ঝালকাঠি জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ঝালকাঠি জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর এবং জেলা হচ্ছে ঝালকাঠি। এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দরও বটে। শহরটি ধানসিঁড়ি নদী এবং সুগন্ধা নদীর উপকূলে অবস্থিত। এখানকার জলপথের যোগাযোগ ব্যাবস্থা’র সুবিধার কারণে, শহরটি আদিকাল থেকেই ব্যবসা- বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। ব্রিটিশ শাসনাধীন এই শহরকে ১৮৭৫ সালে পৌরসভা হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়।

১৯০০ সালে প্রথমবারের মতো এখানে কেন্দ্রীয় থানা প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং সর্বশেষ ১৯৮৪ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখানে বৈচিত্র্যময় পর্যটন কেন্দ্রসমূহের কারণে, এই জেলাটি ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। এই পোস্টে ঝালকাঠি জেলার আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র-সমূহ সম্পর্কে কিছু তথ্য শেয়ার করা হলো।

সুজাবাদ কেল্লা

ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার মগর ইউনিয়নে অবস্থিত সুজাবাদ কেল্লাটি সুজাবাদ গ্রামের একটি বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক হিসেবে পরিচিত। মুঘল শাসনামলের সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা এই সুরম্য কেল্লাটির স্থাপনা করেন। এই কেল্লা নির্মাণের পিছনে রয়েছে বিশাল ইতিহাস। পূর্বে মুঘল আমলে পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা এখান থেকে অবাধে সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত। ক্রমান্বয়ে তারা অত্র এলাকার নিরীহ মানুষ অপহরণ করে নিয়ে যেতে থাকে এবং মানুষ বিক্রি করার মত ন্যক্কারজনক কাজ করা শুরু করে।

এই  ভীতিকর অবস্থা প্রতিহত করতে ১৯৫৪ সালে শাহজাদা সুজা এখানে  সুজাবাদ গ্রামের গোড়াপত্তন করেন এবং জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সুগন্ধা নদীর পাড়ে দুইটি কেল্লা স্থাপন করেন। কেল্লাগুলোর মধ্যে একটি মাটি দিয়ে এবং অন্যটি  ইট দ্বারা নির্মাণ করা হয়। মাটি নির্মিত কেল্লাটি অন্দর কেল্লা এবং ইট নির্মিত কেল্লাটি বাহির কেল্লা নামে পরিচিত ছিল। স্থানীয় লোকমুখে শোনা যায়, এই দুইটি কেল্লার নির্মাণ কাজ এক রাতের মধ্যে শেষ করা হয়; যাতে সাহায্য নেয়া হয়েছিল জিন গোষ্ঠীর।

এই কারণে কেল্লা দুটিকে “ভূতের গড়” নাম দেয়া হয়েছিল। তবে বর্তমানে কেল্লাটির অতীত সৌন্দর্য আর নেই। আরো ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে, সম্রাট শাহজাহানের ছেলে আওরঙ্গজেব তার পিতাকে গ্রেপ্তার করেন। ফলশ্রুতিতে আওরঙ্গজেবের ভাইয়েরা তার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই ভিষণ যুদ্ধে টিকতে না পেরে শাহজাদা শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের আক্রমণ থেকে বাঁচতে এই কেল্লাতে আশ্রয় নিয়েছিল।

আপনি যদি এখানে বেড়াতে আসেন তাহলে ঘোষ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে রসমালাই এবং অন্যান্য মিষ্টান্ন খেতে ভুলবেন না। তাছাড়াও কালিবাড়ি রোডে বিখ্যাত সকাল- সন্ধ্যা সুইটস নামক খাবার দোকান থেকে সুস্বাদু লুচি ও ভাজি খেয়ে দেখতে পারেন।

কীর্ত্তিপাশা জমিদার বাড়ি

ঝালকাঠি জেলার জিরো পয়েন্ট থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কীর্ত্তিপাশা গ্রামে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। বিক্রমপুর জমিদার বংশের শেষের দিকের কয়েকজন উত্তরসূরী এই জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০০ সালে বিক্রমপুর জমিদার বংশের রাজা রাম সেনগুপ্ত এই গ্রাম পরিদর্শন করতে আসেন। স্থানটি পছন্দ হওয়ার কারণে, তার দুই ছেলের প্রত্যেকের জন্য তিনি একটি করে মোট দুইটি বাড়ি নির্মাণ করেন। জমিদার বাড়িটি দুই অংশে বিভক্ত ছিল। মোট আয়তনের ১০ আনা বড় ছেলের জন্য বরাদ্দ ছিল, যা বড় হিস্যা জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল এবং বাকি ছয় আনা সংরক্ষিত ছিল তার ছোট ছেলের নামে, যার নামকরণ করা হয়েছিল ছোট হিস্যা জমিদার বাড়ি।

বর্তমানে ছোট হিস্যা অংশের বিলুপ্তি ঘটেছে কিন্তু বড় জমিদার বাড়ির কিছু অংশবিশেষ এখনো টিকে রয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় যে, জমিদার পুত্রকে বিষ মেশানো খাবার দেওয়া হয়েছিল এবং সেই খাবার খেয়ে জমিদারপুত্র মারা যান। তাকে দাহ করার সময় তার স্ত্রী নিজেকে সতী প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে, একই সাথে জীবিত অবস্থায় চিতায় শায়িত হন। বড় হিস্যার মধ্যে রয়েছে হলঘর, নাটমন্দির, ছোট মন্দির, বড় মন্দির, এবং শান বাঁধানো পুকুর। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, যথেষ্ট সংরক্ষণ ও  সংস্কারের অভাবে জমিদার বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে; যা প্রায় ধবংসের পথে। বর্তমানে জমিদার বাড়ির একটি অংশে প্রসন্ন কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। হলরুমে ও নাটমঞ্চে কমলিকন্দ নবীন চন্দ্র বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে।

