ভোলা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ভোলা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ভোলা হচ্ছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীপ এবং একমাত্র দ্বীপ যা জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বরিশাল বিভাগের একটি প্রশাসনিক জেলা হল ভোলা। ভোলা বাংলাদেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান কারণ, এখানে একটি গ্যাস পাওয়া গেছে যা বাংলাদেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ সরবরাহে ভূমিকা রাখে। পূর্বে ভোলা জেলার নাম ছিল আশুতোষ। পরিব্রাজক জে. সি. জ্যাক তার জার্নাল ”বাকেররগঞ্জ গেজেটিয়ার”- এ উল্লেখ করেছেন যে, ১২৩৫ সালে এই দ্বীপটি আবিস্কৃত হয় এবং ১৩০০ সাল থেকে এখানে মানুষের চাষাবাদ এবং বসবাস শুরু হয়।

১৫০০ খ্রীস্টাব্দে এখানে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা এখানে ঘাঁটি গড়ে তোলে। ১৮৬৯ সাল এর পূর্বে পর্যন্ত ভোলা দ্বীপটি নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৮৬৯ সালে ভোলাকে মহকুমা হিসেবে বরিশাল জেলার অন্তর্গত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ভোলা বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়।

জ্যাকব টাওয়ার

২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ভোলা জেলার চরফ্যাশন নামক উপজেলায় এই পর্যটন ওয়াচ টাওয়ারটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চারপাশের প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই টাওয়ার থেকে উপভোগ করা যায়। এই টাওয়ারটি আইফেল টাওয়ার সদৃশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এবং এটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচাইতে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। গঠন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এটি ১৬ তলা একটি ওয়াচ টাওয়ার, যার প্রত্যেক তলার ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৫০ জন এবং সব মিলিয়ে একসাথে ৫০০ জন পর্যন্ত পর্যটক এই টাওয়ারে একসাথে অবস্থান করতে পারেন।

২০১৩ সালে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই টাওয়ার এর নির্মাণ প্রকল্প শুরু করা হয়। টাওয়ারটি ২২৫ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এবং এর স্থপতি হচ্ছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থপতি কামরুজ্জামান লিটন। এই টাওয়ারটি ৬ রিখটার স্কেল মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করতে সক্ষম। এখান থেকে আপনি একই সাথে তারুয়া সমুদ্র সৈকত, চর কুকরি- মুকরি, স্বপ্নদ্বীপ, মনপুরা সমুদ্র সৈকত, চর পিয়াল, বঙ্গোপসাগর ও নিঝুম দ্বীপ দেখতে পারবেন। আপনি ভ্রমণের সময় যদি একটি দূরবীন বা বাইনোকুলার সঙ্গে নিয়ে যান, সেক্ষেত্রে আপনার আশেপাশের প্রাকৃতিক সমারোহ দেখতে সুবিধা হবে এবং আপনার ভ্রমণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

চর কুকরি – মুকরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

ভোলার চরফ্যাশন থানার অন্তর্গত, বাংলাদেশের অন্যতম বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হচ্ছে চর কুকরি- মুকরি অভয়ারণ্য। অনেকে একে চরফ্যাশন বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বলেও চেনে। এটি একটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, যা স্বভাবগতভাবেই প্রতিদিন দুইবার জোয়ারের শিকার হয়। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে এখানে মানব সমাজের বসবাস শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে দ্বীপটি প্রলয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়, যা এখানকার বসতবাড়িকে ধংস করে মানুষের বসবাসের  অনুপোযোগী করে তোলে।

পরবর্তীতে সার্বিক সহায়তায় ১৯৭৪ সালে এখানে নতুন করে মানুষের বসবাস শুরু হয়; যাদের মূল পেশা ছিল মৎস্য শিকার ও কৃষিকাজ। ১৯৮১ সালে এই স্থানকে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমগ্র অভয়ারণ্যটিতে প্রায় ২৭৭ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৩৩ টি গুল্ম, ৯১ টি বৃক্ষ, ৩৫ টি লতানো এবং ১১৮ টি ভেষজ প্রজাতির উদ্ভিদ। গেওয়া, খালিশা এবং ক্যাট টেইল হচ্ছে এই বনাঞ্চলের প্রধান উদ্ভিদ। বনাঞ্চলের পাশাপাশি এখানে মোহনা ও রয়েছে এবং জঙ্গলের মাঝের বিভিন্ন স্থানে উন্মুক্ত মাটির ফ্ল্যাট রয়েছে। সুতরাং, খুব সহজেই বলা যায় যে এখানকার ভ্রমণ আপনার প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে।

সাগর কান্না মনপুরা সমুদ্র সৈকত

শুধু বাংলাদেশ নয় বরং দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রবাস পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে মনপুরা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্যের কাহিনী। এখানে রয়েছে বহু প্রজাতির গাছ, নীল জলরাশি, মোহনা, হরিণের পাল, ঝাকে ঝাকে উড়ে-আসা দেশ- বিদেশের পাখি এবং জেলেদের মাছ ধরার সংগ্রামের দেখার সুযোগ। সার্বিকভাবে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, যে  কারো মনে দীর্ঘ সময়ের জন্য দাগ কাটতে সক্ষম। এটি ভোলা জেলা শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ পূর্বে মনপুরা থানায় অবস্থিত। এখানকার সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ঘন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বন বিভাগের উদ্যোগে এখানে নতুন করে গড়ে ওঠা ৮- ১০ টি চরে বনায়নের বিপ্লব ঘটানো হয়েছে। চরগুলো বিচ্ছিন্ন হবার কারণে, শতশত অতিথি পাখির জন্য এটি একটি অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। এখানকার  চরগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চর পাটালিয়া, চর নিজাম, চর পিয়াল, চর সামসুদ্দিন, ডালের চর, লালচর, কলাতলীর চর, চর তাজাম্মুল, ইত্যাদি।

