জয়পুরহাট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

জয়পুরহাট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

জয়পুরহাট বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা, যা রাজশাহী  বিভাগের অন্তর্গত। দীর্ঘ সময় ধরে সেন ও পাল সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল জয়পুরহাট। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত অতীতের কোনো পুথি বা শিলালিপি থেকে জয়পুরহাটের ইতিহাস সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তার পরবর্তী সময়ের নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, জয়পুরহাটের পূর্ব নাম ছিল বাঘাবাড়ী হাট এবং পরবর্তী সময়ে এর নাম পরিবর্তন হয়ে হয় গোপেন্দ্রগঞ্জ হাট। অতীতের সেই সময় পাঁচবিবি এলাকা এবং বর্তমানের জয়পুরহাটকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল লালবাজার থানা।

যমুনা নদীর শাখা হিসেবে পরিচিত পুরানপাইল নামক উপনদীর পূর্বাঞ্চল জুড়ে এই এলাকাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরো জানা যায় যে, সেই সময় এখানে একটি ডাকঘরও স্থাপন করা হয়েছিল। লালবাজার থানাটি অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এখানে ছোট যমুনা নদীর ঘাট নির্মিত হয়েছিল; যা  জলপথে ব্যবসা- বাণিজ্যের সামগ্রীসমূহ আনা- নেওয়ার কাজে ব্যাবহার করা হত ও  রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হতো। সেন ও পাল আমলে জয়পুরহাট শহরটি সামগ্রিকভাবে রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার চাইতেও বড় ছিল।

১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সরকার কলকাতা থেকে জলপাইগুড়ি এলাকা পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে যার বিস্তৃতি জয়পুরহাট পর্যন্ত অগ্রসরমান হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে জয়পুরহাটে সবমিলিয়ে ৮ টি রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। এখানকার রেল স্টেশনের নাম ছিল বাঘাবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন। রেল স্টেশন স্থাপিত হবার পর স্টেশনে লোক সমাগম, বাঘাবাড়ী ঘাটের চাইতেও বেশি হত।

এই সময় নিকটবর্তী স্থানসমূহে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। লোকমুখে শোনা যায় যে, পাল সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা রাজা জয়পাল এর নাম থেকে জয়পুরহাট নামকরণ করা হয়। রাজা জয়পাল সশরীরে এখান থেকে কিছু সময়ের জন্য তার রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। জয়পুরহাটের পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে আজকের এই পোষ্ট  সম্পাদিত হল।

পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির উপর দুর্বিষহ নির্যাতনের প্রমাণ ও সাক্ষী হয়ে রয়েছে পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের মে মাসে, পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী পাগলা দেওয়ানে তাদের বাঙ্কার ও ক্যাম্প সহ শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করে। যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে যেসব বাঙালি ভারত সীমান্তের দিকে পাড়ি দিত, তাদেরকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা লুটপাট করে নির্বিচারে গণহত্যা করত। এসব অসহায় মানুষদের লাশগুলো পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমিতে একত্রে দাফন করা হতো।

১৯৭১ সালের ১৪ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্র এলাকার রাজাকারদের সহায়তায় ১২২ জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে মৃত্যুর পথ দেখায়। স্থানীয় তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানি মিলিটারি, রাজাকার ও আলবদররা পাগলা দেওয়ানে প্রায় চার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এবং অসংখ্য মানুষের বসতভিটা পুড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়াও তারা হাজারের বেশী নারীর মর্যাদা লুন্ঠন করেছে। বাংলাদেশ যুদ্ধে বিজয় লাভের পরেও দুই তিন মাস সময় এই স্থানে কোন মানুষ বসবাস করতে পারেনি। যার কারণ হচ্ছে, অসংখ্য লাশের তীব্র পচে যাওয়া গন্ধ।

