ঝিনাইদহ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ঝিনাইদহ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের একটি জেলা ঝিনাইদহ। ঝিনাইদহ শহরটি খুলনা জেলার অন্তর্গত এবং সমগ্র জেলার আয়তন প্রায় ১৯৬৫ বর্গ কিলোমিটার। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে ঝিনাইদহ ছিল একটি পুলিশ ফাঁড়ি বা থানা যা প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৭৯৩ সালে। ১৮৬২ সালে ঝিনাইদহকে মহকুমা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে ঝিনাইদহ জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এখানে দেখার মত বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানসমূহ, বিনোদন কেন্দ্র এবং পৌরাণিক স্থানসমূহ বিদ্যমান। ঝিনাইদহ শহরের দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে এই পোস্টটি সম্পাদন করা হল।

গলাকাটা মসজিদ

ঝিনাইদহে একটি অতি প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হচ্ছে গলাকাটা মসজিদ। এটি ঝিনাইদহ জেলা শহরের বারোবাজার নামক ইউনিয়নে অবস্থিত, যা মূল শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে স্থানীয় এলাকার মাটির টিলা খনন করার সময় এই মসজিদের অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করে এবং পরবর্তীতে তার যথাযথ সংস্কার করে। মূল মসজিদটি ১৬ শতাব্দীতে নির্মিত হয়, যখন বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন খান জাহান আলী। বর্তমানে মসজিদটির পাশাপাশি একটি ছোট ঢিপিও রয়েছে, যা গলাকাটা ঢিপি নামে পরিচিত।

এই মসজিদে রয়েছে ৬ টি গম্বুজ এবং মসজিদের দেয়াল ২৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত; যার প্রশস্ততা ৫ ফুট। মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে ৬ টি স্তম্ভের উপর বর্গাকার আকৃতিতে। এতে রয়েছে তিনটি পোড়ামাটি নির্মিত প্রবেশদ্বার। মসজিদের প্রার্থনা কক্ষে তিনটি  সুসজ্জিত মেহরাব বিদ্যমান। মসজিদের পাশে প্রায় ১২ বিঘা এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল দিঘী যা গলাকাটা দিঘী নামে পরিচিত।

মসজিদটির এই ধরনের নামকরণের পিছনে রয়েছে বিশেষ ইতিহাস। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে যে, বারোবাজার এলাকার এক নৃশংস অত্যাচারী রাজা তার অধীনস্থ প্রজাদের শিরশ্ছেদ করে এই দিঘীতে ফেলে দিতেন। সেই কারণে এখানকার দিঘীটি গলাকাটা দিঘী নামে পরিচিত। এই মসজিদটি সুলতানি আমলের ১৫ শতকের নিদর্শন। স্থানটি খননের সময় কিছু পুরাতাত্ত্বিক বস্তু সামগ্রী পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে হাতের লেখা কোরআন শরীফ, সুলতানি আমলের তলোয়ার, ইত্যাদি। সংস্কৃতিপ্রিয় প্রচুর মানুষ জন দূর- দূরান্ত থেকে এই পৌরাণিক নিদর্শনটি দেখতে আসেন।

কে পি বসুর বাড়ি

বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ হচ্ছেন কে পি বসু। ঝিনাইদহ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরবর্তী নবগঙ্গা নদীর তীরে হরিশংকরপুর নামক গ্রামে এই গণিতবিদের বাসগৃহ অবস্থিত। ১৯০৭ সালে কে পি বসু অত্র স্থানে একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে সর্বমোট সতেরোটি কক্ষ। একসময় এখানে প্রচুর পর্যটকদের ভিড় থাকলেও, বর্তমান সময়ে তুলনামূলকভাবে কম মানুষজন এখানে বেড়াতে আসেন।

বিখ্যাত এই গণিতজ্ঞের স্মৃতিচারণ ও সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যার্থে, ঝিনাইদহ জেলায় একটি সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কে পি বসুর পিতা ছিলেন একজন সাধারণ রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারী। সাধারণ পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও ছোটবেলা থেকেই কে পি বসু গণিত বিষয়ের উপর পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে থাকেন। স্থানীয় পড়াশুনা শেষ করে, লর্ড রিপন কলেজ থেকে তিনি গণিত বিষয়ের উপর উচ্চতর শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

