
বাংলাদেশের একটি পুরাতন শহর হল মুন্সিগঞ্জ। আপনি যদি এখানে ভ্রমনের উদ্দেশে আসেন তাহলে যেসব স্থানে যেতে পারেন, তা নিয়ে এই পোস্ট।
ইদ্রাকপুর দুর্গ
খ্রিস্টীয় ১৬ শতাব্দীতে দ্বিতীয় মীর জুমলা দ্বারা নির্মিত হয় ইদ্রাকপুর দুর্গ। দ্বিতীয় মীর জুমলা মুঘল আমলে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ সাম্রাজ্য দেখাশোনা করতেন এবং অঞ্চলগুলোকে জলদস্যুদের কাছ থেকে প্রতিরক্ষা দিতেন। ইদ্রাকপুর দুর্গ ছিল প্রতিরক্ষা কৌশল এর জন্য নির্মিত। দূর্গটি নদী মোহনা তীরে নির্মিত ছিল কারণ, জলদস্যুরা এই পথে আক্রমন করত।
এই কেল্লা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার এর মধ্যে অবস্থিত ছিল শীতলক্ষ্যা নদী, মেঘনা নদী, ধলেশ্বরী নদী ও ইছামতি নদী। পর্তুগিজ এবং মং জলদস্যুরা এসব নদী ব্যবহার করে ঢাকা তথা সোনারগাঁ, বিক্রমপুর এবং এর আশে পাশের অঞ্চল লুট করতে যেত। মীর জুমলা তাদেরকে নাস্তানাবুদ করতে এই দুর্গ নির্মাণের এবং গোলা নিক্ষেপ এর কৌশল ব্যবহার শুরু করেন। একসময় এটি নৌ ঘাটি হিসেবেও ব্যবহার হতো।
মুঘল আমলে নির্মিত হলেও ইদ্রাকপুর দুর্গ টির স্থাপত্যশৈলী মুঘল স্থাপত্য গুলোর সাথে মিলে না। প্রধান দুর্গের দুটি ভাগ রয়েছে, এগুলো হল পূর্ব এবং পশ্চিম অংশ। পূর্ব অংশটি চতুর্ভুজাকার এবং পশ্চিম অংশটি বহুভুজাকার। দূর্গটি নির্মিত হয়েছে ইট এবং পোড়ামাটি দিয়ে। দুর্গের চারপাশের বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা রয়েছে। সমগ্র নির্মাণ টি প্রায় ৯০ মিটার লম্বা এবং ৬০ মিটার প্রস্থ নিয়ে বিস্তীর্ণ। এখানে বেশকিছু টাওয়ার রয়েছে যা থেকে শত্রুদের গতিবিধি অনেক দূর থেকে লক্ষ্য করা যেত এবং গোলা নিক্ষেপ করে তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়া যেত।
পূর্ব অংশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে স্থাপিত রয়েছে বৃত্তাকার একটি ড্রাম। এই ড্রামের চারপাশে সাপোর্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। জানা গেছে যে এটি কামান বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। এই কক্ষের ভেতরে থেকে কামান পরিচালনার জন্য এবং গুলি ছোড়ার জন্য অনেকগুলো জানালা এবং ফাঁকা স্থানে রয়েছে।
তাছাড়াও এই গ্রাম থেকে ভূগর্ভস্থ কক্ষে যাওয়ার জন্য গোপন সিঁড়ি রয়েছে। ভূগর্ভস্থ কক্ষটি ছিল অস্ত্র এবং বিস্ফোরকের গুদাম। কিছু পুরাতাত্ত্বিকদের মতে দুর্গটি থেকে লালবাগ কেল্লা পর্যন্ত গোপন সুরঙ্গ সংযুক্ত ছিল। মোঘল আমলের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দুর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু কমপ্লেক্স
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি প্রতিভা। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী, উদ্ভিদ বিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং কল্পবিজ্ঞান জগতের লেখক। তাঁর জন্মস্থান ছিল মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর এবং তার জন্মস্থান হয়ে উঠেছে বর্তমানের একটি পর্যটন স্থল। এটি মুন্সীগঞ্জের ঢাকা- দোহার মহাসড়কের রাড়িখালে অবস্থিত। তার বাসস্থান কে ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের ভিতরে রয়েছে পুকুর, পাশে বসার জায়গা, সুন্দর পাকা সেতু এবং পাকা খাল। পাশাপাশি রয়েছে মানবসৃষ্ট গুহা এবং বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য। এটি একই সাথে স্মৃতিসৌধ এবং পার্ক হিসেবে ভ্রমণের উপযুক্ত।