বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক শহর হচ্ছে গাজীপুর। প্রাচীন ঐতিহ্যে লালিত শহরটি যার সাথে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ। সময়ের সাথে সাথে গাজীপুর পর্যটন শিল্পের জন্য নামাঙ্কিত একটি শহর হয়ে উঠছে। রাজধানী থেকে কাছে হওয়ার কারণে এবং সুবিধাজনক যোগাযোগব্যবস্থা থাকার কারণে অনেক মানুষ এই শহরের আকর্ষণীয় স্থান গুলোতে একত্রিত হচ্ছেন। গাজীপুর শহরের পর্যটন এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্রসমূহ নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।
ভাওয়াল রাজবাড়ি
অতীতকালের নিদর্শন হয়ে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় অক্ষুন্ন রয়েছে এই ঐতিহাসিক রাজবাড়ীটি। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে গৃহীত। ১৯৭৩ সালে এই উদ্যানটি প্রতিষ্টিত হয় শ্রীপুরের ভাওয়ালগড়ে। বন্য পরিবেশ রক্ষার্থে এবং মানুষ ও পরিবেশের মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক এর গুরুত্ব সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য এই জাতীয় উদ্যানটি নির্মিত হয়।
এখানে রয়েছে ৬ টি রেস্ট হাউস এবং ১৩ টি কটেজ। অনুমতি সাপেক্ষে আপনি চাইলে এখানে রাত কাটাতে পারেন। উদ্যানের মূল আকর্ষণ হচ্ছে ভাওয়াল রাজবাড়ি। আয়তন এবং কক্ষ সংখ্যা বিবেচনা করতে গেলে এটি মূলত একটি বিশাল বড় প্রাসাদ যা ৫ একর জমির উপর নির্মিত। প্রাসাদের সামনে বিশাল একটি মাঠ এবং পশ্চিমে একটি বিশাল লেক রয়েছে।
জাগ্রত চৌরঙ্গী
গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় চান্দনা চৌরাস্তার নিকটে অবস্থিত জাগ্রত চৌরঙ্গী। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক রূপে স্থাপিত প্রথম ভাস্কর্য হচ্ছে জাগ্রত চৌরঙ্গী। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। এই দিনের যুদ্ধে নিহত হওয়া শহীদদের চেতনাকে অম্লান রাখতে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়। ভাস্কর্যের দুইপাশের ফলকে ১১ নম্বর সেক্টরের ১০৭ জন এবং তিন নম্বর সেক্টরের ১০০ জন শহীদের নাম খোদাইকৃত রয়েছে।
নুহাশ পল্লী
গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত হোতাপাড়া বাজারের পিরুজালী নামক গ্রামে ৪০ বিঘা জমির উপর নির্মিত হয়েছে নুহাশ পল্লী। এটি হচ্ছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের লেখক মরহুম হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ি। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি এটি নির্মাণ করেন। এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং প্রাণীর ভাস্কর্য। নুহাশপল্লীর প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে বিশাল খোলা উদ্যান এবং বসার জায়গা।
পাশে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের বাগানবাড়ি। সামনে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের কবর। বাগান বাড়ির পাশে রয়েছে একটি কৃত্রিম হ্রদ। নুহাশপল্লীতে আরো একটি প্রাকৃতিক পুকুর রয়েছে এবং পুকুরের উপর রয়েছে একটি ছোট ব্রিজ। পুকুর সংলগ্ন দুটি আবাসিক বাড়ি রয়েছে, যাতে হুমায়ূন আহমেদ তার অবসর সময় কাটাতেন।
আনসার ভিডিপি একাডেমি স্মৃতি ভাস্কর্য
গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানায় সফিপুর গ্রামে স্থাপিত হয়েছে আনসার ভিডিপি অ্যাক্যাডেমি স্মৃতি ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের শপথ গ্রহণের সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এবং রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে এখানে আনসার বাহিনীর তরফ থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সেই দিনের স্মৃতি ধারণ করে রাখতে সফিপুর নির্মিত হয়েছে আনসার- ভিডিপি একাডেমি এবং এখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্বরূপ এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কর্নার
গাজীপুরের প্রাণকেন্দ্র বোর্ডবাজারে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কর্নার। মুক্তিযুদ্ধের বহু আলোকচিত্র সংগ্রহ করে গ্যালারিতে আর্কাইভরূপে এখানে প্রদর্শিত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র সমূহ এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদের প্রতিকৃতি এবং অনেক বিরল চিত্রসমূহ।
ভাওয়াল রাজ শ্মশানস্বরী
১৯৫১ সালে রাজা কালী নারায়ণের রাজত্বকালে এই শ্মশানস্বরী নির্মিত হয়েছিল। গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ী থেকে উত্তর দিকে চিলাই নদীর পাশে এই শ্মশানস্বরী অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটি ছিল তৎকালীন রাজপরিবারের বিদেহী সদস্যবৃন্দের দাহ করার জায়গা। মৃতদের স্মৃতি স্বরূপ তাদের নামানুসারে নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। শ্মশানে রয়েছে একটি শিব মন্দির এবং আটটি মাঠ। এগুলোর মধ্যে তিনটি নির্মাণশৈলী সাধারণ হলেও বাকি পাঁচটি মাঠের নির্মাণ শৈলী চিত্তাকর্ষক। এই মাঠগুলো নির্মিত হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীতে এবং এখনো পর্যন্ত তার নির্মাণশৈলী অক্ষুন্ন রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক
গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এই সাফারি পার্কটি মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এগুলো হল সাফারি কিংডম, কোর সাফারি, বায়ো ডাইভারসিটি পার্ক, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার এবং এশিয়ান সাফারি পার্ক। সাধারণ চিড়িয়াখানার সাথে সাফারি পার্কের পার্থক্য হলো যে সাধারণ চিড়িয়াখানায় প্রাণীরা খাঁচার মধ্যে বন্দী অবস্থায় থাকে, যেখানে সাফারি পার্কে বন্যপ্রাণীরা সম্পূর্ণ মুক্ত পরিবেশে বিচরণ করে।
প্রকৃতির সাথে প্রাণীকুলের অকৃত্রিম মেলবন্ধন দেখতে হাজারো মানুষ সাফারি পার্কে উপস্থিত হয়। পার্কে প্রবেশের ফ্রী হচ্ছে মাত্র ১০০ টাকা যার বিনিময়ে আপনি এসি বাসে চড়ে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীদের বিচরণ দেখতে পাবেন। দর্শকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য এখানে দুটি জীপ এবং দুটি মিনিবাস রয়েছে। বন্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে চিতাবাঘ, সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, জেব্রা, জিরাফ, কালো ভাল্লুক, ইত্যাদি।
শুধুমাত্র প্রাণী নয় সাফারি কিংডম পাখিদেরও অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করে। এখানে উপস্থিত পাখিদের মধ্যে রয়েছে সারস, ময়ূর, ম্যাকাও সহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বিরল প্রজাতির পাখি। পাখিদের বিচরণক্ষেত্রের পাশেই রয়েছে অর্কিড হাউস। সাফারি পার্কটি অনেক উন্নত এবং আধুনিক। সাফারি পার্কটির গঠন বৈশিষ্ট্য থাইল্যান্ডের সাফারি পার্কের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা। সমগ্র সাফারি পার্কটি চারপাশে প্রতিরক্ষা বেষ্টনী নির্মাণ করা হচ্ছে যাতে প্রাণীসমূহ নির্ধারিত এলাকার বাইরে যেতে না পারে। একই সাথে এখানে পর্যটক ও গবেষকদের যানবাহনে বা পায়ে হেঁটে বিচরণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
