
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিকটবর্তী একটি জেলা হল রাঙামাটি। এখানকার প্রকৃতি যেন নিপুণ শিল্পী’র হাতের আঁকা ছবি। রাঙামাটি’র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে আজকের এই রচনা। আপনি যদি নিভৃতে প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে আপনার অবসাদ দূর করতে চান, তাহলে রাঙামাটি আপনার জন্য আদর্শ স্থান। রাঙামাটি চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটারের পথ। রাঙামাটির যেসব স্থানে আপনি ভ্রমণে যেতে পারেন এবং সেসব স্থান যে কারণসমূহের জন্য বিখ্যাত, তা তুলে ধরা হল।
কাপ্তাই হ্রদে বোটিং
বোটিং হলো রোমাঞ্চ সন্ধানকারী মানুষদের পছন্দেও বিষয়সমূহের একটি। আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় একজন মানুষ হন, তবে কাপ্তাই হ্রদ এ বোটিং এর অভিজ্ঞতা আপনাকে দিতে পারে পরিপূর্ণ প্রফুল্লতা এবং প্রশান্তি। বুনো পাহাড়, উপত্যকা এবং বাসভূমির চারদিক দিয়ে প্রবাহিত এই বিস্ময়কর হ্রদ। যদিও হ্রদটি মানবসৃষ্ট কিন্তু এর সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।
আপনি যখন বোটিং করবেন, আপনার চারপাশের পরিবেশ আপনার মনকে প্রশান্ত করবে। এই হ্রদেও স্বর্গীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে। পানিপথে আপনি বিভিন্ন এলাকাতে ভ্রমণ করতে পারবেন। তার মধ্যে কয়েকটি হলো, রাঙামাটি শহর, রাঙামাটি ঝুলন্ত ব্রিজ, নেভি একাডেমি, শুভলং ঝর্ণা, কর্ণফুলী নদী, রাঙামাটি কেবল কার রাইড, শেখ রাসেল ইকোপার্ক ইত্যাদি।
কাপ্তাই হ্রদ এর সাহায্যে বাংলাদেশের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৬২ সালে যা কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই জন্য ১১,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পানির উৎস প্রয়োজন হয়েছিল।
কাপ্তাই যাবেন যেভাবে
ঢাকা’র কমলাপুর বা সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি কাপ্তাই এর উদ্দেশ্যে বাস পাওয়া যায়। সড়কপথে কাপ্তাই যেতে প্রায় সাত থেকে আট ঘন্টা সময় লাগে। তাছাড়াও রেলপথে পাড়ি দেয়া যায় অন্তর্বর্তী পথ। রেলপথে সরাসরি চট্টগ্রাম আসতে হয় এবং চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি রাঙামাটি পর্যন্ত বাস পাওয়া যায়। রেলপথে আপনাকে ৪-৫ ঘন্টা সময় লাগতে পাওে চট্টগ্রাম আসতে এবং সেখান থেকে প্রায় দুই ঘন্টার বাস সফরে আপনি রাঙামাটি পৌঁছে যেতে পারেন।
শুভলং ঝর্ণা (রাঙামাটি)
শুভলং ঝর্ণা হল একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। আপনি এখানে প্রাকৃতিক ঝর্ণার ধারে সময় কাটানো এবং এতে গোসল করার আনন্দ মিস করতে চাইবেন না। এই স্থানের দূরত্ব হলো রাঙামাটি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে বোরোকল উপজেলায়। শুভলং পাহাড় থেকে এই নৈ:সর্গিক ঝর্ণাটি প্রবাহিত হয়েছে। বর্ষাকাল হলো এই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য সর্বোত্তম সময়। ভারি জলরাশি এই সময়ে এই ঝর্ণার আকর্ষণকে আরো মোহময় করে।
শুভলং ঝর্ণা (বোরোকল উপজেলায়) যাবার উপায়
