ফরিদপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ফরিদপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ফরিদপুর ঢাকা বিভাগের অধীনস্থ একটি জেলা। যদিও মূল ঢাকা থেকে জেলাটি পদ্মা নদীর দ্বারা বিভক্ত। ফরিদপুর বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই জেলায় প্রচুর পরিমাণে পাট, ধান এবং অন্যান্য কৃষিজ পণ্য উৎপাদিত হয়। ফরিদপুরের পাশে অনেকগুলো পাটকল ছিল এবং সবগুলোই উৎপাদনশীল অবস্থায় ছিল। কিন্তু বর্তমানে তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি চালু আছে।

এই জেলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। সেগুলো হচ্ছে পদ্মা, মধুমতি এবং কুমার নদী। এই জেলায় রয়েছে বেশকিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পাথরাইল মসজিদ, মথুরাপুর দেউল, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার, কবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি, ইত্যাদি।

যেসব মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য কামনা করেন, তাদের মানসিক প্রশান্তির জন্য রয়েছে শ্রীঅঙ্গন; যা ফরিদপুর শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত। শহরের অলিগলিও ঘুরে দেখার মত। ফরিদপুর জেলায় যেসব ভ্রমণের স্থান রয়েছে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রসমূহ রয়েছে তাদের বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো,

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ জাদুঘর ও পাঠাগার

বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ বাংলাদেশের একজন বীরশ্রেষ্ঠ ছিলেন। যুদ্ধের সময় অসাধারণ কৃতিত্ব ও তার সাথীদের বাঁচানোর জন্য আত্মত্যাগ এর কথা স্মরণ করে যুদ্ধ শেষে তাকে বীরশ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হয়। ২০০৮ সালে ফরিদপুরের মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ জাদুঘর ও পাঠাগার স্থাপন করা হয়। এই জাদুঘর ৫৩৫ বর্গফুট এলাকা জুড়ে অবস্থিত।

জাদুঘর এর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুনদের কাছে তুলে ধরা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করা। মুক্তিযুদ্ধের বই ছাড়াও এখানে রয়েছে বিভিন্ন মনীষীর জীবনী, বিজ্ঞান এবং তথ্য প্রযুক্তির বইসমূহ, ধর্মীয় বই, কাব্য, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি। জাদুঘরটিতে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ এর ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহ রয়েছে।

ফরিদপুর পৌর শেখ রাসেল শিশু পার্ক

পৌর শেখ রাসেল শিশু পার্ক ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ডের নিকটে ঢাকা- ফরিদপুর হাইওয়ের পাশে অবস্থিত। এটি একটি মাঝারি আকারের ফ্যান্টাসি পার্ক। এটি শহরের একমাত্র পার্ক যেখানে আনন্দদায়ক ও বিনোদনমূলক ৭- ৮ টি রাইড রয়েছে। সাথে রয়েছে ছোট একটি চিড়িয়াখানা। তাছাড়া এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ অনেক সুন্দর যা দেখে বোঝা যায় যে পার্কের রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করা হয়েছে।

কয়েকটি বিশ্ব- বিখ্যাত স্থাপনার প্রতিলিপি রয়েছে এখানে। যেমন আইফেল টাওয়ার, স্ট্যাচু অফ লিবার্টি এবং একটি টি- রেক্স ডাইনোসর। ছোট চিড়িয়াখানাটিতে অল্প কয়েকটি প্রাণী রয়েছে, যেমন- হরিণ, বানর, এবং কিছু পাখি। পার্কের রাইড গুলো তুলনামূলকভাবে বেশি ব্যয়বহুল। পার্কে বিশ্রামের জন্য এবং খাবারের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এখানকার খাবারের মান দামের তুলনায় কম।

মথুরাপুর দেউল

এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য নির্মিত একটি মন্দির। ফরিদপুরের মধুখালী থানায় অবস্থিত এই স্থাপনাটি অষ্টভুজাকৃতির এবং তৈরি হয়েছে পোড়ামাটি দিয়ে। এটি ১৭ শতকের একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন।

কবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি এবং জন্মস্থান

বাংলাদেশের পল্লী কবি নামে পরিচিত হলেন কবি জসীম উদ্দীন। তার নাম পল্লী কবি হওয়ার কারণ হল তিনি গ্রাম ও গ্রামীণ মানুষের সম্পর্কে কবিতা লিখতেন। কবি জসীমউদ্দীন এর গ্রামের বাড়ি শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে অম্বিকাপুর গ্রামে অবস্থিত। বর্তমান সময়ে তার বাড়িটিকে রূপান্তর করা হয়েছে এবং এটিকে একটি জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে। এ জায়গাটি শহরের একটি অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। এখানে এসে দর্শনার্থীরা কবি জসীমউদ্দীনের কাজ এবং ব্যক্তিগতভাবে কবিকে জানতে পারেন। অনেকে কবি’র গ্রামকে উপভোগ করতেও আসেন।

পাথরাইল মসজিদ

ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত পাথরাইল মসজিদ। এই মসজিদটি প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো। এই প্রত্নতাত্ত্বিক মসজিদটি একটি বড় দিঘির পাড়ে অবস্থিত, এজন্য অনেকে একে দিঘীরপাড় মসজিদ নামেও চেনে। মসজিদের আশপাশের গ্রামের প্রকৃতিও মনমুগ্ধকর। তবে আপনার যদি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার ইচ্ছা থাকে তাহলে ফরিদপুর অঞ্চলে এলে আপনি হয়তো পাথরাইল মসজিদ না দেখে যেতে চাইবেন না।

কুমার নদী

ফরিদপুর শহরের অন্যতম প্রধান নদী হল কুমার নদী। শহরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত এই নদীতে অতীতে ভালো মাপের পানির প্রবাহ থাকলেও, বর্তমানে নদীতে জল প্রবাহ কমে গেছে। তবে নদীর তীর ধরে শহরের বাইরে গেলে নদী’ট আসল সৌন্দর্য এবং বাংলার সবুজের ছোঁয়া খুঁজে পাবেন।

মধুমতি নদী

বাংলাদেশের সুন্দরতম নদীগুলোর মধ্যে মধুমতি নদী অন্যতম। এই নদী’র একাংশ ফরিদপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এজন্য ফরিদপুর যদি আপনি ভ্রমণের জন্য এসে থাকেন, তবে মধুমতি নদী, এর বিভিন্ন পাড় ও তার আশপাশের সৌন্দর্য দেখে যেতে পারেন।

মাওয়া ফেরিঘাট

বর্তমানে মাওয়া ফেরিঘাটের এখন ব্যবহার কমেছে, তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু। যদিও পদ্মা সেতু প্রশাসনিকভাবে মুন্সিগঞ্জ জেলার ভিতরে পড়ে কিন্তু ইতিপূর্বে গোয়ালন্দ থেকে পাটুরিয়ার মধ্যে চলাচলের জন্য একমাত্র উপযুক্ত ভ্রমণের উপায় ছিল ফেরি পারাপার। এই ফেরিঘাট থেকে পদ্মা নদীর উপর মনোরম সূর্যাস্ত দেখা যায়। আপনি যদি সঠিক সময়ে আসতে পারেন তাহলে প্রকৃতির এই নিখুঁত সৌন্দর্য নিজ চোখে উপভোগ করে যেতে পারেন।

ফরিদপুর জাদুঘর

ফরিদপুর জাদুঘরটি ফরিদপুর শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং আলিমুজ্জামান হল নামেও পরিচিত। আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের ছোট জাদুঘর গুলোর মধ্যে পরে। এটি শহরের একটি ল্যান্ডমার্ক বলে যেকোনো বাহক বা মানুষকে বললে সহজেই এর অবস্থান খুজে চলে আসা যায়। এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে।

জাদুঘর উপরের অংশ দেখতে অনেকটা গম্বুজের মত। যদিও এর গঠন বৈশিষ্ট্য দেখলে বুঝা যায় যে, এটি পারস্য শৈলী অনুরুপে নির্মিত। অনেকে এটিকে আরব্য স্থাপনা শিল্পের প্রতিলিপি হিসেবেও ধারণা করে থাকেন। জাদুঘরের পাশে রয়েছে জসীমউদ্দীন হল। জসীমউদ্দীন হলে ছুটির দিনগুলোতে নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

ঢোলার মোড়

স্থানটি ফরিদপুরের সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটন স্থলগুলোর মধ্যে একটি। এটিকে পদ্মা নদীর একটি চ্যানেল এর তীরে অবস্থিত। অনেক মানুষ সন্ধ্যাকালীন প্রকৃতি, সেখানকার স্নিগ্ধতা এবং প্রকৃতির মাঝে বিশ্রামের জন্য এখানে আসেন। তাছাড়াও এখানে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়, যেমন- ঝালমুড়ি, ফুচকা, আচার, ইত্যাদি। এখান থেকে আপনারা পদ্মা নদীতে নৌকা ভ্রমণ করতে পারেন এবং একই সাথে সৌন্দর্য উপভোগ করে ফিরে ফিরে আসতে পারেন। এজন্য এখানে ভাড়া করা নৌকা পাওয়া যায়।

