নারায়ণগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

নারায়ণগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী একটি শহর হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। ঢাকা’র দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত এই শহর, বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহত্তম শহর হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক পাটকল। পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পাটকে ঘিরে ব্যবসার জন্য নারায়ণগঞ্জকে বলা হয় বাংলাদেশের ডান্ডি। নারায়ণগঞ্জ শহরের নামকরণ করা হয়েছে বিকন লাল পান্ডে’র মাধ্যমে, যিনি ছিলেন একজন হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় নেতা। বিকন লাল পাণ্ডে লক্ষ্মী ঠাকুর বা বেনুর ঠাকুর নামেও পরিচিত ছিলেন। ১৭৬৬ সালে পলাশী যুদ্ধের সময় তিনি এই স্থানটি ইজারা নেন।

এরপর তিনি স্থানটি পূজার ও মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের কাজে দান করেন। তার উপাস্য দেবতার নাম ছিল নারায়ন, যা থেকে নারায়ণগঞ্জ নামটি এসেছে। নারায়ণগঞ্জের দর্শনীয় স্থান সমূহ নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদনটি আপনাদের কাছে পেশ করা হল যা আপনাদের নারায়ণগঞ্জ ভ্রমণ সাহায্য করবে।

সোনাকান্দা দুর্গ

নারায়ণগঞ্জের অন্যতম প্রধান প্রাচীন দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সোনাকান্দা দুর্গ। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত সোনাকান্দা দুর্গ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক পুরাতন কাহিনী। একটি পুরা কাহিনী অনুসারে বিক্রমপুরের শাসক কেদার রায় এর কন্যা শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করতেন গিয়েছিলেন। রাজকুমারীর নাম ছিল স্বর্ণময়ী, কিন্তু হঠাৎ করে একদিন জলদস্যুরা তাকে অপহরণ করে। পরবর্তীতে ইশা খান (তৎকালীন সোনারগাঁয়ের শাসক) তাকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন।

কিন্তু কেদার রায় তার কন্যাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন, কারণ সে মুসলিম শাসকের দুর্গে রাত কাটিয়েছিলেন; যা তাদের ধর্ম অনুসারে জাত হরণ এর সমতুল্য। উল্লেখিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মর্মাহত স্বর্ণময়ী বেশ কিছুদিন বাইরে রাত কাটিয়েছিলেন এবং ক্রন্দন করেছিলেন। সেখান থেকেই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা দুর্গ যার অর্থ স্বর্ণের ক্রন্দন। আরেকটি কাহিনী অনুসারে ইশা খান জোর করে কেদার রায়ের কন্যা কে বিবাহ করেছিলেন। স্বর্ণময়ী ঈশা খাঁ’র সৈন্য দ্বারা বন্দী হবার পর আবার তার পিতার দুর্গে ক্রন্দনরত অবস্থায় ফিরে আসেন। উল্লেখিত ঘটনা সোনাকান্দা নাম হবার পিছনের রহস্য।

সোনাকান্দা দুর্গটি মূলত তৈরি হয়েছিল জলদস্যুদের নাস্তানাবুদ করার উদ্দেশ্যে। জলদস্যুরা যাতে নদী পথ পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ বা সোনারগাঁয়ে আক্রমণ করতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে গোলন্দাজ বাহিনী বসানো হয় সোনাকান্দা দুর্গে। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় মীর জুমলা ১৬৬০ সালে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন। এটির নির্মাণ শৈলী মুঘল আমলের। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে এই দুর্গটি।

শেখ রাসেল পার্ক

নারায়ণগঞ্জে নির্মিত পার্কগুলোর মধ্যে অত্যাধুনিক মনের সেরা পার করছে শেখ রাসেল পার্ক। এখানে রয়েছে বিনোদনের এবং সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন রকমের ব্যবস্থা। বাচ্চাদের জন্য রয়েছে খেলার মাঠ আর বড়দের বিশ্রামের জন্য রয়েছে বসার ব্যবস্থা। তাছাড়াও এর রাস্তা ধরে বড়রা হাঁটতে পারেন এবং শরীরচর্চা করতে পারেন। পার্কের ভিতরে রয়েছে একটি স্কুল এবং একটি চারুকলা ইনস্টিটিউট। এখানে একটি মুক্তমঞ্চ রয়েছে যা সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। এখানকার পরিবেশ অত্যন্ত প্রশান্তিকর। সেজন্য অনেক মানুষ ছুটে আসে নিজের মনকে প্রশান্ত করতে এবং বিনোদনের উদ্দেস্যে।