পরবর্তীতে যারা এখানে বসবাস করতে আসেন, তারা আবাদি জমিতে ফসল রোপনের জন্য মাটিতে আঘাত করলে সাথে সাথে অর্ধ গলিত পচা লাশ বের হয়ে আসতো। ১৯৯২ সালে জয়পুরহাট জেলার একজন সাংবাদিকের লেখনীতে এই বধ্যভূমি সম্পর্কে তথ্য মানুষের সামনে উঠে আসে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ গণপূর্ত বিভাগ এই বধ্যভূমিতে নির্যাতিত মানুষদের সম্মানার্থে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেন। লাল ইট এবং কাল টাইলস নির্মিত এই স্মৃতিসৌধ বাঙ্গালীদের আত্মত্যাগের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জয়পুরহাট সদর উপজেলার চক্করহাট নামক স্থানে এই ঐতিহাসিক বধ্যভূমিটি অবস্থিত।

লকমা/ লাকমা রাজবাড়ি

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী পশ্চিম কারিয়া নামক গ্রামে প্রাচীন এই রাজবাড়িটি অবস্থিত। প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রায় ৩০০ বছর আগে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লাকমা চৌধুরীর নাতি চৌধুরী হাদি মামুন। তবে প্রাসাদটির নির্মাণ কর্তারনাম সম্পর্কে অনেকের মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন মানুষের মতানুযায়ী রাজা লক্ষণ সেন এই প্রাসাদের নির্মাতা ছিলেন। প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী ছিল ইংরেজি স্থাপত্যশিল্পের অনুকরণে।

এই ভবনটি গঠনগতভাবে “U” আকৃতির দুই তলা ভবন। জানা যায় যে, ভবনটি হাতি এবং ঘোড়ার শাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রাসাদের পূর্ব প্রান্তে অধিকারিকদের জন্য নির্মিত কক্ষ এবং কবরস্থান বিদ্যমান। বর্তমানে লাকমা বংশের উত্তরাধিকারীরা এই প্রাসাদের স্থায়ী বাসিন্দা। মূল প্রাসাদে ছাড়াও সর্বমোট ১৫ বিঘা অতিরিক্ত জমি এই রাজবাড়ীর মালিকানাধীন রয়েছে। এখন এই জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল এবং ফল চাষ করা হয়।

আছরাঙ্গা দীঘি/ আচরাঙ্গা দীঘি

জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল নামক উপজেলায় মামুদপুর নামক স্থানে ঐতিহাসিক সভ্যতার প্রাচীন এই নিদর্শনটি অবস্থিত। স্থানীয় এলাকাবাসীদের মতানুসারে, রাজশাহীর অভিবাসীত জমিদার বংশের প্রধান মৌন ভট্টের কৃষিজমিগুলো বৃষ্টিপাত ও সেচের অভাবে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে গেছিল। পানির অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে জমিদার মৌন ভট্ট ৮১৭ খ্রিস্টাব্দে এখানে বড় আকারের দিঘি নির্মাণ করেন; যাতে স্থানীয় জলের সমস্যা দূর হয় এবং কৃষিজমিগুলো পুনরায় চাষ করা সম্ভব হয়। সমগ্র দিঘীটি প্রায় ২৬ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।

এখানকার পানির সাহায্যে আমন ধানের আবাদ করা হতো। দিঘির বিভিন্ন কোণে মোট চারটি পাকা ঘাট রয়েছে। এখানকার মাটিতে আয়রনের আধিক্য থাকার কারণে এখানকার মাটির রং ছিল লাল এবং সে কারণেই এই এলাকার নাম হয় ক্ষেতলাল। পৌরাণিক এই দীঘির সম্পর্কে বিভিন্ন লোককথা ও পালা গান প্রচলিত রয়েছে। সে সব থেকে জানা যায় যে, এই দীঘির পানি স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ছিল; যা স্থানীয় লোকজনের ঔষধ হিসেবে ব্যাবহার হতো।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দীঘিকে ঘিরে পূজা পার্বণের আয়োজন করত। ১৯৯২ সালে পুনরায় এখানে বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। উল্লেখ্য যে, প্রাচীনকালে নির্মিত বারোটি মূর্তি এখান থেকে উদ্ধার করা হয়; যা বাংলাদেশের বিভিন্ন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে দর্শনার্থীরা ছুটে আসেন  যাদের অধিকাংশই ভ্রমণের জন্য শীতকালকে বেছে নেন। যার কারণ হল, এখানে উড়ে- আসা বিভিন্ন জাতির অতিথি পাখি।

