
বাংলাদেশের কয়েকটি পর্যটন জোন রয়েছে, তাদেরকে তাদের প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য অনুসারে ভাগ করা যায়। আপনি যদি পাহাড়ি এলাকা দেখতে চান, তাহলে আপনার জন্য সবচাইতে উত্তম হবে বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাংশে অথবা উত্তর- পশ্চিমাংশে যাওয়া। আর আপনি যদি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, সমুদ্র এবং প্রকৃতি একসাথে উপভোগ করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার জন্য সবচাইতে ভালো হচ্ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ- পূর্ব এলাকাতে ভ্রমণ করতে যাওয়া।
পিরোজপুর বাংলাদেশের দক্ষিণ- পূর্ব এলাকাগুলোর মধ্যে একটি। আপনি যদি বরিশাল বা সুন্দরবন বা কুয়াকাটা ভ্রমণ করতে যান, তাহলে একই সাথে পিরোজপুর শহরে ঘুরে আসতে পারেন। এটি বাংলাদেশের উপকূলবর্তী ছোট্ট একটি শহর, যেখানে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট পর্যটন স্থান ও বিনোদন স্থান সমূহ বিদ্যমান। পিরোজপুর জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্যসমূহ সম্পর্কে এই পোষ্টে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক
পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলায় অবস্থিত একটি পারিবারিক বিনোদন কেন্দ্র হচ্ছে ভান্ডারিয়া শিশু পার্ক। এটি এমন একটি পার্ক যা সব বয়সের দর্শনার্থীদের ভ্রমণ, বিনোদন এবং পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য উপযুক্ত একটি পার্ক। এই পার্কে রয়েছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড এবং শোভা বর্ধনের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। এসব প্রতিকৃতি বাচ্চাদের খেলার জন্য খুবই পছন্দনীয় এবং এসব থেকে বাচ্চারা বিভিন্ন প্রাণীর গাঠনিক বৈশিষ্ট্য শিখতে পারে।
পার্কটির বিনোদনমূলক রাইডগুলো হল নৌকা, ঠেলাগাড়ি, দোলনা ইত্যাদি। এখানকার প্রাণী প্রতিকৃতিগুলোর মধ্যে রয়েছে উট, জিরাফ, সিংহ, হাতি, হরিণ, ইত্যাদি। এই পার্কটি সবুজে ঢাকা যা প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য দর্শনীয় ও আনন্দদায়ক। পিরোজপুর জেলায় খুব অল্প সময়ে এই পার্কটি একটি অত্যাধুনিক শিশু পার্ক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সম্পূর্ণ পার্কটি প্রায় ৩.৩৮ একর স্থানের উপর অবস্থিত। ভান্ডারিয়া শিশু পার্কে রয়েছে নানা প্রজাতির অসংখ্য গাছপালা ও ফুলের বাগান।
হরিণপালা রিভারভিউ ইকোপার্ক
পিরোজপুর এর সবচাইতে আকর্ষণীয় পর্যটন স্থল হচ্ছে হরিণপালা রিভারভিউ ইকোপার্ক। এটি পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া থানার অন্তর্গত একটি অত্যন্ত মনোরম পরিবেশযুক্ত ইকোপার্ক। এই সমগ্র ইকো পার্কটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সমগ্র আয়তনের মধ্যে ৭৪ একর জায়গা জুড়ে অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে; যাতে হরিণ এবং দেশি-বিদেশি পাখিরা অবাধে প্রাকৃতিক পরিবেশে বিচরণ করে বেড়াতে পারে। এটি অত্যন্ত নিরাপদ এবং সুরক্ষিত একটি ইকোপার্ক। মানব সৃষ্ট বনাঞ্চল ছাড়াও ছয় একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে বিনোদনের উদ্দেশ্যে নির্মিত পার্কের অন্য অংশ।