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভিদবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাছাড়াও রেডিও এবং মাইক্রোওয়েভ অপটিকস এর অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রাখেন। তাকে বলা হত কল্পবিজ্ঞানের জনক। তার অবদানের কারণে তাকে ১৯০৩ সালে কম্পানিয়ন অফ দ্যা অর্ডার অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার (সি আই ই), ১৯১১ সালে স্টার অফ ইন্ডিয়া এবং ১৯১৭ সালে নাইট ব্যাচেলর হিসেবে সম্মানিত করা হয়। উদ্ভিদের বৃদ্ধি পরিমাপের একটি যন্ত্র ক্রেস্কোগ্রাফ আবিষ্কার করেন তিনি।
বিক্রমপুর জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
বিক্রমপুর জাদুঘর এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বালাসুর গ্রামে রাজা শ্রীনাথ রায়ের বাসস্থান। পরিবারের শেষ জমিদার ছিলেন জাদুনাথ রায়। এখানে রয়েছে বিশাল জমিদার বাড়ি এবং ২০০ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত মন্দির। জমিদার জাদুনাথ রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে, বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন এবং সরকারি অর্থায়নে ২০১৪ সালে নির্মাণ হয়েছে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কেন্দ্রটি শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ১ টা এবং দুপুর ২ টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
প্রধান ফটকের দুই পাশে রয়েছে বড় দুইটি মাটির পাতিল। বাম পাশের গ্যালারিতে রয়েছে জমিদার জাদুনাথ রায়ের ব্যবহৃত বস্তু সামগ্রী। তাছাড়াও রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক আলোকচিত্র। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহার এর আলোকচিত্র, ইদ্রাকপুর কেল্লা, হযরত বাবা আদম এর মসজিদ, অতীশ দীপঙ্করের পরিচিতিমূলক বিবরণী, কলকাতা যাদুঘরে সংরক্ষিত কষ্টিপাথরের মূর্তি, ইত্তাদি’র আলোকচিত্র। এসব ছারাও রয়েছে পোড়ামাটির খেলনা, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমূহ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক মন্দির ও মঠের আলোকচিত্র ইত্যাদি।
সোনারং জোড়া মঠ
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার একটি গ্রামের নাম হল সোনারং। এই গ্রামেতে পাশাপাশি অবস্থিত দুটি মঠ রয়েছে, যা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য উপাসনালয়। মঠ দুইটি পাশাপাশি হবার কারণে জায়গাটি জোড়া মঠ বলে পরিচিত। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় হলেও, এখানে প্রার্থনা বা উপাসনামূলক কর্মকান্ড এখন আর হয় না। একটি মঠ প্রায় ১৫০ ফুট উঁচু। দুই মঠের উচ্চতার মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। বড় মূর্তি হিন্দু দেব শিব এবং ছোটটি কালী দেবীর উপাসনার উদ্দেশ্যে নির্মিত। মঠগুলো নির্মিত হয় যথাক্রমে ১৮৪৩ এবং ১৮৮৬ সালে। স্থাপনার ৩ পাশে পরীখা দিয়ে বিস্তৃত। বাকি ১ দিকে রয়েছে মূল প্রবেশপথ। এটি মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক স্থান।
১২ আউলিয়ার মাজার
হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত হচ্ছে ১২ আউলিয়ার মাজার। একসময় এটি মুসলিমদের জন্যও গন্তব্যস্থল ছিল। মুন্সিগঞ্জ এর পূর্ব নাম ছিল বিক্রমপুর। বিক্রমপুরের সবচাইতে প্রাচীন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল ১২ আউলিয়ার মাজার। ১২ জন মুসলিম আউলিয়া’র জন্য স্থানটি উপাসনালয় হলেও, পরবর্তীতে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখানে আবাস গড়ার জন্য; এটি বৌদ্ধদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিক্রমপুর উপজেলার কেউর গ্রামে অবস্থিত।
অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত ভিটা
অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের পন্ডিত এবং একই সাথে সম্মানিত একজন শিক্ষক। ধর্মের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি সারাজীবন পরিশ্রম করেন। বিক্রমশিলা স্কুলের প্রতিষ্ঠার পর তিনি সেখানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। স্থানটি মুন্সীগঞ্জ শহরের সদরের নিকটে বজ্রযোগিনী গ্রামে অবস্থিত।
হরিশচন্দ্র দিঘী
বাংলার বিখ্যাত রাজা হরিশচন্দ্র মুন্সীগঞ্জের রামপালে নির্মাণ করেন হরিশ্চন্দ্র দিঘী। রাজা হরিশচন্দ্র অতি দানশীল ছিলেন। তার সময় মানুষজনের খাবার জলের অভাব দেখে, সংকট নিরসনের উদ্দেশ্যে রাজা হরিশচন্দ্র এই দিঘিটি খনন করেছিলেন। এখনো প্রতি বছর এখানে স্থানীয় মেলা বসে। হিন্দুরা স্থানটিকে পবিত্র বলে মানে এবং তাদের অবিবাহিত কন্যা থাকলে তাদের বিয়ে হওয়ানোর উদ্দেশ্য পূজা পাঠ এবং আনুষ্ঠানিকতা পালন করে। বর্তমানে সাধারণ মানুষজন এই হ্রদটি ব্যবহার করে।
বাবা আদম মসজিদ
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার কসবা গ্রামে অবস্থিত বাবা আদম মসজিদ। ১১৭৩ সালে হযরত বাবা আদম শহীদ এই অঞ্চলে আসেন এবং ইসলাম ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। ১১৭৮ সালে তিনি সিপাহী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মারা যান। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৪৮৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বাবা আদমের মাজারে পাশাপাশি আরেকটি ৬ গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে এখানে।
শ্যামসিদ্ধির মঠ
শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত শ্যামসিদ্ধির মঠ মুন্সীগঞ্জের আরেকটি বিখ্যাত পর্যটন স্থল। ১৭৫৮ শম্ভু নামক একজন অবস্থাশালী সনাতন ধর্মাবলম্বী এই মঠের নির্মাণ করেন।
ফেগুনাসার শিব মন্দির
ইসামতি নদী পার হওয়ার পর সিরাজদিখান হয়ে ঢাকা-বেতকা (সিরাজদিখান) মহাসড়কের বাম পাশে একটি হিন্দু মঠ রয়েছে যা সেগুন আশা শিব মন্দির নামে পরিচিত মন্দিরটি 150 ফুটমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রায় 200 বছর আগে মন্দিরের ভিতরে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ লম্বা প্রতিদিন এখানে অনেক সোনাতন ধর্মবলম্বী পূজা অর্চনা করতাছেন মন্দিরের চারপাশে রয়েছে অসংখ্য ফুলের গাছ এবং স্থান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত।
ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জ পৌঁছাতে সময় লাগে এক থেকে দুই ঘন্টা। যদিও স্থানটি ঢাকার নিকটে কিন্তু রাত কাটাবার জন্য উপযুক্ত স্থান এখানে নেই বললেই চলে। এর জন্য একদিনে ভ্রমণ করে চলে আসায় সবচাইতে উত্তম। তবে হোটেল কম্ফর্ট নামে একটি থ্রি স্টার হোটেল মুন্সীগঞ্জে রয়েছে। তা ব্যতীত কিছু মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে যাতে আপনি স্বল্পমূল্যে থাকতে পারবেন।
আপনার কক্ষের উপর ভিত্তি করে ১০০ থেকে ৭০০ টাকা’র মধ্যে রাত কাটানো সম্ভব। হোটেলগুলো হল পদ্মা রিসোর্ট, মাওয়া রিসোর্ট এবং পদ্মা রেস্ট হাউস। উল্লেখিত স্থান গুলো ছাড়াও এখানে ভ্রমণের জন্য রয়েছে মাঝিপাড়া নগর, কসবা, রামপাল দীঘি, ঘোড়াশাল জমিদার বাড়ি, নাটেশ্বর বৌদ্ধ বিহার, ধলেশ্বরী নদী, ইত্যাদি।
Leave a Reply