১৮৯২ সালে তিনি ঢাকা কলেজের গণিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। কে পি বসুকে আধুনিক বীজগণিতের প্রথম উদ্ভাবক হিসেবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। তার অধ্যয়নের মূল বিষয় ছিল বীজগণিত এবং জ্যামিতি। জীবদ্দশায় তিনি গাণিতিক দক্ষতা ও গণিতের উন্নতির বিষয়ে অসংখ্য বই রচনা করেছেন। তার নামানুযায়ী কলকাতায় কে পি বসু পাবলিশিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

শৈলকুপা শাহী মসজিদ

ঝিনাইদহ জেলা শহরে দরগাপাড়া নামক স্থানে মধ্যযুগীয় এই পৌরাণিক মসজিদটি অবস্থিত। ভারতের মুঘল আমলের অন্যতম পুরাকীর্তি এটি। এই মসজিদটি নির্মাণ করতে লেগেছিল প্রায় ২ বছর। সুলতান আলাউদ্দিন  শাহ ১৫২৩ সালে এই মসজিদের নির্মাণ করেন। এই মসজিদের নির্মাণের পেছনের ইতিহাস হল, ১৫১৯ সালে সুলতান আলাউদ্দিন সাহের মৃত্যুর পর সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহ গৌড় রাজ্য থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

পথিমধ্যে তিনি কয়েকদিন শৈলকুপায় বিশ্রাম নেন। উল্লেখিত সময়ে তার সফরসঙ্গী ছিলেন দরবেশ আরব শাহ। পরবর্তীতে দরবেশ আরব শাহ শৈলকুপায় স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন বলে সুলতান নাসির উদ্দিন নুসরাত শাহ তার জন্য শৈলকুপায় এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের পরিচালনা সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে সম্রাট এই মসজিদের নামে কয়েক শত বিঘা জমি উইল করে দিয়েছিলেন।

জোড় বাংলা মসজিদ

ঝিনাইদহে অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান এটি। এই মসজিদের অবস্থান হচ্ছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কালোবাজার নামক এলাকায়। এই মসজিদটির স্থাপত্য শিল্প ও খোদাইয়ের কাজ এত নিখুঁত যে, এই মসজিদকে মুসলিম শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে গণনা করা যায়। হিজরী ৮০০ সনে সুলতান মাহমুদ জোড় বাংলা মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী  সেই আমলে এখানে এক জোড়া কুঁড়েঘর ছিল; যার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছিল বিশাল দিঘী। তার কারণে এখানকার দিঘির নাম হয়েছে জোড়দিঘী।

মসজিদটির উচ্চতা হচ্ছে ১১ ফুট এবং কাঠামোটি নির্মিত হয়েছে পাতলা এক ধরনের ইট দ্বারা। মসজিদের পূর্ব অংশে তিনটি খিলান সমৃদ্ধ প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রার্থনা কক্ষের পশ্চিম অংশে পোড়ামাটির নকশা সমৃদ্ধ অর্ধবৃত্তাকার তিনটি মেহরাব রয়েছে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ খনন কার্য পরিচালনা করার সময় এই মসজিদের আবিষ্কার করেন। বর্তমানে মসজিদটির  অধিকাংশ ত্রুটিসমূহ সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমান সময়েও ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা নিয়মিত এই মসজিদে তাদের নামাজ আদায় করেন।