শুভলং ঝর্ণাতে পোঁছানোর সর্বোত্তম উপায় হলো জলপথ। আপনি কাপ্তাই হ্রদ থেকে সরাসরি একটি স্পিড বোটের মাধ্যমে চলে আসতে পারেন এই ঝর্ণাতে। তাছাড়া রাঙামাটি জেলা থেকে সহজেই ভাড়ায় চালিত নৌকা পেয়ে যাবেন। আপনার এই যাত্রায় খরচ পড়তে পারে পনেরো’ শ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত (নৌকার উপর ভিত্তি করে)। আপনি খরচ বাঁচাতে চাইলে অন্য দর্শনার্থীদের সাথে একত্রে নৌকা ভাড়া করতে পারেন। নৌপথে যাত্রাটিও আপনার জন্য হবে এক মনোমুগ্ধকর বিষয়। এই ১.৫- ২.০ ঘন্টার যাত্রাপথে আপনি অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং আপনার যাত্রার ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
রাজবন বিহার (রাঙামাটি)
এই বৌদ্ধ বিহারটি নির্মিত হয় ১৯৭০ সালে এবং আজও সেটি তার গর্ব ধারণ করে রয়েছে। ৩৩ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত রাজবন বিহার। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। এখানকার প্রকৃতি সবুজ এবং সব মিলিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে। এখানকার পবিত্র বাস্তু আপনাকে অন্তর্নিহিত প্রশান্তি এবং আত্মার স্থিরতা আনতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হয়।
রাজবন বিহার যাবার উপায়
রাঙামাটি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূওে অবস্থিত রাজবন বিহার। রাঙামাটি থেকে রাজবন বিহার যাবার উপায় খুবই সহজ। আপনি একটি অটোরিক্্রা বা রিক্সা বা জীপ ভাড়া করতে পারেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারেন রাজবন বিহারে।
রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু
রাঙামাটি বেড়াতে যাবেন অথচ রাঙামাটির ঝুলন্ত সেতু’র আনন্দ না নিয়ে চলে আসবেন, তা হয় না। রাঙামাটির প্রধান আকর্ষণ হলো এখানকার ঝুলন্ত সেতু এবং অনেকে মনে করেন যে, এটি রাঙামাটির একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক। এই সেতুটি কাপ্তাই হ্রদের উপর অবস্থিত এবং এটি মধ্যবর্তী পিলারসমূহের সাহায্যে ঝুলন্ত অবস্থায় তৈরি করা হয়েছে।
ঝুলন্ত হবার কারণে, এর উপরে চলাচলের সময় এটি দুলতে পারে। অনেক দর্শক এবং ছোট বাচ্চারা এই অনুভূতি উপভোগ করতে ভালোবাসে। আপনি সেতুতে উঠলে খুব কাছাকাছি স্বচ্ছ জলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারবেন এবং অনেক সময় হয়তো পানি হাত দিয়ে ছুঁতেও পারবেন। সেতুর দুই পাশে আছে পাহাড় এবং আপনি সেতু পার হলে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা এবং প্রকৃতির সাথে তাদের নিবিড়তা দেখতে পারবেন। সহজ সরল জীবন- যাপনের যেন এক সুন্দর দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করে।
যেভাবে পোঁছাবেন
কাপ্তাই হ্রদের উপর সেতুটি রাঙামাটি শহরেই অবস্থিত। আপনার হোটেল বা আবাসিক এলাকা থেকে অটোরিক্্রা, সি এন জি বা রিক্সা নিয়ে সহজেই সেতুর নিকটবর্তী পাহাড়ে চলে যেতে পারেন। তাছাড়া আপনার চোখকে সবুজের ছোঁয়া দেবার জন্য আশেপাশে রয়েছে ঘন গাছপালা। আরও ভ্রমণের সুবিধার্থে সেতুর পাশেই নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়, সেই নৌকাতে করে কাপ্তাই হ্রদ ও কর্ণফুলী নদীর সৌন্দর্য দেখতে পছন্দ করেন অনেক ভ্রমণপিপাসু মানুষ জন।
