
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে খুলনা বিভাগের একটি জেলার নাম হল বাগেরহাট। এই জেলার দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার একটি হল প্রাচীন আমল থেকে এই জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বহু পৌরাণিক মসজিদ এবং এলাকাজুড়ে বিভিন্ন নদী’র প্রবাহ। মসজিদগুলো’র মধ্যে বেশিরভাগ মসজিদই জেনারেল খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত।
তাছাড়াও বাগেরহাটের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো হচ্ছে পানগুচি, গোসাইরখালী, মধুমতি নদী, মংলা নদী, পশুর নদী, দারাটানা, হরিণঘাটা, বলেশ্বর ও বাংড়া। বাগেরহাটের পুরাতন নাম ছিল খলিফাবাদ। এই জেলার প্রধান দর্শনীয় স্থানসমূহ হচ্ছে, প্রত্নতাত্ত্বিক মসজিদগুলো এবং এছাড়াও আপনি প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে চাইলে নদীসমূহের কূলগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। বাগেরহাট জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদন।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ। এটি বাগেরহাটের অদূরে ঘোড়া দীঘি নামক স্থানে অবস্থিত, যার দূরত্ব শহর থেকে মাত্র ৫কিলোমিটার। ১৬০৫ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বিস্ত্রিতএই মসজিদটি ১৫ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয় এবং এটি সমগ্র এশিয়া’র সবচাইতে সুন্দর মসজিদগুলোর মধ্যে একটি। সুলতানি আমলে অত্র এলাকার গভর্নর খান জাহান আলী এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সেই সময় সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাগেরহাট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
খান জাহান আলী নামক একজন সাধু জেনারেল অত্র এলাকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং ধর্মপ্রচারের কাজ শুরু করেছিলেন। তার ধর্মপ্রচারের পদ্ধতি খলিফাতাবাদ নামে পরিচিত ছিল। তিনি এই শহরকে ১২ টিরও বেশী মসজিদ তৈরি করে দিয়ে গেছেন। মসজিদ গুলোর মধ্যে শৈত- গুম্বাদ বা ষাট গম্বুজ মসজিদ সবচাইতে বড় এবং কেন্দ্রীয় মসজিদ ছিল। মসজিদের পাশাপাশি এটি সমাবেশ কক্ষ এবং মাদ্রাসা হিসেবেও ব্যবহৃত হতো।
মসজিদটিতে সর্বমোট ৭৭ টি গম্বুজ রয়েছে, যা এগারোটি করে ৭ সারিতে বিভক্ত এবং মসজিদের চার কোণায় চারটি গম্বুজ বা টাওয়ার রয়েছে যেগুলোর মধ্যে ২ টি আজান দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। মসজিদে এগারোটি খিলানযুক্ত দরজা এবং সাতটি জানালা রয়েছে। তারপরও মসজিদের ভিতরের অংশ তুলনামূলকভাবে অন্ধকার। এই মসজিদের নির্মাণ শৈলী তুঘলক স্থাপত্য-শৈলীর উদাহরণ। মসজিদের মোট গম্বুজ সংখ্যা ৭৭ টি হলেও তার মধ্যে ষাটটি পাথরের স্তম্ভ রয়েছে যা থেকে ষাট গম্বুজ নামটি এসেছে।
বাগেরহাট জাদুঘর
ষাট গম্বুজ মসজিদের নিকটে পুরাতন রুপসা হাইওয়ে রোড এর পাশে নির্মিত হয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর যৌথ সমন্বয়ে ১৯৯৫ সালে ৫২০ বর্গমিটার এলাকা নিয়ে জাদুঘরটি নির্মিত হয়। যদিও জাদুঘরটি সাধারণ জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এখানে প্রবেশের জন্য টিকেটের মূল্য ১৫ টাকা এবং শিশু-কিশোরদের জন্য মাত্র ৫ টাকা।