হামিদুজ্জামান ভাস্কর্য পার্ক
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ২ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে এই ভাস্কর্য পার্ক। বাংলাদেশের বিখ্যাত ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের তৈরি শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য এবং ম্যুরাল এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রথম ভাস্কর্য পার্ক যা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। বাংলাদেশের সবচাইতে দীর্ঘ ম্যুরালটি এখানে রয়েছে যার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩৪০ ফুট।
এটি বৃত্ত, অর্ধ-বৃত্ত এবং বক্ররেখা সহ বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের একটি সাদা অনুদৈর্ঘ্য পটভূমিতে নির্মিত। ভাস্কর হামিদুজ্জামান এর শিল্পকর্ম এবং ভাস্কর্যগুলো একটি ফিউশন থিমের উপর প্রদর্শিত হয়েছে। পার্কের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমসাময়িক এবং আধুনিক শৈল্পিক শৈলী প্রদর্শন করা। এখানকার ম্যুরাল সমূহ মার্বেল, স্টেইনলেস স্টিল, এবং লোহা দিয়ে তৈরি।
রিসোর্টসমূহ
নিকট অতীতে গাজীপুরে রিসোর্টসমূহ তৈরী যেন একটি রীতি হয়ে ওঠে। গাজীপুরে রয়েছে বাংলাদেশের সুন্দরতম এবং আধুনিক রিসোর্টসমূহের উপস্থিতি। প্রত্যেকটি রিসোর্টই অত্যন্ত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের দিয়ে ঘেরা এবং রয়েছে আকর্ষক কটেজসমূহ। যদিও রিসোর্টসমূহ তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল, কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ স্থানসমূহ ও আতিথেয়তা উঁচু পর্যায়ের। প্রায় প্রত্যেকটি রিসোর্টে রয়েছে সুইমিং পুল হালকা রাইড, বাগান এবং প্রাকৃতিক গাছপালা। গাজীপুরের কয়েকটি দর্শনীয় রিসোর্ট এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভাওয়াল রিসোর্ট, দিপালী রিসোর্ট, পূবালী রিসোর্ট, ধানসিঁড়ি রিসোর্ট, অরন্যবাস রিসোর্ট, সারাহ রিসোর্ট, সাহেব বাড়ি রিসোর্ট, ইত্যাদি।
সবুজ ছায়া পিকনিক স্পট
গাজীপুরের জয়দেবপুরে নিলেরপারা নামক গ্রামে অবস্থিত সবুজ ছায়া পিকনিক স্পট। পুরো পিকনিক এলাকাটি প্রায় পঁচিশ বিঘা জমির উপর অবস্থিত। এটি একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র। ভ্রমণকারীদের জন্য এখানে রয়েছে রেস্ট হাউস, পার্কিং স্পেস, কুকিং শেড, ডাইনিং শেড, খেলার মাঠ এবং সুসংগঠিত মঞ্চ। তাছাড়া বাচ্চাদের জন্য রয়েছে মিনিপার্ক এবং খেলার জন্য উন্মুক্ত স্থান। পার্কের আরেকটি উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ হচ্ছে ৫ বিঘা জুড়ে অবস্থিত দিঘী। এই দিঘীতে দুইটি নৌকা রয়েছে এবং পানিতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ভাসমান ফুল। সবমিলিয়ে এটি পিকনিকের জন্য একটি উত্তম গন্তব্যস্থল।
শুধুমাত্র রিসোর্ট ই নয়, গাজীপুরে থাকার জন্য রয়েছে অনেক আবাসিক হোটেল এবং আবাসিক বাসস্থান। গাজীপুরের কিছু উল্লেখযোগ্য হোটেলের মধ্যে রয়েছে গ্র্যান্ড প্লাজা হোটেল, হোটেল সিটি পার্ক, তাজ গার্ডেন হাউস, সি ক্লাব রিসোর্ট এবং কনভেনশন সেন্টার, শিরিন হোটেল, হোটেল আর্টিসান, ইত্যাদি। ঢাকা থেকে গাজীপুরের দূরত্ব অত্যন্ত কম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত মানের। ঢাকা থেকে সরাসরি গাজীপুর পর্যন্ত বাস পরিবহন রয়েছে। তা ছাড়াও রয়েছে কমিউটার ট্রেন। ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকে ট্যাক্সি ক্যাব বা গাড়ি ভাড়া নিতে পারেন।
Leave a Reply