হাজীগঞ্জ দুর্গ

নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হাজিগঞ্জ এলাকায় নির্মিত হয়েছে হাজীগঞ্জ দুর্গ। এই দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয় পর্তুগিজ এবং মং জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার নিমিত্তে। বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা নদীর মোহনার পাশে নির্মিত হয়েছিল এই দুর্গটি। অনেকে এই দুর্গকে খিজারপুর দুর্গ বলে আখ্যায়িত করে। চতুর্ভুজাকৃতির এই দুর্গে একটি প্রাচীর রয়েছে যা পঞ্চভুজাকৃতির এবং গোলন্দাজ বাহিনীর ব্যবহারের উপযুক্ত।

পর্দার প্রাচীর এর ভিতর ১.৫ মিটারের পুরো দেয়াল রয়েছে। এখানে দেয়াল মোটা বানানোর উদ্দেশ্য হল যাতে কামান বসানো যায় এবং কামানের ধাক্কায় দুর্গার কোন ক্ষতি না হয়। অন্যপাশের চৌকোনা অংশটি মূলত টহল বাহিনীর কর্মকাণ্ডের জন্য ছিল। বর্তমানে হাজিগঞ্জ দুর্গটি নারায়ণগঞ্জের অগ্নি নিয়ন্ত্রক বাহিনীর বা ফায়ার ব্রিগেডের সদরদপ্তর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এন ও এম পার্ক

এন ও এম পার্ক এর পুরো নাম হচ্ছে নাসিম ওসমান মেমোরিয়াল অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। বর্তমান সময়ে নারায়ণগঞ্জের অন্যতম প্রধান বিনোদন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই পার্কটি। প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সের মানুষের ভিড়ে মুখরিত হয়ে থাকে এই পার্ক। শিশুদের জন্য এখানে রয়েছে আকর্ষণীয় রাইডের ব্যবস্থা।

পার্কের ভিতরে রয়েছে একটি ৯ ডি বা নয় মাত্রিক থিয়েটার। তাছাড়া রয়েছে খেলনার দোকান, ফাস্টফুডের দোকান, বুটিক হাউস এবং স্প্ল্যাশ প্যাড। উল্লেখ্য যে এই ধরনের স্প্ল্যাশ প্যাড বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। পার্কের ভিতরে রয়েছে জেড এন টি নামক একটি রেস্তোরাঁ। এটি আন্তর্জাতিক মানের একটি রেস্তোরাঁ। তাছাড়াও এখানে যেসব খাবার পাওয়া যায় তা পাঁচ তারকা হোটেলের খাবারের সমতুল্য।

রেস্তোরাঁতে পরিবেশন করা হয় কন্টিনেন্টাল, থাই এবং ইন্ডিয়ান খাবার। পার্কে প্রবেশের টিকিট এর মূল্য হচ্ছে ১০০ টাকা। পার্কটি সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানকার রাইডগুলোর মধ্যে রয়েছে জায়ান্ট হুইল, কিড জিনিয়া, জেট কোস্টার, মেরি গ্রাউন্ড, ওয়াটার কোস্টার, সান্তা মারিয়া, স্লিপার, মিনি জায়ান্ট হুইল, বাম্পার কার, ফ্লাওয়ার কাফ ইত্যাদি।