পার্কের এই অংশে ছোটদের ও বড়দের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড রয়েছে, যেমন- ওয়াচ টাওয়ার, ফোয়ারা, ভাস্কর্য, টয় ট্রেন, ঘোড়া গাড়ি ও অন্যান্য সাধারন কার্যক্রম। তাছাড়াও এখানকার সুবিশাল লেকটিতে সকলের জন্য নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। যেহেতু পার্কটি ভালোভাবে ভ্রমণ করতে চাইলে লম্বা সময়ের দরকার, তাই পর্যটকদের সুবিধার কথা চিন্তা করে এখানে খুবই উন্নত মানের চাইনিজ এবং বাঙালি খাবার পরিবেশন করার মত রেস্তোরাঁ স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখানকার কটেজে চাইলে রাতও কাটাতে পারেন।
পার্কটি নিয়ে আরো কিছু কথা না বললেই নয়, তার মধ্যে একটি হচ্ছে যে পার্কটি কচা নদীর তীরে অবস্থিত। তাই পার্কে আসলে নদীটিও একত্রে দেখে আসতে পারবেন। নদীর জলরাশি, সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশ, নৌকা ভ্রমন, অভায়ারণ্য ঘুরে দেখা, এসব যোগ করলে আপনি এই বিশেষ ভ্রমণ থেকে অনেক আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে যেতে পারবেন।
ডিসি পার্ক
পিরোজপুর সদর থানায় অবস্থিত একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান হচ্ছে ডিসি পার্ক। পার্কটি গড়ে উঠেছে বলেশ্বর নদীর তীরে নামাজপূর গ্রামে। এই পার্কের অত্যন্ত জনপ্রিয় ওয়াচ টাওয়ার থেকে সুদূর প্রসারিত প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করা যায়। অনেক স্থানীয় মানুষ এই পার্কটিকে পিরোজপুর রিভারভিউ ইকোপার্ক নামে চেনে। পিরোজপুর এর সাবেক জেলা প্রশাসক ২০০৭ সালে এই পার্কটি স্থাপন করেন বলে পার্কটি ডিসি পার্ক নামে পরিচিত। এখানকার টাওয়ারটি পাঁচটি তলা নিয়ে গঠিত। পার্কের একপাশে নদী হওয়ায়, পার্কটির সৌন্দর্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
শহরের ব্যস্ত নাগরিকরা দিনশেষে প্রকৃতির একটু ছোঁয়া পেতে, সচরাচরই নিকটবর্তী এই পার্কে তাদের পরিবারসহ বেড়াতে আসেন। পার্কের ভিতরেও একটি পুকুর রয়েছে, যাতে প্যাডেল বোট রয়েছে। পার্কের অভ্যন্তরে সকলের জন্য রয়েছে বসার ব্যবস্থা, গোল ছাউনিযুক্ত ছাতা, ফুলের বাগান, হাঁটার জন্য তৈরি রাস্তা এবং সবুজের গালিচা। পার্কের ভিতর দুইটি কটেজ বিদ্যমান, যাতে আবাসনের জন্য রয়েছে একটি করে আসবাব ঘর, দুইটি করে শোবার ঘর ও রান্নাঘর। পার্কে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য হচ্ছে মাত্র ১৫ টাকা।
বলেশ্বরী নদী
এই নদীটি পিরোজপুর এর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এই ১৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর শেষ প্রান্তে অপূর্ব সুন্দর মোহনা রয়েছে। এটি গাঙ্গেয়- ব্রহ্মপুত্র পথে উৎপন্ন একটি নদী; যা বাগেরহাট থেকে শুরু হয়ে পিরোজপুর এর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে গেছে। এই নদীর এক তীর জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের (সুন্দরবনের) সীমানা। নদীর পাশের বনাঞ্চলটি বাংলাদেশ বন বিভাগ এর দ্বারা সুরক্ষিত একটি অঞ্চলে, যা পর্যটকদের কাছে পৃথিবীজুড়ে পরিচিত। অন্যদিকে নদীর প্রবাহ পথ এবং মোহনা অত্যন্ত সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাকৃতিক পরিবেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম।
