
সাতক্ষীরা হচ্ছে খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বর্ডার সংলগ্ন একটি জেলা। সাতক্ষীরা জেলাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে ভরপুর একটি অঞ্চল। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণের সময় সাতক্ষীরা হতে পারে আপনার জন্য একটি উপযুক্ত গন্তব্যস্থল। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে ১৮৬১ সালে সাতক্ষীরা একটি মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা যশোর জেলার অধীনে ছিল।
১৮৮২ সালে সাতক্ষীরা খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হবার পরেও ১৮৮৪ সালে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ঘটার পরে সাতক্ষীরা একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮৯ সালে সাতক্ষীরাকে পৌরসভা হিসেবেও মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাতক্ষীরা জেলার আকর্ষণীয় পৌরাণিক ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো নিয়ে এই পোস্টটি শেয়ার করা হলো।
কলাগাছিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক
কলাগাছিয়া ইকোপার্ক সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে অবস্থিত। পার্কের এক পাশের অঞ্চল লোকালয় দিয়ে ঘেরা এবং অন্য পাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। পার্কের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে খোলপেটুয়া নদী, যা ইকো পার্কের সৌন্দর্যকে আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানকার জীব বৈচিত্র সাধারণ ম্যানগ্রোভ বৃক্ষ সমূহ এবং কিছু হরিণ ও বানর নিয়ে গঠিত। এখানকার প্রধান বৃক্ষ হচ্ছে বাইন, খলিশা, এবং হরকোশা।
পার্কের বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ উপভোগের জন্য এখানে স্থাপন করা হয়েছে ৫ তলা উচ্চতাবিশিষ্ট পর্যটন টাওয়ার। এখানে উঠলে আপনি মনোরম প্রকৃতির সাথে সাথে বিভিন্ন প্রজাতির উড্ডয়নরত পাখির চলাফেরা লক্ষ্য করতে পারবেন। পার্কের ভেতরে দুইটি ব্রিজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে লোহার তৈরি যা মূল পার্কে প্রবেশ করতে সাহায্য করে এবং আরেকটি হচ্ছে কাঠের ব্রিজ যা পার হলে রেস্ট হাউজের পথে যাওয়া যায়।
পার্কের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে একটি শিব মন্দির রয়েছে যা বনবিবির শিবমন্দির নামে পরিচিত। স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস অনুযায়ী জানা যায় যে, এই মন্দিরে পূজা অর্চনা করলে বনের ভিতরের যাবতীয় বিপদ ও দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কলাগাছিয়া পার্কটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় নীলডুমুর নামক গ্রামে অবস্থিত। পার্কের মূল অংশে যাবার জন্য নীলডুমুর ঘাট থেকে নৌকা বা ট্রলার ভাড়া নিতে হয়। নৌকা যাত্রা সাধারণত ২০ থেকে ৩০ মিনিট মত সময় নেয়। এই নৌকা ভ্রমনে যাত্রী প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা ভাড়া পরে।
ইকোপার্কে ভ্রমণের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কিছু সাধারন নিয়ম কানুন মানতে হয়। এখানে ভ্রমণ করার সময় অবশ্যই গাইডের সাথে থাকা জরুরি। তাছাড়া পার্কে ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত কিছু ট্রেইল রয়েছে। এসব ট্রেলের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে ঘোরাফেরা থেকে বিরত থাকতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা সামাল দিতে প্রত্যেক গ্রুপে ফাস্ট এইড বক্স ক্যারি করুন। এখানকার ভ্রমণ লম্বা বলে, সাথে পরিষ্কার পানি এবং শুকনো খাবার নিতে পারেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, পার্কের ভেতরে কোন পশু বা পাখি কে বিরক্ত বা শিকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যশোরেশ্বরী কালী মন্দির
যশোরেশ্বরী শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে যশোরের দেবী। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার ইশ্বরীপুর নামক স্থানে এই মন্দিরটি অবস্থিত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই মন্দিরটি একটি তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। হিন্দুদের ইতিহাস অনুযায়ী, তাদের মহাদেবতা শিবের স্ত্রী ছিলেন সতি। কিন্তু শিব, সতিকে বিয়ে করেছিলেন তার পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ফলস্বরূপ বিবাহের পর সতীর পিতা তাকে এবং তার স্বামীকে মেনে নিতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় সতি তার স্বামীর সম্মান বজায় রাখার জন্য আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনায় মহাদেব অত্যন্ত শোক প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে বিষ্ণুদেব তার চক্রের সাহায্যে সতীর দেহ ৫০ ভাগ করে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। যেসব স্থানসমূহে সতির দেহের অংশ ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সেসব স্থানগুলোকে বলা হয় শক্তিপীঠ। যশোরেশ্বরী কালী মন্দির এই ৫০ টি শক্তিপীঠের অন্যতম। লোকমুখে শোনা যায়, আনাড়ি নামক এক ব্রাহ্মণ এই মন্দিরে ১০০ টি দরজা স্থাপন করেছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত মন্দিরের স্থাপনকাল সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে লক্ষণ সেন এবং মহারাজা প্রতাপাদিত্য এই মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করেন।
