আজকে আমরা যে রচনাটির নিয়ে আলোচনা করব সেটি আপনাদের জন্য একটি কাঙ্খিত রচনা। সেটি হল:
পদ্মা সেতু
অথবা পদ্মা বহুমুখী সেতু
ভূমিকা: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ কারণে গতিশীল যোগাযোগ ব্যবস্থা আর্থিক উন্নয়ন এবং জাতীয় অগ্রগতিতে বহুমুখী পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সারা দেশের সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হবে। পদ্মা বহুমুখী সেতু আমাদের স্বপ্নের সেতু। এই সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে রাজধানীর সাথে একটি অর্থনৈতিক ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অনেক জল্পনা-কল্পনার পড়ে সেই পদ্মা সেতু গত ২৫ শে জুন ২০২২ সালে উদ্বোধন করা হয়।
এক নজরে পদ্মা সেতু:
বিশ্বের ১১তম দীর্ঘ সেতুর পুরো নাম ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’।
* * সেতুটি নির্মাণের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে।
* এই সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড
* * সেতুর নকশা প্রণয়ন করেছে আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম AECOM।
দৈর্ঘ্য : ৬.১৫ কিলোমিটার
ভায়াডাক্ট (স্থলভাগে সেতুর অংশ) সহ দৈর্ঘ্য : ৯.৮৩ কিলোমিটার
প্রস্ত : ২১.৬৫ মিটার
মোট পিলারের সংখ্যা : ৪২টি
স্প্যানের সংখ্যা : ৪১টি
প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য: ১৫০ মিটার
স্প্যানগুলোর মোট ওজন: ১,১৬,৩৮৮টন
প্রতিটি পিলারে নিচে পাইলের সংখ্যা: ৬টি (কিছু কিছু পিলারে ৭টি পাইলও দেওয়া হয়েছে)
পাইলের ব্যাস: ৩ মিটার
পাইলের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য: ১২৮ মিটার
মোট পাইলের সংখ্যা: ২৬৪টি (ভায়াডাক্টের পিলারের পাইলসহ ২৯৪টি)
জমি অধিগ্রহণ: ৯১৮ হেক্টর
ব্যবহৃত স্টিলের পরিমাণ : ১,৪৬,০০০ মেট্রিক টন
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন: ৪ জুলাই-২০০১
নির্মাণ কাজ শুরু : ৭ ডিসেম্বর ২০১৪
মূল সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু : মাওয়া প্রান্তে ৬ নম্বর পিলারের কাজ দিয়ে
সক্ষমতা : দৈনিক ৭৫ হাজার যানবাহন
পানির স্তর থেকে সেতুর উচ্চতা: ১৮ মিটার
পদ্মা সেতুর আকৃতি: ইংরেজি এস (S) অক্ষরের মতো
ভুমিকম্প সহনশীলতা : রিক্টার স্কেলে ৮ মাত্রার কম্পন
এপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্য: ১২ কিলোমিটার
নদীশাসন: ১৬.২১ কিলোমিটার
সেতুর আয়ুষ্কাল: ১০০ বছর
সেতুর মোট ব্যয়: ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা।
ঢাকার সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে এমন জেলার সংখ্যা: ২১টি
সরাসরি উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা: দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষ
যেসব দেশের বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীরা কাজ করেছেন : চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, অট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ন্যাদারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, থাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
প্রকল্পের অঙ্গ(Component) ভিত্তিক ব্যয় বিভাজন:
ক) মূল সেতুর ব্যয়: ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন টাওয়ার ও গ্যাস লাইনের ব্যয়সহ ১১,৯৩৮.৬৩ কোটি টাকা (বরাদ্দ ১২,১৩৩.৩৯ কোটি টাকার বিপরীতে)
খ) নদীশাসন কাজ: ৮,৭০৬.৯১ কোটি টাকা (৯,৪০০ কোটি টাকার বিপরীতে)
গ) অ্যাপ্রোচ রোড: ২টি টোল প্লাজা, ২টি থানা বিল্ডিং ও ৩টি সার্ভিস এরিয়াসহ ১৮৯৫.৫৫ কোটি টাকা (১৯০৭.৬৮ কোটি টাকার বিপরীতে)
ঘ) পুনর্বাসন ব্যয়: ১,১১৬.৭৬ কোটি টাকা (১,৫১৫ কোটি টাকার বিপরীতে)
ঙ) ভূমি অধিগ্রহণ: ২৬৯৮.৭৩ কোটি টাকা
চ) পরিবেশ: ২৬.৭২ কোটি (১২৯.০৩ কোটি টাকা)
ছ) অন্যান্য বেতন ভাতা, পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা ইত্যাদি: ১৩৪৮.৭৮ কোটি (২৪০৯.৫৬ কোটি টাকার বিপরীতে)
প্রকল্পের মোট অনুমোদিত ব্যয়: ২৭,৭৩২.০৮ কোটি টাকা (৩০১৯৩.৩৯ কোটি টাকার বিপরীতে)
সেতু উদ্বোধন: ২৫ জুন ২০২২।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু: পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের ঢাকার সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবিচ্ছন্ন সড়ক যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে সাথে পদ্মা সেতুর সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। দেশের অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু যেসব ভূমিকা পালন করে তা নিম্নে তুলে ধরা হলো:
১. দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ২ থেকে ৪ ঘণ্টা কমে যাবে।
২. রাজধানীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, কাঁচামাল সরবরাহ এবং শিল্পায়ন সহজতর করতে সহায়তা করবে।
৩. ২১টি জেলায় গড়ে উঠবে ছোট-বড় শিল্প। কৃষির ব্যাপক উন্নতি হবে। কৃষকরা পণ্যের দাম ভালো পাবেন এবং ফলে উৎপাদন বাড়বে।
৪. দক্ষিণের জেলা সমূহের বার্ষিক জিডিপি ২.০ শতাংশ এবং দেশের সামগ্রিক জিডিপি ১.০ শতাংশের বেশি বাড়াতে সাহায্য করবে।
৫. সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের সমন্বিত যোগাযোগ কাঠামোর উন্নতি হবে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে (N-8) এবং ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সাথে সংযুক্ত হবে।
৬. ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ থাকবে। সেতুর দুই পাশে গড়ে তোলা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও বেসরকারি শিল্প শহর। ফলস্বরুপ, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
৭. মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর নতুন উদ্দমে চালু থাকবে।
৮. পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, ষাট গম্বুজ মসজিদ, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার, মাওয়া ও জাজিরায় পুরনো-নতুন রিসোর্টসহ নতুন-পুরনো পর্যটনকেন্দ্র দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে।
৯. যানবাহনের সংখ্যা প্রতি বছর ৭-৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৬৭ হাজার যানবাহন চলাচল করবে।
উপসংহার: বাংলাদেশের অসামান্য অর্জন গুলোর মধ্যে একটি বড় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ। সহজ ও স্বল্প সময়ে আরামদায়ক যাতায়াতে পদ্মা সেতু যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনি পরিবর্তন আসবে পণ্য পরিবহনেও। ফলে জাতীয় উন্নয়নে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে উন্নয়নের পথে বাংলাদেশ আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
Leave a Reply