস বিক্রি করে; যা অন্য জায়গাতে সহজে পাওয়া যায় না। তাছাড়াও তাদের নিজস্ব বাজার রয়েছে এবং সেখানএ অনেক বিরল জিনিস আপনি ক্রয় করে নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন।
সোনার চর
কুয়াকাটার আরেকটি পর্যটন কেন্দ্র যা দর্শকদের কাছে বর্তমান সময়ে অত্যাধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তা হল সোনার চর। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় এখানকার বালি সূর্যের আলোকে সোনালী রঙে বিকিরণ করে বলে এই স্থানের নাম হয়েছে সোনার চর। পটুয়াখালী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার। গভীর সমুদ্রের মধ্যে আশ্চর্য এই চর জেগে ওঠার পেছনের কারণ এখনো অজানা। এই চরটি সর্বমোট ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, যার মধ্যে তিন কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে সমুদ্র সৈকত। কুয়াকাটার মতো এখানেও একই দিগন্তে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়।
এখানকার সাদা বালির উপর খেলা করে বেড়ায় অসংখ্য লাল কাঁকড়া। দূর থেকে দেখতে কাঁকড়া’র জোট দেখে মনে হয় যে, সাদা বালির উপর লাল গালিচা বিছানো রয়েছে। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অভয়ারণ্য এই ছোট্ট দ্বীপে অবস্থিত। সোনার দ্বিপকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানকার অরণ্য ও ভয়াবহ সুন্দর ঝাউবন, এই সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গাছের মধ্যে রয়েছে কেওরা, বাবলা, পাম্, করমচা, চাইলা, বেরি, ইত্যাদি।
অভায়ারণ্য অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রাণীগুলো হচ্ছে বাঘ, হরিণ, বন বিড়াল, বানর, বনমোরগ এবং প্রচুর অতিথি পাখি। শীতকালে প্রচুর অতিথি পাখি এখানে আশ্রয়ের খোঁজে আসে এবং একই সাথে ভিড় করেন প্রচুর দেশি ও বিদেশি পর্যটক। এই দ্বীপ এবং এর আশপাশ থেকে প্রচুর পরিমাণ মাছ সংগ্রহ করা হয়। বছরের ছয় মাস মৎস্য অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে এখানে। রাত কাটাতে চাইলে আপনি তাবু খাটাতে পারেন অথবা ডাকবাংলোতে থাকতে পারেন। তবে ভালো মানের রিসোর্ট বা হোটেল না থাকায় আপনার পরিপূরক থাকার জায়গা হচ্ছে গলাচিপা বা পটুয়াখালী জেলা।
পটুয়াখালী ইকোপার্ক
পটুয়াখালীর উপকূলবর্তী এলাকাতে বাংলাদেশ বন বিভাগ ১৩,৯৮৪ হেক্টর জমি বিস্তীর্ণ ইকোপার্ক স্থাপনা করেছে। ২.৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ইকো পার্ক চারটি এলাকাজুড়ে গঠিত (গঙ্গামতি, ফাতরার চর, খাজুরা এবং লতাচাপলী)। দর্শকদের আনন্দ প্রদানের উদ্দেশ্যে এখানে রয়েছে পাঁচটি পিকনিক স্পট, দুইটি ওয়াচ টাওয়ার, কাঠের ব্রিজ, কালভার্ট এবং ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র।
এখানে প্রায় ৪৫,০০০ গাছপালা রয়েছে। ম্যানগ্রোভ গাছগুলো একই সাথে পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবেও কাজ করে। তাছাড়া এখানে রয়েছে অরণ্যঘেরা লেক এবং এই লেকে রয়েছে বোটিং এর ব্যবস্থা। যদিও বর্তমান সময়ে পার্কের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আইলা এবং সিডর দ্বারা। তবে কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন এর কাজ শুরু করেছে।
পায়রা সেতু
পায়রা সেতুর আরেক নাম হল লেবুখালী সেতু। এই সেতুটি বরিশাল এবং পটুয়াখালী জেলাকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করেছে। ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। দেশীয় অর্থনীতিতে এবং পর্যটনএ এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক সেতুগুলোর মধ্যে একটি। এই সেতু তৈরি হয়েছে ডবল ডোজ তারের সাহায্যে, এজন্য এটির মূল্য অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি। চমৎকার আলোক সজ্জার কারনে, রাতের বেলা সেতুটিকে আরো বেশি সুন্দর দেখায়। ধীরে ধীরে স্থানটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।
পটুয়াখালী বা কুয়াকাটা যাবার জন্য সবচাইতে বেশি যে পথ পর্যটকরা বেছে নেন তা হলো নৌপথ। ঢাকা সদরঘাট থেকে সন্ধ্যার পর থেকে বিভিন্ন লঞ্চ পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। লঞ্চের ভাড়া সাধারণত কম। তবে আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী ৩০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে আপনি যাত্রা করতে পারবেন। তাছাড়াও দেশের সবচাইতে বিলাসবহুল লঞ্চগুলো ঢাকা বরিশাল রুটে গমনাগমন করে তবে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে ডেকে স্থান পাওয়া যায়। আর কেবিন ভাড়া ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত।
যদি আপনি সড়কপথে কুয়াকাটা যেতে চান, তাহলে দূরত্ব পরবে ৩৮০ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পরিবহন সার্ভিস থেকে ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের টিকিট। তবে বাসে যেতে তুলনামূলকভাবে বেশি সময় লাগে যা প্রায় ১২ ঘণ্টা। আপনি যদি পটুয়াখালীতে যাবার পর ভ্রমণের মাধ্যম খোঁজেন, তবে স্থানীয় লোকজন এখানে মোটরসাইকেল রাইড দিয়ে থাকেন। এতে আপনার যাত্রা একই সাথে অল্প টাকায় এবং কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব।
Leave a Reply