মল্লিকপুর বটগাছ

কালীগঞ্জ থানার বেথুলি নামক গ্রামে ১১ একর জায়গা জুড়ে ৫২ টি বটবৃক্ষ রয়েছে।  বটগাছগুলোর উচ্চতা ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত। ১৯৮৪ সালে বিবিসি, এশিয়া মহাদেশে বিভিন্ন প্যারামিটার নিয়ে জরিপ চালায় এবং তা থেকে উঠে আসে একটি আকর্ষণীয় তথ্য; যা হচ্ছে মল্লিকপুর বটগাছ হচ্ছে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ বটগাছ। এই গাছের বয়স সম্পর্কে সাধারণ স্থানীয়দের কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে ধারণা করা হয় গাছটি প্রায় ৩০০ বছরের বেশী পুরাতন। এই এলাকাতে পূর্ববর্তী সময়ে সেন বংশীয় কুমাররা বসবাস করতেন। যাদের কুয়ার পাড় থেকে একটি বটগাছ জন্মেছিল, যা বর্তমানে এই বিশাল আকার ধারণ করেছে বলে শোনা যায়। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের সামাজিক বন বিভাগ এই বটগাছের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। বটগাছের নিম্নস্থ শান্ত এবং সুন্দর পরিবেশ আগমনকারীদের স্নিগ্ধতা প্রদান করে।

নলডাঙ্গা রাজবাড়ি রিসোর্ট

বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোর চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায়, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থানার নলডাঙ্গা গ্রামে স্থাপিত হয়েছে নলডাঙ্গা রাজবাড়ি রিসোর্ট। এই রিসোর্টটি ঝিনাইদহের অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে স্থান লাভ করেছে। এখানকার প্রবেশ মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। তবে আপনি যদি গ্রুপ সহকারে পিকনিক করতে চান, তবে তার জন্য একটি নির্ধারিত প্যাকেজ রয়েছে।

প্যাকেজ টি হল, ৫০ জন লোকের প্রবেশ খরচ, পিকনিক স্পট এর ভাড়া, গাড়ি পার্কিং, সব মিলিয়ে মোট ৩০০০ টাকা। রিসোর্টের ভিতরে এবং আশেপাশে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের গাছ। তাছাড়াও শিশু- কিশোরদের বিনোদনের জন্য রয়েছে ওয়ান্ডার হুইল, শিশু পার্ক, ভূতের বাড়ি, মারমেড, প্যাডেল বোট, নৌকা, খেলার মাঠ, কফি হাউজ, কৃত্রিম ফোয়ারা, সুপার চেয়ার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা। শুধুমাত্র পিকনিক নয়, আপনি যেকোন সেমিনার, পার্টি বা সামাজিক আয়োজনের ব্যবস্থাও এখানে করতে পারবেন।

ঢোল সমুদ্র দীঘি

ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পাগল কানাই ইউনিয়নে এই আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানটি অবস্থিত। এটি ছিল রাজা মুকুট রায়ের একটি মহাকীর্তি। এই দিঘীটি এত জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হচ্ছে এর আকার। সমগ্র জলাশয়টি আয়তনে প্রায় ৫২ বিঘা। জলাশয়ের চারপাশে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপন করা হয়েছে এবং গাছগুলোর পরিণত রূপ সমগ্র এলাকার সৌন্দর্য কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় যে, রাজা মুকুট রায়ের শাসনামলে প্রজাদের পানির সঙ্কট দূরীকরনের জন্য বিশাল এই দীঘিটি খনন করা হয়।

কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসের মাধ্যমে আপনি ঝিনাইদহ যেতে পারবেন। আপনি যদি ট্রেনে যাত্রা করতে চান, সে ক্ষেত্রে সরাসরি ঢাকা থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত কোন ট্রেন  না থাকলেও আপনি খুলনা পর্যন্ত ট্রেনে যেতে পারবেন। সেখান থেকে খুব সহজেই আপনি ঝিনাইদহ পৌছাতে পারবেন। আর যদি আপনি বিমানে যেতে চান তবে আপনাকে ঢাকা থেকে যশোর বিমান যেতে পারবেন ও যশোর থেকে লোকাল ট্রান্সপোর্ট এর মাধ্যমে ঝিনাইদহ পৌঁছাতে পারবেন।

ঝিনাইদহে অতি উন্নত মানের বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ডিভাইন সেন্টার লিমিটেড, জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, এশিয়ান গেস্ট হাউস, রন্দীপ রিসোর্ট, হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল একাত্তর, হোটেল নীলাচল, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*