বগুড়া জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বগুড়া জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

রাজশাহী বিভাগের অন্যতম প্রধান শহর হচ্ছে বগুড়া। অনেকে এটিকে উত্তরাঞ্চলের একটি প্রধান বাণিজ্যিক শহর বলে। ব্রিটিশ শাসনামলের পূর্বে বগুড়া ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী এবং সে সময় এই শহরকে বলা হত পুন্ড্র নগরী। এই শহরে বাংলাদেশের প্রধান তিনটি পুরাকেন্দ্রগুলোর একটি অবস্থিত যা মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। বগুড়া শহরের দর্শনীয় স্থানসমূহ এবং পর্যটন কেন্দ্রসমূহ নিয়ে এই প্রতিবেদন।

মহাস্থানগড়

বাংলাদেশের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের অন্যতম নিদর্শন হলো মহাস্থানগড়। প্রাচীন শহর পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গঠিত এই গড়। বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। প্রথমবারের মতো এর উৎড়পত্তি সম্পর্কে লিখা ছিল ১৩ শতকের একটি গ্রন্থে যা বল্লালচরিত দ্বারা নিবন্ধিত। প্রাচীন গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, এই অঞ্চলকে বলা হত পুন্ড্রদের দেশ বা পুন্ড্রদের নগরী। পুন্ড্র অঞ্চল ছিল মৌর্য আমলে সমগ্র বাংলার রাজধানী এবং মহাস্থানগড়কে পুন্ড্রবর্ধন বলে ডাকা হতো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে খিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মহাস্থানগড় প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই গড়ে বা নির্মাণে খননের ফলে বহু শিলালিপি ও নিদর্শনসমূহ আবিস্কৃত হয়েছে এবং সেসব মহাস্থানগড় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাদুঘরে রয়েছ টেরাকোটার ফলক যাকে সাধারণভাবে মানুষজন পোড়ামাটির ফলক বলেও চেনে। তাছাড়াও বহু মুদ্রা এখান থেকে আবিস্কৃত হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে খ্রীস্টপূর্ব ১ম ও ২য় শতাব্দীর সময় ব্যবহৃত রৌপ্যমুদ্রা ও অলিখিত তামার মুদ্রা যা ঢালাই করা। নিকটবর্তী বামনপাড়া গ্রামে খননকার্যের সময় গুপ্তযুগের দুটি মুদ্রা পাওয়া যায় এবং ১৪ থেকে ১৫ শতাব্দীর মধ্যেকার অনেক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে। আরও রয়েছে ব্রিটিশ আমলের বহু মুদ্রা।

মহাস্থানগড়ে আরও কিছু অংশ দিয়ে গঠিত যেগুলো হল তোতারাম পন্ডিতের ধাপ, মানকালির ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ, খোদারপাথর ভিটা, বৈরাগীর ভিটা, নরপতির ধাপ, স্কন্ধের ধাপ, খুলনার ধাপ, ইত্যাদি। স্থানটি অনেক বড় ও বিস্তৃত হবার কারণে পরিচয়ের সুবিধার্থে এসব নামকরণ করা হয়েছে। মহাস্থানগড় জাদুঘর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে এবং গ্রীষ্মকালে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস হচ্ছে এখানকার জন্য প্রযোজ্য গ্রীষ্মকালীন সময় এবং অক্টোবর থেকে মার্চ হলো শীতকালী সময়।

মোহাম্মদ আলী প্যালেস মিউজিয়াম এবং পার্ক (পূর্বনাম- কারুপল্লী)

এটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়কালের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল। এটি প্রায় ২০০ বছর পুরাতন প্রাসাদ। নবাব মুহাম্মদ আলী এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন যা এখনো বগুড়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে বিবেচিত। এটি বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার নিকটে সার্কিট হাউস এলাকায় অবস্থিত এবং করতোয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর বিস্তার প্রায় ১২ একর।

এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি এবং শিশুদের জন্য খেলনা বা রাইড। দীর্ঘ সময় ধরে এই স্থান কারুপল্লী নামে পরিচিত ছিল। এখানকার ভেতরের জাদুঘওে সুসজ্জিত রয়েছে পুরা মূর্তির সংগ্রহ, বন্দুক, যুদ্ধের বর্ম, বর্শা, প্রাচীনকালে ব্যবহৃত জানালা, তৈজসপত্র, নবাবের সময় ব্যবহৃত পোশাক, ইত্যাদি। তবে ২০১৬ সালে স্থানীয় পৌরসভা এই স্থানকে তিন জন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রয় করেন।

তারপর থেকে এটি পর্যটকদের প্রবেশ ফি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যদিও ব্যবসায়ীর চাচ্ছেন এখানে বাণিজ্যিক শপিং মল তৈরি করতে কিন্তু স্থানীয় প্রতœতত্ত¡ বিভাগ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আর আপনি যদি যাদুঘরে প্রবেশ করেন তবে আপনাকে একটি অদ্ভুত শর্ত মানতে হতে পারে যা হল, আপনি একটি ঘর পার হয়ে অন্য ঘরে গেলে আর আপনি আগের ঘরে ফিরে আসতে পারবেন না। সুতরাং, যা যা দেখার একবারেই দেখে নিন কারণ অন্যথায় আপনাকে আবার টিকেট কেটে নতুন করে যাদুঘরে ঢুকতে হবে।

বগুড়া এডওয়ার্ড পার্ক

ব্রিটিশ মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পুত্র অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড এর নামানুসারে এই পার্কটির নামকরণ করা হয়। বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণকারী একমাত্র নবাব আব্দুস সুবহান চৌধুরীর ব্যক্তিগত অর্থায়নে এবং কিছু সরকারি সহায়তার দ্বারা ১৯০৫ সালে এই পার্কটি নির্মিত হয়। এই পার্কে রয়েছে কৃত্রিম ফোয়ারা, কৃত্রিম পাহাড় এবং গ্রীন হাউস। বর্তমানে অবশ্য গ্রীন হাউসটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং উক্ত স্থানে একটি ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