মনপুরা সমুদ্র সৈকতের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখান থেকে একই দিগন্তে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। এখানে অনেক খাবার পাওয়া যায় যাওয়া যা দেশের অন্যান্য স্থানে প্রাপ্ত খাবার গুলোর চাইতে আলাদা, বৈচিত্রময় এবং অনেক বেশি সুস্বাদু। এখানকার বিশেষ খাবার গুলো হচ্ছে তাজা ইলিশ ভাজা, ওয়াকিং ক্যাটফিশ, হাঁস, মহিষের কাঁচা দুধের তৈরি টক দই, গলদা চিংড়ি এবং কোরাল মাছ।

তারুয়া সমুদ্র সৈকত

ভোলা জেলার সর্বদক্ষিণে চরফ্যাশন থানায় তারুয়া সমুদ্র সৈকত এর অবস্থান। এই সমুদ্র সৈকতটি প্রায় ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর একপাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ চারণভূমি এবং অন্য পাশে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগর। এখানকার অন্যান্য বনাঞ্চলের মত, চারণভূমির শেষ প্রান্তে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল উপস্থিত। এখানকার উল্লেখযোগ্য প্রাণীবৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হরিণ, বানর, বন্য মহিষ, লাল কাঁকড়া, ইত্যাদি।

এখানকার প্রকৃতিতে রয়েছে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা যা মানুষের মনকে মোহময় করে তোলে। এখানকার প্রকৃতি যেন বিধাতার নিজ হাতের কারুকার্যময় অলংকরণ। আপনি যদি ভোলা ভ্রমণ করতে চান সে ক্ষেত্রে তারুয়া সমুদ্র সৈকত না দেখলে অনেক বড় মিস করবেন। যারা অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় তারা এখানে এসে হাইকিং এবং ক্যাম্পিং করতে পারেন। এখানকার স্থানীয় মানুষরাও অতিথিপরায়ন এবং আপনার অ্যাডভেঞ্চারকে স্বাগত জানানোর মত আন্তরিক।

তেঁতুলিয়া নদী

ভোলা জেলায়  প্রবাহমানরত, মেঘনা নদী থেকে উৎপন্ন একটি নদী হচ্ছে তেতুলিয়া নদী। এই নদীটি ভোলা জেলাকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করেছে। নদীটির সর্ব মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৪ কিলোমিটার। নদীটি মেঘনা নদী থেকে, ভোলা জেলার তেতুলিয়া, কালাইয়া, নিমদী ও পূর্ব মুনিয়া দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গলাচিপা থানার রাঙ্গোপালদিতে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই নদীর মোহনাটি অত্যন্ত সুন্দর একটি পর্যটন স্থান। নদীর উপকূলবর্তী অনেকগুলো স্থান পর্যটনের জন্য জনপ্রিয়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গঙ্গাপুর বাজার, ধুলিয়া বাজার, কালাইয়া বন্দর, মণিপুর বাজার, দাশমুনি বাজার, ইত্যাদি।

নিকট অতীতেও নদীটি স্রোতস্বিনী ছিল, কিন্তু বর্তমানে পলি পড়ার কারণে এবং বিনুনি পড়ার কারণে; নদীর প্রবাহ ক্ষীয়মান হয়ে এসেছে। অন্যদিকে নদীটি  ক্ষয়প্রবণতা প্রদর্শনের কারণে নিকটবর্তী গলাচিপা ও বাউফল উপজেলার বেশকিছু স্থান ভয়ঙ্কর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। যদি নদীর বিভিন্ন তটে গড়ে ওঠা চর এবং দ্বীপগুলোতে স্থানীয়রা চাষাবাদ শুরু করেছে কিন্তু নদীর প্রবহমান ধারা বজায় রাখতে না পারলে বর্ষাকালে নদীটি সংহারী রূপ ধারণ করতে পারে। আশা করি বাংলাদেশ সরকার এই নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার্থে এর জলধারা সচ্ছল করে, সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাবে এবং পর্যটন শিল্পকে আরো সম্ভাবনাময় করে তুলবে।

যাত্রা ও আবাসন

ঢাকা থেকে ভোলার দূরত্ব হচ্ছে প্রায় ২৮০ কিলোমিটার। আপনি চাইলে বাস এবং লঞ্চে, খুব অল্প বাজেটে ভোলা ঘুরে আসতে পারবেন। ভোলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন জায়গায়  ভ্রমণের জন্য সবচাইতে উপযুক্ত যাতায়াত মাধ্যম হচ্ছে নৌকা বা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার। বাসের যাত্রাপথ প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা দীর্ঘ, আর আপনি যদি বিমান পথে ভোলা যেতে চান সে ক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে বিমানে বরিশাল পৌঁছাতে হবে এবং বরিশাল থেকে ১০০ টাকার কম ভাড়ায় আপনি খুব সহজেই ভোলা পৌঁছে যেতে পারবেন।

ভোলাতে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি আধুনিক মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে  প্রমুখ হোটেলগুলো হচ্ছে কুকরি রেস্টুরেন্ট এন্ড পার্টি সেন্টার, হোটেল বেঙ্গল ব্লুবেরি,  হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল বে আইল্যান্ড এবং হোটেল টং।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*