কিভাবে যাবেন এবং কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে পিরোজপুর পর্যন্ত যাতায়াতের জন্য বহুল ব্যবহৃত যাত্রাপথ হচ্ছে সড়ক ও নৌপথ। ঢাকার সায়েদাবাদ বা গাবতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে নিয়মিত ঢাকা পিরোজপুর রুটে বাস চলাচল করে। তাছাড়াও ঢাকার প্রধান নদীবন্দর সদরঘাট থেকে পিরোজপুর এর উদ্দেশ্য লঞ্চ চলাচল করে।
আপনি যদি পিরোজপুরে রাত্রি যাপন করতে চান সেক্ষেত্রে এখানে মাঝারি মানের কিছু হোটেল রয়েছে। এই হোটেল গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, হোটেল রজনী, হোটেল রিল্যাক্স, হোটেল ডালাস, হোটেল অবকাশ, হোটেল সিনথিয়া, হোটেল আল গালিভ (মিয়ারহাট বন্দর, নেছারাবাদ), হোটেল শাহ নেওয়াজ (ইন্দেরহাট বন্দর), এবং হোটেল আল মদীনা।
পিরোজপুর সম্পর্কে আরও তথ্য
পিরোজপুর হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী একটি জেলা। এখানে যেমন পলি মাটি দ্বারা গঠিত ভূখণ্ড বিদ্যমান ঠিক তেমনি এটাও সত্য যে এখানকার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ স্থলভূমি প্রতিনিয়ত জোয়ার- ভাটার সম্মুখীন হয়। গঠনগত দিক থেকে পিরোজপুর হচ্ছে একটি ছোট ব-দ্বীপ। পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী, পাল আমলের আগে এখানে কোন জনবসতি ছিলনা এবং সমগ্র এলাকাটি ছিল সমুদ্রগর্ভের অন্তর্নিহিত ভূখন্ড। ঐতিহাসিকদের লিপিবদ্ধকরণ সূত্রে জানা যায় যে, সেন আমলে এবং পাল আমলে এখানে খণ্ড খণ্ডভাবে বেশ কয়েকটি চর জেগে ওঠে।
তবে এই এলাকাতে সেই সময় ছোট ছোট কয়েকটি জনবসতি গড়ে উঠলেও, স্থানটি সামগ্রিকভাবে বিচ্ছিন্ন জলাশয় হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯ শতকের শুরুর দিক থেকে এখানে মানুষজনের বসবাস শুরু হয়, যাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই পদ্মা ও মেঘনা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে এখানে আসেন। এখানকার পেশাজীবীরা মূলত কৃষিকাজে এবং মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত। তাছাড়া অন্যান্য পেশাজীবীর মধ্যে রয়েছে নৌ কারুশিল্পের দক্ষ কারিগর, লবণ চাষী, কুমার, কামার এবং ঢাকা থেকে আসা কিছু ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী।
পিরোজপুর এর পূর্ব নাম ছিল ফিরোজপুর। মুঘল আমলে বাংলার শাসনকর্তা সম্রাট শাহ সুজার পুত্র সন্তান ফিরোজ শাহ এর নামানুসারে এখানকার জনবসতির নাম হয়ে ওঠে ফিরোজপুর। পরবর্তীতে এখানকার মানুষজনের আঞ্চলিক কথ্য ভাষা অনুযায়ী এলাকার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় পিরোজপুর। মুঘল আমলে এ অঞ্চলটি ছিল লবণ উৎপাদন ও ব্যবসার জন্য বিখ্যাত একটি স্থান।
কিন্তু সেই সময় তাদের লবণ বিক্রয়ের জন্য সম্রাটকে লবণ কর নামক কর, যথাযথভাবে প্রদান করতে হতো। স্থানীয় গরিব চাষীদের অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য প্রথমবারের মতো সম্রাট আকবর লবণ কর তুলে দেন। যার ফলে এলাকাবাসীরা আরো বেশি লবণ উৎপাদনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে এবং সার্বিক অর্থনীতিতে এর ধনাত্মক প্রভাব পড়ে। সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ার কারণে এবং নিকটবর্তী অঞ্চলে সুন্দরবন থাকার কারণে নতুন করে গড়ে ওঠে নৌযান তৈরীর ব্যবসা ও শিল্প।
Leave a Reply