তেতুলিয়া জামে মসজিদ
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম একটি নিদর্শন হচ্ছে তেতুলিয়া জামে মসজিদ, যা সাতক্ষীরা জেলা শহরের তেতুলিয়া গ্রামে অবস্থিত। মসজিদটির এলাকাভিত্তিক নাম হচ্ছে মায়ের মসজিদ বা তেতুলিয়া জামে মসজিদ কিন্তু মসজিদটির পৌরাণিক নাম হচ্ছে খান বাহাদুর সালামত উল্লাহ জামে মসজিদ। এই মসজিদে ৫০০ জনের বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বী একত্রে নামাজ পড়তে পারেন। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অন্তর্ভুক্ত একটি পুরাতাত্ত্বিক মসজিদ যা ১৯৮৭ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা সংরক্ষিত হয়ে আসছে।
মান্দার বাড়ি সমুদ্র সৈকত
বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশকে যেসব অসম্ভব সুন্দর সমুদ্র সৈকতগুলো দিয়েছে তাদের মধ্যে বিশেষ একটি সমুদ্র সৈকত হল মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত। এই সৈকতটি বৈচিত্র্যময় হওয়ার কারণ হচ্ছে যে, সৈকতের একদিকে রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র আর অন্যদিকে রয়েছে বিশাল সুন্দরবন। সাতক্ষীরা থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরবর্তী এই সমুদ্র সৈকতটি বাংলাদেশের অনেক মানুষের কাছে অজানা একটি গন্তব্য। এই সৈকতটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪ কিলোমিটার।
এই সৈকতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে প্রবহমান আছড়ে পড়া ঢেউয়ের অবিরাম গর্জন শুনতে পাওয়া যায় এবং একই সাথে আপনি দেখতে পাবেন বালিহাস, পানকৌড়ি এবং আরো অন্যান্য প্রজাতির পাখি। আপনি গহীন জঙ্গলের সুন্দরবন অংশে হরিণ দেখতে পেতে পারেন। এই সৈকত টি তুলনামূলকভাবে কম জনবহুল। আপনি যদি সৌভাগ্যবান হন সেক্ষেত্রে আপনি বাঘের পায়ের ছাপও দেখতে পেতে পারেন, যা আপনার ভ্রমণ উত্তেজনাকে কয়েকগুন বাড়িয়ে দিতে পারে।
জোড়া শিবমন্দির
সাতক্ষীরা জেলা শহরের ছাঘরিয়া গ্রামে পাশাপাশি দুইটি শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা জোড়া শিব মন্দির নামে পরিচিত। এই মন্দিরটি বাংলা ১২২০ সালের পহেলা বৈশাখ ফকির চাঁদ ঘোষ দ্বারা নির্মিত হয়। এই মন্দিরটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, ভবন দুইটি টেরাকোটা নামক এক বিশেষ ধরনের ইট দ্বারা নির্মিত হয়েছে। ইদানিংকালে মন্দির দুটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
তারপরও বিভিন্ন পর্যটক ও ভ্রমণকারী এই মন্দিরটি আগ্রহের সাথে দেখতে আসেন। এখানকার দর্শকদের আগমনের আরেকটি কারণ হচ্ছে যে, মন্দিরগুলোর দেয়ালে পোড়ামাটি দিয়ে নকশা তৈরি করা হয়েছে। এসব অলংকরণের মধ্যে রয়েছে লতা- পাতা, ফুল, দেব- দেবী, অশ্বারোহী, বাদ্যযন্ত্র বাদক, ইত্যাদির চিত্রকর্ম।
মোজাফফর গার্ডেন এন্ড রিসোর্ট
এই গার্ডেন এবং রিসোর্টটি স্থানীয়ভাবে মন্টু মিয়ার বাগানবাড়ি হিসেবেও পরিচিত। সমগ্র রিসোর্টের আয়তন হচ্ছে ১২০ বিঘা। এখানে রয়েছে খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সবুজের সমারোহ। নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য এবং পরিবার সমেত ছুটি কাটানোর জন্য এটি একটি অত্যন্ত উপযুক্ত স্থান। সমগ্র রিসোর্টে মোট চারটি ভবন রয়েছে, যাতে সব মিলিয়ে রয়েছে ৩০ টি কক্ষ।
এখানে বিনোদন এবং আতিথেয়তার যাবতীয় সুযোগ- সুবিধা রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং মিটিং এর জন্য রয়েছে অডিটোরিয়াম, মিটিং রুম, এবং কনফারেন্স রুম। ছোটদের আনন্দ দেবার জন্য এখানে রয়েছে শিশু পার্ক, খেলার মাঠ, চিড়িয়াখানা এবং বিভিন্ন প্রাণীর ভাস্কর্য। আগত অতিথিদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে টেবিল টেনিস এবং ব্যাডমিন্টন কোর্ট।
এখানে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে মসজিদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব ছাড়াও রিসোর্টের বিশেষ দিক হচ্ছে এখানকার ছোট চিড়িয়াখানাটি বাংলাদেশের বেসরকারি মালিকানাধীন সর্ববৃহৎ চিড়িয়াখানা হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।
কীভাবে যাবেন কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি সাতক্ষীরা পর্যন্ত বাস সার্ভিস পাওয়া যায়। কিন্তু এই রুটে সরাসরি কোন ট্রেন চলাচল করে না। তবে আপনি যদি ট্রেনে যাত্রা করতে চান, সেক্ষেত্রে আপনাকে ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনা যেতে হবে এবং খুলনা থেকে আলাদাভাবে বাস বা গাড়িতে চড়ে সাতক্ষীরা যেতে হবে।
সাতক্ষীরাতে থাকার মতো বেশ কয়েকটি ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে বিশেষ হোটেলগুলো হলো, হোটেল সম্রাট, হোটেল সংগ্রাম, হোটেল মোহনা, মোজাফফর গার্ডেন, হোটেল সীমা, হোটেল উত্তরা, ইত্যাদি।
Leave a Reply