তাছাড়া নদীতে ভ্রমণ করে একটি চরে পৌঁছানো যায়। সেখানেও হালকা নাস্তার ব্যবস্থা ও দোকান রয়েছে। এত দূরে বসে চা এর আনন্দ নেয়া এবং নদীর শীতল সতেজ বাতাস অনুভব করে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। এখানকার সার্বিক পরিবেশ এবং ও প্রাকৃতিক দৃশ্য আপনাকে মানসিক মুগ্ধতা এবং প্রশান্তি দিতে সক্ষম। বর্তমানে নদীর নিচে থাকে বালি তুলে বিক্রয় করা হয় জন্য এখানকার ব্যবসায়িক গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

জগদ্বন্ধু শ্রী অঙ্গন

ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামট এলাকায় শ্রী অঙ্গন নামক একটি হিন্দু আশ্রম প্রতিষ্ঠিত। এটি’র স্থাপনা হয় বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৩০৬ সালে। শ্রী জগদ্বন্ধু এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা। শ্রী জগদ্বন্ধু ছিলেন একজন হিন্দু সাধক। এই জায়গাটিতে প্রতিদিন প্রচুর স্থানীয় দর্শক এবং বহিরাগত সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষেরা পর্যটনে আসেন।

জেলা জজ আদালত

ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল ফরিদপুরে। এটি বিচারকার্য পরিচালনা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে এটি ফরিদপুর জজ কোট হিসেবে পরিচিত এবং এটিকে ফরিদপুরের প্রাণকেন্দ্র ধরা হয়। কোর্টের ভবনগুলো’র স্থাপনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, ভবনগুলোতে ইংরেজদের স্থাপত্য-শৈলীর ছাপ রয়েছে। সদা ব্যস্ত এই এলাকাতে স্থানীয়রা সর্বদায় ভিড় করে, যার বেশিরভাগই চলমান মামলার কার্যক্রম সমাধানের নিমিত্তে। তবে পর্যটকরা চাইলে নিজে থেকেই ঘুরে আসতে পারেন স্থানটি।

সরকারি রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

ফরিদপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হচ্ছে এই রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। বাংলার বিখ্যাত পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। জসীমউদ্দীন একসময় এখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে গবেষণা কাজ করেছিলেন। শ্রী অম্বিকাচরণ মজুমদার ১৯১৮ সালে এই কলেজের প্রাথমিক কাজ শেষ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে এটি সরকারের তালিকাভুক্ত হয়। এটি ফরিদপুর জেলার সবচাইতে প্রাচীন কলেজ। তবে বর্তমানে কলেজের পুরাতন ভবনটি পরিত্যক্ত। এখন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে এবং সেসব ভবনে ক্লাস ও একাডেমিক কার্যক্রম চলে।

ফরিদপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চ

ফরিদপুরে পুলিশ লাইনের নিকটে অবস্থিত ব্যাপ্টিস্ট চার্চটি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গন্তব্য স্থল। তবে খ্রিস্টান ছাড়াও সাধারণ মানুষ এখানে যেতে পারেন, এজন্য ফরিদপুরের ব্যাপ্টিস্ট চার্চ’কে জনগণের চার্চ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

ফরিদপুর শহর ভ্রমণ করলে আপনি অনেক উপনিবেশিক যুগের স্থাপনা দেখতে পাবেন। এসব স্থাপনা বর্তমানে বেশিরভাগই সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ফরিদপুর শহরে রিকশা ভ্রমণ পর্যটকদের চেক লিস্টে থাকা উচিত।

ঢাকা থেকে ফরিদপুর যেতে হলে আপনাকে পদ্মা সেতু পার করতে হবে। ঢাকা থেকে ফরিদপুর সড়ক পথে যেতে প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। ফরিদপুর জেলায় থাকার জন্য সবচাইতে উপযুক্ত হোটেল হল সেভেরা হোটেল, তাছাড়াও আপনি কম ভাড়ার মধ্যে অন্যান্য আবাসিক হোটেল পেয়ে যাবেন।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*