বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক অঞ্চল হল শেরপুর জেলা। ১৯৮৪ সালে শেরপুরকে জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর আগে এটি জামালপুর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। শেরপুর পূর্ব থেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি লীলাভূমি। এখানে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্থান। তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈচিত্র্যময় পর্যটন গন্তব্যসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো।
রাজার পাহাড়
শেরপুর জেলা সদরের কর্ণঝোড়া বাজার এর পাশে রাজার পাহাড় অবস্থিত। এটি শেরপুর জিরো পয়েন্ট থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গারো পাহাড়গুলোর মধ্যে যে কয়টি পাহাড় রয়েছে তারমধ্যে রাজার পাহাড় সবচাইতে বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট। এই পাহাড় সবুজ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, যা সৌন্দর্য সিলেট বা চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকেও হার মানায়। সারা বছরজুড়ে এখানে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভিড় লেগে থাকে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের কাছেও এই পাহাড়টি একটি জনপ্রিয় বিনোদন কেন্দ্র।
প্রাচীন কাহিনী অনুসারে, এটি একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এখানকার রাজা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই রাজাকে সম্মান জানাতেই এই পাহাড়ের নামকরণ হয় রাজার পাহাড়। স্থানীয়দের জনশ্রুতি অনুযায়ী, পাগলা দারোগা নামে এক ব্যক্তি এই পাহাড়ের চুড়াতে অবস্থান নেন এবং তার সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও এই পাহাড়ে থাকতো। সেই ব্যক্তি পাহাড়ের এক কোনায় বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান তৈরীর জন্য চারা রোপণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত সেটি এক পূর্ণাঙ্গ বাগান হয়ে ওঠে। তিনি মারা গেছেন কিন্তু তার মেয়েরা এখনো সেই অঞ্চলে বসবাসরত। সেই ব্যক্তির প্রকৃত উদ্যোগে রাজার পাহাড়ের এক কোনায় বিভিন্ন ধরনের ফলের বাগান রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আম, লিচু, কাঁঠাল, ও কলা।
প্রকৃতরুপে এই পাহাড়ের রাজা সুলভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আশেপাশের পাহাড়গুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, অন্যান্য গারো পাহাড়ের চেয়ে এই পাহাড়টি আকৃতিতে অনেক বড় এবং তাদের মাঝে সবদিক থেকেই উৎকৃষ্ট। এই পাহাড়ের চূড়ায় ১০০ হেক্টর জায়গা সবুজ সমতলভূমিতে ঘেরা। পাহাড়ের উপরের সমতলভূমি যে কারো মনের প্রাকৃতিক নির্মলতা দিতে সক্ষম। পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঢেওফা নদী। এই নদীর কূল ঘেঁষে রয়েছে বিস্তীর্ণ বালুচর।
এই নদীটি প্রাকৃতিকভাবে খরস্রোতা এবং বছরের সব সময় এতে পানি থাকে। এর বিশাল বালুচর দেখলে মনে হয়, এটি যেন এক কৃত্রিম সমুদ্র সৈকত। পাহাড়ের আশেপাশে রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিস্তীর্ণ জনপদ। এই এলাকায় হাজং এবং কোচ নামক আদিবাসীরা বসবাস করেন। আদিবাসীদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে লাইব্রেরী, জাদুঘর, কালচারাল একাডেমী, মিলনায়তন ও গবেষণা বিভাগ। তাদের আর্কাইভ থেকে আদিবাসীদের সংস্কার এবং ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তীর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়।
মধুটিলা ইকোপার্ক
শেরপুর জিরো পয়েন্ট থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরবর্তী নালিতাবাড়ী নামক থানায় প্রায় ১০০ হেক্টর পাহাড়ি বন ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে মধুটিলা ইকোপার্কটি গঠিত। সমগ্র অঞ্চলটি বাংলাদেশ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ। এই ইকোপার্কটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত এবং নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য প্রিয় মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল। এখানে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয় বরং আরও রয়েছে কৃত্রিমভাবে তৈরি ভাস্কর্য। যার মধ্যে রয়েছে দুটি বাঘ, দুটি হাতি, ঈগল, পেঁচা, জলকন্যা বা মারমেড, কুমির, সিংহ, ব্যাঙ, ইত্যাদি।
ইকো পার্কের মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে অতি ঘন জঙ্গল থাকার কারণে, এখানকার জীব বৈচিত্রের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছিল। এজন্য মধ্যবর্তী এলাকায় ঘন জঙ্গল কেটে ইকোপার্ক গঠন করা হয়েছে। এখানকার স্থাপত্য ও অবকাঠামো গুলোর মধ্যে রয়েছে বসার জায়গা, পাবলিক টয়লেট এবং একটি ওয়াচ টাওয়ার। আগত পর্যটকরা যাতে পানিতে চলাচল করতে পারে এবং জলপথের সাহায্যে বিভিন্ন জায়গাতে যেতে পারে, এজন্য রয়েছে পাঁচটি দেশি নৌকাম তিনটি প্যাডেল বোট এবং একটি ব্রিজ।
অর্কিড পর্যটন কেন্দ্র