রাঙামাটি সাংস্কৃতিক জাদুঘর
রাঙামাটি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গেলে, আপনার চেকলিস্টে রাঙামাটি কালচারাল ইন্সটিটিউট স্থান করে নেয়া উচিত। এই সাংস্কৃতিক জাদুঘরে আদিবাসী ও উপজাতিদের সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা হয়। জাদুঘরে রয়েছে শিল্পকলা, লোককাহিনী’র সংগ্রহ, কারুশিল্প, প্রাচীন মুদ্রা, বাদ্যযন্ত্র, চিত্রকর্ম, মূর্তি, ছবি, অলঙ্কার, অস্ত্র বা হাতিয়ার ইত্যাদি।
এসব বিভিন্ন সময়কালে উপজাতিয়দের বিবর্তন ও বিকাশ লাভের প্রক্রিয়াকে সহজবোধ্য করে এবং উপজাতীয়দের একটি সংগ্রহশালা বা আর্কাইভ হিসেবেও কাজ করে। এখানে প্রতি বছর আয়োজিত হয় বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং কার্যকলাপ। আপনি যদি এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে চান, তাহলে আপনাকে আগে থেকে যোগাযোগ করে; সঠিক সময় অনুযায়ী ভ্রমণের দিন- কাল ঠিক করতে হবে। এই জাদুঘর শুক্রবার এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকে।
ভ্রমণের মাধ্যম
এই জাদুঘরও রাঙামাটি সদর উপজেলার প্রধান ফটকের কাছেই অবস্থিত। আপনি যেকোনো রিক্সা বা অটোরিক্সা নিয়ে খুব অল্প টাকায় পৌঁছে যেতে পারেন এই ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরে।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে রয়েছে কিছু মানসম্মত পিকনিকের স্থান এবং রেস্ট হাউস। তাছাড়া এই উদ্যানে ভ্রমণের সময় আপনি পেয়ে যাবেন বিভিন্ন প্রণীর দেখা। তার মধ্যে কিছু প্রাণী যেমন হরিণ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, হাতি, মাছ ধরা বিড়াল ইত্যাদি। এটি রাঙামাটির একটি অন্যতম পর্যটন স্থান এবং এতে রয়েছে মন ভোলানো প্রাকৃতিক স্পটসমূহ।
আপনি যদি রাঙামাটি’র সত্যিকার সৌন্দর্যের সর্বোচ্চ মোহময়তা উপভোগ করতে চান তবে, আপনার যাত্রার সময়কাল হলো অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস। এই সময় তাপমাত্রা কম থাকে এবং আপনার ভ্রমণ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ে স্থানসমূহে চলাচলও অনেক নিরাপদ। যদিও বর্ষার সময় এখানকার প্রকৃতি আরো সুন্দর রুপ ধারণ করে, কিন্তু বর্ষার সময় অনেক অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যা থেকে বেঁচে থাকাই নিরাপদ।
পাহাড়ি অঞ্চল বলে, বর্ষা এখানে আনতে পারে ভূমিধ্বস। তাই বর্ষার সময় এখানে আসা’র পরামর্শ সবাই দেয় না। আবার অনেক বর্ষাকালে কাপ্তাই ঝুলন্ত সেতু হালকা পানিতে ডুবে যায়। তখন এর সৌন্দর্য সেভাবে উপভোগ করা যায় না। তবে আপনি যখনই এখানে আসেন না কেনো, স্থানীয় আদিবাসী বা উপজাতীয়দের সাথে কথা বলে, তাদের ঐতিহ্য দেখে এবং তাদের সাথে সময় কাটানোর পরামর্শ আপনি নিতে পারেন। কেননা, তাদের সাথে কাটানো খুব অল্প একটু সময়ও হয়তো আপনার দৃষ্টিভঙ্গী বা জীবনযাপনে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
Leave a Reply