তাছাড়া সার্কভুক্ত বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য টিকেটের মূল্য ৫০ টাকা এবং অন্যান্য বিদেশী পর্যটকদের জন্য টিকেটের মূল্য ১০০ টাকা। শীতকালে সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা এবং গ্রীষ্মকালে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত এই জাদুঘর খোলা থাকে। রবিবার জাদুঘরটি বন্ধ থাকে। এই জাদুঘরে রয়েছে প্রাচীন মূর্তিসমূহ, শিলালিপি, অলংকার করা পোড়ামাটির ফলক, পোড়ামাটির তৈজসপত্র এবং বিভিন্ন বিরল পাথরের সংগ্রহ।
নয় গম্বুজ মসজিদ
জেনারেল খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত বাগেরহাটে আরেকটি ঐতিহাসিক মসজিদের নাম হলো নয় গম্বুজ মসজিদ। এই মসজিদটিও ১৫ শতকে নির্মিত। মসজিদটির অবস্থান ঠাকুর দীঘি ট্যাঙ্কের পশ্চিম পাশে। মসজিদের পাশেই রয়েছে খান জাহান আলির সমাধিস্থল। মসজিদের পাশে রয়েছে জিন্দাপীরের মসজিদ এবং মাজার যা এখন ধ্বংসাবশেষ রূপে চিহ্নিত।
মসজিদের কেন্দ্রস্থলে একটি বৃহৎ গম্বুজ রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় গম্বুজের চারপাশে আটটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। তাছাড়া মসজিদের চার কোণায় চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের নির্মাণ কাজ চলাকালীন সময় স্থাপনাতে সালফেট ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায় এবং এর ক্ষয় কমানোর উদ্দেশ্যে মসজিদটির যথাযোগ্য সংস্কার করা হয়।
সিঙ্গাইর মসজিদ
বাগেরহাট সদরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত হল সিঙ্গাইর মসজিদ যা বাংলাদেশের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এই মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদের ভিতরে একটি অলংকার করা মেহরাব রয়েছে এবং চারটি খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে। এই মসজিদের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে মসজিদের কার্ণিশগুলো বক্রাকার। মসজিদের দেয়ালগুলো প্রায় দুই মিটারের বেশি পুরো।
মসজিদে তিনটি দরজা রয়েছে এবং কোনাগুলো গোলাকারভাবে বর্ধিত। মসজিদের দেয়ালগুলোতে অলংকৃত পোড়ামাটির ফলক চোখে পড়ার মতো। উল্লেখ্য যে মসজিদে কোন শিলালিপি বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি, যা থেকে মসজিদ নির্মাণের সঠিক সময় নির্ধারণ করা যায়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এটিও ১৫ শতাব্দীতে নির্মিত এবং এর নির্মাণ কার্যের পরিচালনা করেছেন খান জাহান আলী।
.১৯৭০ দশকের শুরুর দিকে মসজিদটিকে পুরোপুরি ধ্বংসস্তুপ বলে ধরে নেয়া হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সিঙ্গাইর মসজিদ সংস্করণের দায়িত্ব নেয়। যদিও মসজিদটির সংস্করণ করা হয়েছে, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক জোহানা ই.ভ্যান লোহুইজেন ডি লিউ এর রিপোর্ট অনুসারে, মসজিদের কোনার টাওয়ারগুলো খুব ভঙ্গুর অবস্থায় টিকে রয়েছে।
চুনা খোলা মসজিদ
বাগেরহাট ষাট গম্বুজ মসজিদের উত্তর-পশ্চিমে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে চুনাখোলা গ্রামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির কাঠামো তৈরি হয়েছে ইট দিয়ে এবং এর দেয়াল ২.১৪ মিটার পুরু। প্রাচীরের ভেতর তিনটি খিলানযুক্ত মেহরাব রয়েছে। কিবলার অভ্যন্তরে কেন্দ্রীয় মেহরাবটি চতুষ্কোণাকৃতির এবং উচ্চতা ছাদ পর্যন্ত।
খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত অন্যান্য মসজিদগুলোর মত এই মসজিদেরও চার কোণায় চারটি বৃত্তাকার ছাদযুক্ত টাওয়ার রয়েছে। মসজিদের অলংকরণ করা হয়েছে পোড়া মাটির ছাঁচ এর সাহায্যে। অলঙ্করণগুলো এখন মিহরাব, কুলুঙ্গি, খিলানপথ এবং বাঁকা কার্নিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মসজিদের নকশা সমৃদ্ধশালী এবং বৈচিত্র্যময় করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে জালি’র কাজ, প্রচলিত ঝুলন্ত মোটিফ, ফুলের স্ক্রল, ইন্টারলকিং সার্কেল, রোসেট, ইত্যাদি।
হযরত খাজা খান জাহান আলী’র মাজার
বাগেরহাটের নয় গম্বুজ মসজিদের পাশেই অবস্থিত হযরত খাজা খান জাহান আলীর মাজার। তার সমাধি নির্মিত হয়েছে খাঞ্জেলী দীঘির উত্তর তীরে, উঁচু জমিতে। উল্লেখ্য যে মাজারের ভিতরে একটি পাথরের বেদীতে সংরক্ষিত রয়েছে খান জাহান আলীর দেহাবশেষ। এই সমাধি বা মাজারের স্থাপত্য কৌশল অনেকটাই ষাট গম্বুজ মসজিদের সাথে মিলে যায়।
মসজিদে অবস্থিত ফলকে তার মৃত্যুর তারিখ, দাফন এর তারিখ, আল্লাহর নাম এবং কুরআনের কয়েকটি সূরা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মসজিদের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, দেশ-বিদেশ থেকে হাজার হাজার ভক্ত আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ লাভ করার আশায় এই মাজারে আসেন। তাছাড়াও প্রতিবছর চৈত্র মাসে এখানে বিশাল মেলা বসে। শিলালিপি থেকে খান জাহান আলীর সাধারণ পরিচয় পাওয়া গেলেও তার বিস্তারিত পরিচয় এখনো অজানা। তবে ধারণা করা হয় যে তিনি তুর্কি পরিবারের সন্তান ছিলেন।
ঘোড়া দীঘি
ঘোড়া লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খান জাহান আলী যখন তিনি প্রথম এই অঞ্চলে পদার্পণ করেন তখন তার সৈন্যদের জন্য একটি ব্যারাক তৈরি করেন এবং সেই অঞ্চলের নাম হয়ে ওঠে ব্যারাকপুর। পরবর্তীতে তাদের প্রয়োজনীয় খাবার পানি সরবরাহের জন্য একটি দীঘি খনন করা হয় যা ঘোড়া দীঘি নামে পরিচিত। এর নামকরণের পিছনে অনেকগুলো কাহিনী রয়েছে। একটি সূত্রে জানা যায় যে, খান জাহান আলী নিয়মিত ঘোড়ায় চড়ে এই পুকুর প্রদক্ষিণ করতেন বলে এর নাম দেয়া হয়েছিল ঘোড়া দীঘি।
আরেকটি প্রবাদ অনুসারে, একটি ঘোড়া এক দৌড়ে যতদূর পর্যন্ত যেতে পারত ততদূর পর্যন্ত এই বিশাল দীঘি খনন করা হয়। এজন্য এই দীঘির নাম হয় ঘোড়া দীঘি। প্রকাণ্ড এই দিঘিতে সারাবছর পানি থাকে। এই দীর্ঘ হচ্ছে প্রায় ২,০০০ ফিট, প্রস্থ ১,২০০ ফিট। এর গভীরতা ২০ থেকে ২৫ ফুটের মধ্যে থাকে। এই বিশাল জলাশয় দেখতে অনেক পর্যটক এখানে আসেন। তবে আরেকটি নামকরণের গল্প দিয়ে এই দিঘি সম্পর্কে লেখা শেষ করতে চাই। গল্পটি হলো এরকম যে, দীঘি খননের আগে খান জাহান আলীর সৈন্যদের কুচকাওয়াজ এবং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা এই স্থানে আয়োজিত হত বলে এই নামকরণ।
ঢাকা থেকে বাগেরহাট যাবার জন্য সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে আন্তঃনগর ট্রেন, চিত্রা এক্সপ্রেস এবং সুন্দরবন এক্সপ্রেস। আপনি যদি বাগেরহাটের রাত কাটাতে চান বা থাকতে চান তাহলে এখানে বেশ কিছু সুবিধাজনক হোটেল রয়েছে; যেমন- মমতাজ হোটেল, আল আমিন, হোটেল মোহনা, হোটেল অভি, ইত্যাদি।
Leave a Reply