যদিও এখনো পর্যাপ্ত গাছ এবং সবুজে ঘেরা পার্কটি। এখানে রয়েছে বিনোদনের জন্য ফুটবলের মাঠ এবং টেনিস গ্রাউন্ড। পাকিস্তান শাসনামলে এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সবচাইতে সুন্দর দর্শনীয় স্থান এবং প্রচুর দেশী ও বিদেশী পর্যটক এখানে আসতেন। নিকট অতীতে এই পার্কেও সংস্কার সাধিত হয়েছে এবং বর্তমানে এই পার্কটি বগুড়া শহরবাসী এবং পর্যটকদের জন্য অন্যতম প্রমোদ কেন্দ্র।

বিহারের ধাপ

এটি বগুড়ার শিবগঞ্জে করতোয়া নদীর নিকট অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এই মঠটি পন্ডিত তোতারামের বসত ভিটা হিসেবে পরিচিত। এই স্থানটি দৈর্ঘে প্রায় ৮০০ মিটার এবং প্রস্থে ৬০০ মিটার। এর তিনপাশ ঘিরে করতোয়া নদী প্রবাহিত হচ্ছে এবং বাকি একপাশ হল মঠে প্রবেশের প্রধান ফটক। হিউয়েন সাং এবং আলেকজান্ডার কনিংহামের মতো বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে পদার্পন করেছিলেন। এটি মহাস্থানগড় হতে মাত্র চার কিলোমিটার দক্ষিণ- পশ্চিমে অবস্থিত।

বেহুলা লক্ষীন্দরের বাসরঘর বা গোকুল মেধ বা লক্ষীন্দর মেধ

এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং এই স্থানকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে বিভিন্ন উপকথা। মহাস্থানগড় থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে গোকুল গ্রামে এই মেধ আবিস্কার করা হয়। লোককাহিনী অনুসারে এই স্থানটি ছিল বেহুলা এবং লক্ষীন্দরের একান্ত কক্ষ। এই স্থানকে ঘিরে যাবতীয় পালাগান এবং উপকথার বই স্থানীয় এলাকায় বিক্রয় করা হয়, যা থেকে আপনি সেসব পুরাতন কাহিনী জানতে পারবেন।

পরবর্তীতে ৭ম শতাব্দীতে এটি বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের একটি নিদর্শন যা প্রত্নতাত্ত্বিক এন. জি. মজুমদার দ্বারা খননের ফলে ১৯৩৬ সালে উদ্ধার করা হয়। ১৭২ টি অন্ধকোষের সাহায্যে পুরো স্থাপনাকে ভিত্তি দেয়া হয়েছে। এখান থেকে আবিস্কৃত হয়েছে সোনার পাতা, পাথরের খন্ড, পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি। এর পাশে রয়েছে একটি বর্গাকার মন্দির এবং ফলক থেকে জানা যায় যে, এই স্থান কোনো এক সময় শিব মন্দির হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে ভাষার পার্থক্যের কারণে এবং মূল ভাষা অজানা হবার কারণে ফলকগুলোর সকল তথ্য আবিস্কার করা সম্ভব হয় নি।

গোবিন্দ ভিটা

মহাস্থানগড়ের উত্তর পাশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র মন্দিরের স্থান হিসেবে চিহ্নিত হলো গোবিন্দ ভিটা। এটি একটি উঁচু ঢিবি যার উত্তর ও পূর্ব দিক দিয়ে করতোয়া নদী প্রবাহিত হচ্ছে। ১৮২৯ সালে কে. এন. দীক্ষিত এই স্থানের আবিস্কার করেন এবং ১৯৬০ সালে নাজিমুদ্দিন আহমেদের তত্ত¡াবধানে এখানে গভীরভাবে খননকার্য করা হয়। ধারণা করা হয় যে, এই মন্দিরটির পশ্চিম অংশ ৬ শতকে নির্মিত।

কে. এন. দীক্ষিতের খননের সময় এই মন্দিরের পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশ উন্মোচিত হয়। তবে পশ্চিমাংশের মন্দিরের উপরে আরেকটি ছোট মন্দির রয়েছে যা ধারণা করা হয় যে ১১ শতাব্দীতে নির্মিত। অনেক পুরাতন স্থাপনা হবার কারণে এর ভিতরের অংশ মাটি দিয়ে ভরাট এবং একে বেষ্টিত রয়েছে তিনটি গ্রেডেড সোপান। কয়েকটি অন্ধ কোষের দ্বারা এর ভিত্তি নির্মিত যা একটি বড় মন্দিরকে সাপোর্ট দেয়ার কাজ করে। আপনি মহাস্থানগড় দেখতে গেলে, গোবিন্দ ভিটাও ভ্রমণ করে আসতে পারেন।

যদি আপনি বগুড়া ভ্রমণ করতে চান তাহলে ঢাকা থেকে আপনি সহজেই অনেক বাস সার্ভিস পেয়ে যাবেন যা সরাসরি বগুড়াগামী। বগুড়াতে গেলে সেখানকার দই এবং মিষ্টান্ন অবশ্যই পরখ করে দেখতে ভুলবেন না। বগুড়াতে আপনার থাকার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত স্থান হচ্ছে হোটেল নাজ যা আন্তর্জাতিক সেবা প্রদান করে থাকে। তাছাড়াও রয়েছে বগুড়া পর্যটন মোটেল এবং বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় গেলে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় সবকিছুরই খোঁজ পেয়ে যাবেন।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*