ভাসমান পেয়ারা বাজার

বাংলাদেশের অত্যন্ত বৈশিষ্ট্যময় একটি বাজার হচ্ছে ভিমরুলি থানার ভাসমান পেয়ারা বাজার। অন্য সব বাজারের মত এখানে প্রতিষ্ঠিত কোন দোকান নেই, বরং পানিতে ভাসমান শতাধিক নৌকাড় প্রত্যেকটি এক একটি দোকানের মত কাজ করে। এই নৌকাগুলো সবুজ- হলুদ পেয়ারা বহন করে, যা বিক্রেতার মূলধন হিসেবে বিবেচিত। সপ্তাহের প্রতিদিনই এই বাজার খোলা থাকে, যাতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যবসা বাণিজ্য চলে। সাধারণত এখানে পাইকারি হিসেবে পেয়ারা বিক্রয় করা হয়।

ক্রেতারা নৌপথে বড় বড় ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে এখান থেকে কম দামে পেয়ারা ক্রয় করে এবং ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে পাঠিয়ে দেয়। এমন একটি ভাসমান পেয়ারা বাজার তৈরি হওয়ার পেছনে কারণ রয়েছে। যা হচ্ছে, নিকটবর্তী বরিশাল, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন জাতের পেয়ারার বাগান। এত বড় পেয়ারা বাগান সমগ্র এশিয়ার আর কোথাও নেই। নিকটবর্তী জেলাগুলোতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৪ হাজার একর জমিতে পেয়ারা আবাদ করা হয়, যা সমগ্র বাংলাদেশের পেয়ারা উৎপাদনের প্রায় ৮০ শতাংশ।

প্রত্যেক বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এখানে পেয়ারা বিক্রয়ের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হয়। এই  বাজারটি সারা বছরের মধ্যে সবচাইতে বেশি আকর্ষণীয় দেখায় অগাস্ট মাসে। কারণ, এটি হচ্ছে পেয়ারা উৎপাদনের প্রমূখ সময়কাল। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন যে, এই ভাসমান বাজারে শুধুমাত্র পেয়ারার মাধ্যমে অর্থনীতি পরিচালিত হয়; তবে সেটি ভুল হবে। কারণ, পেয়ারার মৌসুম শেষ হওয়ার পর এখানে আখের বাজার বসে।

ভিমরুলি গ্রামের নিকটবর্তী অঞ্চলে অনেক আখের বাগান রয়েছে বলে এখানে বিপুল পরিমাণে আখ সরবরাহ করা সম্ভব হয়। পেয়ারা এবং আখের মৌসুম শেষ হবার পর শুরু হয় কুল বা বরই  বিক্রয়ের সময়কাল। তাছাড়াও অত্র স্থানে হগ- পাম এর ফলন চোখে পড়ার মতো। সবশেষে আসে সুপারি বিক্রয়ের মৌসুম। ফল ব্যতীত হরেক রকমের সবজিও এই বাজারে পাইকারি দরে বিক্রয় করা হয়। সারা বছর জুড়ে এই বাজারে কোন না কোন সবজি বা ফলের বাজার ও বিক্রয় অব্যাহত থাকে।

এই  খালের দৃশ্য মনোরম একটি ভেজা সবুজ আবহ তৈরি করে। খালের তীরে সবুজ প্রকৃতি এবং সবুজ- হলুদ পেয়ারা ভর্তি নৌকাগুলো দেখতে চমৎকার লাগে। এখানে আপনি ভ্রমন করতে চাইলে আপনাকে নৌকার সাহায্যে ভ্রমণ করতে হবে, যা অত্যন্ত মনমুগ্ধকর। এই বাজারে আপনি গমন করলে ঋতুপর্ণা নামক দোকান থেকে বিখ্যাত গরম মিষ্টি খেয়ে দেখতে পারেন। একই সাথে আরেকটি খাবারের দোকানের কথা না বললেই নয়, যা হচ্ছে বউদির হোটেল। এখানে আপনি দুপুরের খাবার খেতে পারবেন, যা অত্যন্ত সুস্বাদু। ভ্রমণ শেষে যাত্রাপথে আপনি চাইলে নিকটবর্তী দুর্গাসাগর দীঘি ও প্রাচীন গুটিয়া মসজিদ অল্প সময়ে এক সাথে দেখে আসতে পারেন।

যাত্রা ও আবাসন

ঢাকা থেকে লঞ্চে ও বাসে ঝালকাঠি পৌঁছানো যায়। বাস ভাড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। আর আপনি যদি লঞ্চে যেতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনাকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বরিশালগামী লঞ্চে চড়তে হবে। বরিশাল পৌঁছানোর পর আপনি সড়কপথে খুব সহজেই ঝালকাঠি পৌঁছে যেতে পারবেন। ঝালকাঠি জেলার আবাসিক হোটেলগুলো মাঝারি মানের। আপনি যদি ঝালকাঠি জেলায় রাত কাটাতে চান সে ক্ষেত্রে নির্দেশিত হোটেলগুলো হচ্ছে ডালিয়ান থাই চাইনিজ হোটেল, হোটেল ধানসিঁড়ি, আরাফাত বোর্ডিং এবং হালিমা বোর্ডিং। আর আপনি যদি উন্নত মানের আতিথেয়তা পেতে চান, সে ক্ষেত্রে আপনার জন্য উত্তম হচ্ছে বরিশাল শহরে ভালো মানের হোটেলে রাত কাটানো।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*