চিলড্রেনস পার্ক অ্যান্ড রিসোর্ট/ জয়পুর শিশু উদ্যান ও রিসোর্ট

জয়পুরহাট সদরের বুলুপাড়া নামক এলাকায় জয়পুর রিসোর্ট নামক একটি আধুনিক এবং মনোরম শিশু উদ্যান নির্মাণ করা হয়েছে। সমগ্র পার্কটি ৬০ বিঘা জমির উপর অবস্থিত এবং এখানকার সাজানো গোছানো পরিবেশ যেকোনো বয়সের মানুষকে  আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। এই পার্কে বিনোদনের জন্য রয়েছে থ্রিডি মুভি, মিনি চিড়িয়াখানা, নাগরদোলা, চরকি, দোলনা, একটি সুইমিং পুল, টয় ট্রেন, এবং ফুড কোর্ট।

হিন্দা কসবা শাহী জামে মসজিদ

বাংলাদেশের ইসলামী স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে হিন্দা কসবা শাহী জামে মসজিদ। জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল নামক স্থানে হিন্দা গ্রামে এই মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদের স্থাপত্য শিল্প মুঘল আমলের ঐতিহাসিকতার পরিচয় দেয়। মসজিদটি সুসজ্জিত করার জন্য এর কাঠামোতে ব্যবহৃত হয়েছে কাচ এবং মোজাইক।

বাগমারী পীর হিসেবে পরিচিত হযরত আবুল গফুর চিশতী, খলিফা আব্দুল খালেক চিশতির তত্ত্বাবধানে এই শাহী মসজিদটি গড়ে তোলেন। হযরত আবুল গফুর চিশতী এই মসজিদ ছাড়াও জয়পুরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। এই মসজিদে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের বা নীতির অনুকরনে পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের উত্তর প্রান্তে রয়েছে ৪০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি মিনার এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে রয়েছে চারজন সুফি সাধকের মাজার ও দেহাবশেষ।

বারো শিবালয় মন্দির

জয়পুরহাট সদরে যমুনা নদীর তীরে বেল- আমলা নামক গ্রামে এই শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। যদিও মন্দিরটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য অজানা কিন্তু মসজিদের কারুকাজ, দেয়াল চিত্র, নকশা করা ইট, স্থাপত্যশৈলী ও পোড়ামাটির ফলক থেকে আন্দাজ করা যায় যায় যে, এটি সেন যুগে নির্মিত একটি কাঠামো। মন্দিরের ভিতরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবতা শিবের প্রতিমূর্তি ছাড়াও রয়েছে রাম, লক্ষণ, সীতা, হনুমান এবং দেবী কালীর মূর্তি।

মসজিদ প্রাঙ্গণে আরো রয়েছে একটি নন্দী মূর্তি। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শিব চতুর্দশীতে এই মন্দিরে দুই দিন এবং দুই রাত্রি ধরে শিবরাত্রি পূজা আয়োজন করা হয়। পূজা অর্চনার আরেকটি দিক হচ্ছে, অর্চনা শেষ করে নিকটবর্তী যমুনা নদীতে গোসল করা। সারা দেশ থেকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পর্যটকগণ এখানে বছরজুড়ে ভ্রমণে আসেন।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে জয়পুরহাট আসা যায়। আর আপনি বিমান পথ বেছে নিলে, আপনাকে সৈয়দপুর নামতে হবে এবং সেখান থেকে জয়পুরহাট যেতে হবে।

জয়পুরহাটে অবস্থানের জন্য বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, হোটেল বৈশাখী, পৃথিবী হোটেল, হোটেল প্রমি ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সুইট ড্রিম, হোটেল সৌরভ ইন্টারন্যাশনাল, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*