আশরাফিয়া জামে মসজিদ

নারায়ণগঞ্জের আলম পাড়া এলাকায় কে. বি. সাহা বাই লেন নামক স্থানে অবস্থিত হচ্ছে আশরাফিয়া জামে মসজিদ। এটি মুঘল সাম্রাজ্যের পুরাকীর্তি। উক্ত মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৮৯০ সালে। নারায়ণগঞ্জ এর অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হচ্ছে এটি। মসজিদের পশ্চিম পাশের দেয়ালে রয়েছে একটি মেহরাব। রহিম বখশ হাজী নামে একজন বাঙালি মুসলিম জমিদার এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায় যে, জমিদারের স্ত্রীর নাম ছিল আশরাফিয়া (যার অর্থ আহ্লাদী) এবং তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে জমিদার হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরীর কাছ থেকে এই মসজিদটি জমি কিনে নেন।

পরবর্তীতে তার স্বামী মসজিদটির নির্মাণকার্য পরিচালনা করেন। ব্রিটিশ মানচিত্রে এই মসজিদের উল্লেখ পাওয়া গেছে। এতে কাঁচ এবং পাথর দিয়ে তৈরি মুঘল শৈলী সহ আরবি ক্যালিগ্রাফিতে লেখা ফলক রয়েছে। মিহরাবের নকশা কাঁচের টুকরো এবং পাঁচ রঙের পাথর দিয়ে তৈরি; (নীল, সবুজ, হলুদ বা হালকা ম্যাট, বাদামী এবং সাদা)। এতে কাঁচ এবং পাথর দিয়ে তৈরি মুঘল শৈলী সহ আরবি ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। মসজিদের স্থাপত্যকে সংজ্ঞায়িত করা হয় মিহরাব, খিলান, গম্বুজ, ইত্যাদি উপাদানগুলির মধ্যে জ্যামিতিক সমন্বয় এবং অলঙ্করণের সংমিশ্রণ দ্বারা । ২০০২ সালে মসজিদটির সংস্কার কার্য চালানো হয় তবে মসজিদের অনেক অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য মসজিদের পূর্ববর্তী সৌন্দর্য অবশিষ্ট নেই।

সারিঘাট

শহরের আবদ্ধ পরিবেশ থেকে মানুষ যখন হাপিয়ে ওঠে তখন প্রকৃতির সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য মানুষ সারিঘাট এর মত এলাকায় বেড়াতে আসেন। এখানকার প্রকৃতি হচ্ছে সম্পূর্ণরূপে নির্মল। মানুষ প্রকৃতির সাথে নিজের আত্মাকে আবদ্ধ করার জন্য সারিঘাটের পদার্পণ করেন। সারিঘাট হচ্ছে কাশবনে ঘেরা এলাকা। শরতের সময় স্থানটি দেখার মত, আবার বর্ষাকালে তার আরেক রূপ ও একইভাবে শীতকালেও তার রূপ পরিবর্তিত হয়। সারিঘাট কাশবন সারিঘাট হচ্ছে বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রোজেক্টের পিছনের একটি এরিয়া যা আইন্তা এবং আড়াকুল গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি খালের অংশবিশেষ। তবে শুধুমাত্র কাশবনে সারিঘাটের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়।

সারিঘাট এলাকার শুরুর দিকে রয়েছে কায়াকিং, যাতে প্রতি জনে লাগবে ১৫০ টাকা। তাছাড়া এখানে ভাড়া করা নৌকা পাওয়া যায়। নৌকাগুলো প্রতি ঘন্টা ভ্রমণের জন্য ১০০ টাকা করে চার্জ করে। খাওয়ার জন্য এখানে রয়েছে বেশকিছু রেস্টুরেন্ট যাতে আপনি বারবিকিউ এবং ফাস্টফুড। তাছাড়াও হালকা খাবারের জন্য কয়েকটি টং এবং ভাজাপোড়া দোকান রয়েছে।

আপনি যদি নারায়ণগঞ্জ যেতে চান তবে আপনার জন্য সবচাইতে ভালো হবে ঢাকা থেকে একটি ট্যাক্সি বা কার ভাড়া নেয়া। তাছাড়াও আপনি বাসে চড়ে নারায়ণগঞ্জ পৌছাতে পারেন। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ১৮ কিলোমিটার। নারায়ণগঞ্জে থাকার জন্য অনেকগুলো সুন্দর হোটেল এবং আবাসন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো হোটেল স্টার সিটি, হোটেল রহমানিয়া, হোটেল সেভেন স্টার ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*