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে শেরপুর জেলা শহরে এই প্রাকৃতিক অর্কিড পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকল্পটি চালু হয়েছে ১৯৮৫ সালে। এই প্রকল্পের অধীনে রয়েছে মাঠভর্তি সবুজ ঘাস, দেশী- বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এবং বাঁধানো পুকুর। পুকুরের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির বক, যারা পুকুরের পানিতে মাছ খেতে আসে। অর্কিড পর্যটন কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে মিনি চিড়িয়াখানা রয়েছে। এই চিড়িয়াখানার খাঁচায় রয়েছে টার্কি, বানর, খরগোশ এবং অন্যান্য জীবজন্তু। এখানে বসার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটি যেন শহরের মধ্যে একটি গ্রাম্য পরিবেশ।
যার সৌন্দর্য শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অলংকৃত। পর্যটকদের খাবার ব্যবস্থার জন্য রয়েছে ছোট একটি ক্যান্টিন। কেউ যদি শহুরে ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এখানে সময় কাটাতে চান, সে ক্ষেত্রে এখানে রেস্ট হাউজ রয়েছে। এই পর্যটন কেন্দ্রটি সকাল দশটা থেকে বিকাল ছয়টা পর্যন্ত প্রতিদিন খোলা থাকে। সন্ধ্যার পর এখানকার সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকে এবং বহিরাগত কারো প্রবেশের অনুমতি থাকে না।
মায়াবী লেক
পুরো শেরপুর জেলা হচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবাসভূমি। এখানে অনেকগুলো বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র থাকলেও, বর্তমান সময়ে মায়াবী লেক বাংলাদেশের মানচিত্র একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। পূর্বে এই স্থানটির নাম ছিল বোগাগোছা, যা শেরপুর জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরবর্তী তাওয়াকুচা নামক গ্রামে অবস্থিত। স্থানটির প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মনে হবে যেন আপনি কাশ্মীরের চলে এসেছেন। এখানে রয়েছে সবুজে ঘেরা বিভিন্ন ধরনের উঁচু-নিচু পাহাড় আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। কিছুদিন আগেও মায়াবী লেক স্থানটি খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না।
কিন্তু গত বছর কয়েকজন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন এবং স্থানটির আলোকচিত্র ইন্টারনেট মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। তাদের ছবি দেখে মানুষজন অত্যন্ত আকৃষ্ট হয় এবং অনেকেই এখানে যাত্রা শুরু করেন। যাত্রাপথে মায়াবী লেকের পূর্বে রয়েছে ছোট ছোট টিলা, বন, ধানক্ষেত, ইত্যাদি। নিকট অতীতে এখানকার জনসমাগম এত বেড়ে যায় যে, এখানকার জীব বৈচিত্র রক্ষা করা হুমকির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সেজন্য জীববৈচিত্র্য রক্ষার খাতিরে এবং হাতিদের জন্য অভয় অরণ্য তৈরীর লক্ষ্যে এই লেকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপরেও লেকের আশপাশের অঞ্চলে জনসমাগম এবং পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। যদিও এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কোন খাবার দোকান নেই কিন্তু স্থানীয়রা দুপুরের খাবার, পানীয়, এবং অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিক্রয় করেন।
গাজনী অবকাশ কেন্দ্র
শেরপুর এর ঝিনাইগাতী থানায় গারো পাহাড়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে এই অবকাশ কেন্দ্রটি অবস্থিত। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই স্থানটি এর সৌন্দর্যের জন্য ও পিকনিক স্পট হিসেবে অনেকের পছন্দের গন্তব্য স্থল ছিল। এখানকার প্রবেশদ্বারের সামনেই রয়েছে একটি জলকন্যা বা মারমেইড। তাছাড়াও রয়েছে ড্রাগন টানেল, জিরাফের প্রতিকৃতি, ডাইনোসরের প্রতিকৃতি, লেকভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, কৃত্রিম জলপ্রপাত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক এবং কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিফলক।
এখানে কেউ মাশরুমের ছাতার নিচে বসে সামনের দিগন্তে ধানক্ষেত, পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন জীবনযাত্রা, এবং পাহাড়ের ঢালে আদিবাসীদের জীবন স্বচক্ষে দেখতে পারেন। এখানকার প্রবেশ মূল্য মাত্র ১০ টাকা। এখানে আরেকটি ছোট চিড়িয়াখানাও রয়েছে যাতে রয়েছে ৪০ প্রজাতির প্রাণী। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভাল্লুক, হরিণ, সাপ, অজগর, বাঘ, মাছ, ইত্যাদি। এখানে নির্ঝর নামে একটি ক্রিসেন্ট লেক রয়েছে। তাছাড়াও লেক পার হয়ে পশ্চিম দিকে গেলে পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখা যায় এবং পাহাড়ের সাথে সংযোগকারী একটি সেতু রয়েছে যার নাম রেইনবো।
যাত্রা ও আবাসন
ঢাকা থেকে শেরপুর পর্যন্ত যোগাযোগ খুবই সুবিধার। ঢাকা থেকে সরাসরি শেরপুর পর্যন্ত বাস সার্ভিস রয়েছে। শেরপুর এর অভ্যন্তরে যাতায়াত করতে হলে আপনাকে অটোরিকশা বা সিএনজি ভাড়া করতে হবে। তাছাড়াও আপনি ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে শেরপুর আসতে পারেন। শেরপুরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি মানসম্মত হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো হোটেল সম্পদ প্লাজা, স্পেকট্রাম গেস্ট হাউস, আরাফাত গেস্টহাউস, ইত্যাদি।
Leave a Reply