খুলনা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

Rate this post

বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর এবং খুলনা বিভাগের প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র হল খুলনা জেলা। শহরটি গড়ে উঠেছে ভৈরব ও রুপসা নদীর তীরে। সমুদ্র বন্দর থাকার কারণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শহরও বটে। বি এন এস তিতুমীর (বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সামরিক ঘাঁটি) রয়েছে খুলনাতে। খুলনা শহরের দর্শনীয় স্থানসমূহ এবং পর্যটন আকর্ষণসমূহ নিয়ে নিবেদিত এই প্রতিবেদনটি আপনার খুলনা ভ্রমণকে উৎকৃষ্ট করবে বলে আশা রাখি।

গণহত্যা জাদুঘর

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একদিনের সফলতা নয়। যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল শান্তি স্থাপন করা আর যুদ্ধের উৎপত্তি হয় এক পক্ষের উৎপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হবার ফলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে অসংখ্য মানুষ বলিদান এবং নির্যাতনের শিকার হয় পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে। কাছের মানুষের এমন যন্ত্রণা, নির্যাতন এবং শ্লীলতাহানি বাংলার মানুষকে তাদের প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধে যেতে ঠেকাতে পারেনি। এই নির্যাতন হলো সেই মহান আত্মত্যাগ ও যন্ত্রণা যার ফলে মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জাগিয়ে রাখতে এবং যারা বাঙালির সহ্য করা নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের যথাযথ প্রমাণ ও জবাব দিতে এই গণহত্যা যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের মে মাসে খুলনা গণহত্যা যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। যাদুঘরটি খুলনা শহরের সোনাডাঙা বাসস্ট্যান্ড এর দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে সুসজ্জিত রয়েছে ৭১ এর গণহত্যার ছবি, নির্যাতনের আলোকচিত্র, ঐতিহাসিকদের লিখা সমসাময়িক বই, নথিপত্র ইত্যাদি। দিন দিন এই জাদুঘর সমৃদ্ধ হচ্ছে এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান সমৃদ্ধ করছে।

গণহত্যা জাদুঘরের পক্ষ হতে খুলনা শহওে ২০ টিরও বেশি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে এবং স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে যথাযথ জ্ঞান বিতরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশনের সহায়তা নিয়ে ”জেনোসাইড টর্চার অ্যান্ড লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ সেন্টার” নামক প্রকল্প সম্প্রতি এখানে শুরু করা হয়েছে। এখানে তথ্য ও নথিপত্রের পাশাপাশি রয়েছে লাইব্রেরী, আর্কাইভ, খোলা মঞ্চ এবং ক্যাফেটেরিয়। সাংস্কৃতিক মঞ্চটি ন্যূনতম মূল্যে সাংস্কৃতিক কর্মীদের ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়।

খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাদুঘর হচ্ছে খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর। খুলনা জেলা শহরের শিববাড়ী মোড়ে অবস্থিত পাবলিক হলের পাশে এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৯৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগীয় বিভিন্ন পুরাকীর্তির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এখানে। পাল আমল, গুপ্ত সম্প্রদায়, সেন, মুঘল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়ে প্রাপ্ত বিভিন্ন ধরণের প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনসমূহ এখানে সংগ্রহিত ও প্রদর্শিত রয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে ক্যালিগ্রাফি, পোড়ামাটির ফলক, কাচের তৈজসপত্র, মাটির তৈজসপত্র, স্বর্ণমুদ্রা, তা¤্রমুদ্রা, কালো পাথরের মূর্তি, কস্টি পাথর, খেলনা, অস্ত্র, দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রী, ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে পার্কে ছবি তোলা নিষেধ।

শহীদ হাদিস পার্ক

খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্র পি সি রায় রোডে অবস্থিত শহীদ হাদিস পার্ক। ১৯২৫ সালের ১৬ জুন ভারতেবর্ষের স্বাধীনতার মহানায়ক মহাত্মা গান্ধী এখানে ভাষণ দেন। উল্লেখিত ভাষণের পর থেকে এই স্থানের নাম রাখা হয় গান্ধী পার্ক। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতায় এসে এই পার্কের নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় জিন্নাহ পার্ক। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ২১শে ফেব্রুয়ারীতে পুলিশের সাথে বিদ্রোহে জড়িয়ে মারা যান শহীদ শেখ হাদিসুর রহমান বাবু। ২২ ফেব্রæয়ারী ১ ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তৎকালীন ছাত্রনেতা লিয়াকত আলী সকল ভাষা স্বাধীনতাকামীদের জড়ো করে এই স্থানের নাম দেন শহীদ হাদিস পার্ক।

খুলনা সিটি কর্পোরেশন মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর এখানে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করেন। ৭৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই পার্কে শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয় যার আয়তন ৬,৮৬০ বর্গফুট। এই শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছে ঢাকা জাতীয় শহীদ মিনারের আদলে। তাছাড়াও এই পার্কে রয়েছে একটি হ্রদ ও ঝর্ণা রয়েছে। লেকের নিকটে রয়েছে বসার স্থানসমূহ এবং হাঁটাহাঁটি করার জন্য প্রশস্ত রাস্তা। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোর জন্য এটি একটি উত্তম স্থান।

ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যামিউসমেন্ট পার্ক

খুলনার সবচাইতে আধুনিক পার্ক হলো ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যামিউসমেন্ট পার্ক। খুলনার খালিশপুরে পার্ককে কেন্দ্র করে পার্কের মোড় নামক স্থান নামাঙ্কিত হয়েছে। পার্কটি ছোট হলেও গোছালো এবং পার্কের রাইডগুলো ছোটদের পছন্দ হবার মত। পার্কে কয়েক ধরণের চড়কি ও মেরি গো রাউন্ড রয়েছে। ছোটদের জন্য অত্যাধিক পছন্দের ইলেকট্রিক কার রাইড রয়েছে। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্য আরও একটি বিশেষ পছন্দের অ্যাক্টিভিটি রয়েছে যা হলো বাঞ্জি জাম্পিং।

পার্কের মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে ছোট একটি কৃত্রিম লেক। লেকের পানিতে ছোট প্যাডেল বোট রয়েছে। পার্কটি সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হলেও গত লকডাউন পিরিয়ডের পর থেকে পার্কের ভ্রমণার্থী কমে যাওয়ার কারণে, পার্কটি সবসময় খোলা থাকে না। এজন্য স্থানীয়দের পরামর্শ নিতে পারেন।

খান জাহান আলী সেতু (রুপসা সেতু)

খুলনা শহরে রুপসা সেতুর উপর নির্মিত ব্রিজের উপরের সেতুর নামকরণ করা হয়েছে খান জাহান আলী সেতু। এই সেতু দ্বারা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দরও মংলার সাথে সংযোগ স্থাপিত হয় বলে একে খুলনার প্রবেশদ্বারও বলা হয়। সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৬ কিলোমিটার। রুপসা সেতু থেকে নিকটবর্তী প্রাকৃতিক গ্রামীন পরিবেশ এবং নদীর সাথে তাদের প্রবহমান বন্ধন আকর্ষণীয়।

জাতিসংঘ শিশু পার্ক

খুলনার খান জাহান আলী রোডের পাশে অবস্থিত ইউ এন পার্ক বা জাতিসংঘ শিশু পার্ক। পার্কটি তার যাত্রা শুরু কওে ১৯৯৪ সালে এবং ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের (ইউনাইটেড নেশনস বা ইউ এন) ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পার্কটির নামকরণ করা হয় ইউ এন পার্ক। এটি খুলনার সবচাইতে বেশী জনসমাগমপূর্ণ পার্ক। সারা দিন এর চারপাশ দিয়ে যেন ব্যস্ততার মহড়া চলে, কারণ শহরের গুরুত্বপূর্ণ ইকোনমি অফিসগুলো এর পাশে অবস্থিত।

বিকালে এবং সন্ধ্যার পর পার্কে অভিভাবকেরা তাদের বাচ্চাদের নিয়ে এখানে বেড়াতে আসেন। এখানে শিশু এবং কিশোরেরা ইলেকট্রনিক গেম খেলতে পারে এবং বেবি রাইডে চড়তে পারে। অনেকে নির্মল প্রকৃতিতে একটু বিশ্রাম নিতেও হাজির হন আবার প্রবীণরা সাধারণত সকালে হাঁটাহাঁটি করতেও এখানে আসেন। তবে আপনি খুলনা গেলে অনায়াসে এই পার্কের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে যেতে পারেন।

খুলনা সোলার পার্ক

খুলনা শহরের সোনাডাঙায় অবস্থিত সোলার পার্ক। পার্কের প্রধান আকর্ষণ হলো পার্কের মাঝামাঝি বিস্তৃত লেক। এই লেককে ঘিরে তৈরি হয়েছিল সোলার পার্ক। পার্ক স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হ্রদের পানিতে ভাসমান সোলার প্যানেল বসানো যাতে শহরের অতিরিক্ত বৈদ্যুতিক চাহিদার যোগান দেয়া হয়। সোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৫০ মিলিয়ন ডলার। আশা করা যায় যে, ২০২৩ সালের অগাস্ট মাসে সোলার প্যানেল বসানো হবে। এখন পার্কে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোটদের রাইড যা শিশুরা বিনামূল্যে উপভোগ করতে পারে।

লেকের ধার ঘেঁষে রয়েছে বসার ব্যবস্থা। পুরো পার্কে লাগানো হয়েছে বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ যা পার্কের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে নির্মল এবং ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। পার্কের ভিতরে রয়েছে হাঁটাহাঁটি করার জন্য রাস্তা। অভিভাবক এবং প্রবীণেরা হালকা ব্যায়াম এর জন্যও এই পার্কে আসেন। পার্কের আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে যে, পার্কের লেকে রয়েছে প্রচুর মাছ যা খালি চোখেও দেখা যায় কারণ; ছোট ছোট মাছেরা পানির উপরের স্তরে সাঁতার কেটে বেড়ায়।

খুলনা পোঁছানোর জন্য ঢাকা থেকে সরাসরি বাস, ট্রেন ও লঞ্চ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পদ্মা সেতু স্থাপিত হবার পর থেকে সড়কপথে ও রেলপথে ভ্রমণ মানুষের জন্য সবচাইতে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। খুলনায় থাকার জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ও সরকারি কটেজ বা ডাক বাংলো রয়েছে। বেসরকারি হোটেলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিটি ইন লিমিটেড, টাইগার গার্ডেন ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, হোটেল ক্যাসেল সালাম, ওয়েস্টার্ন ইন ইত্যাদি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button