বরগুনা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বরগুনা জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হচ্ছে বরগুনা। এটি হচ্ছে বরিশালের  দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী একটি জেলা। ১৯৬৯ সালে বরগুনাকে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে রাজনৈতিক শাসনামল চলাকালীন সময়ে ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বরগুনাকে জেলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পূর্বে সুন্দরবন বরগুনা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল, কিন্তু সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে এলাকার মানুষজন এবং ভারতীয় উপকূলবর্তী লোকজন এখান থেকে গাছ সংগ্রহ করে নিয়ে যেত।

কালক্রমে এখানকার বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষজন বসতি গড়ে তোলে। বরগুনা নামটি বারো- গণ নামক স্থানীয় শব্দ থেকে এসেছে। “বারো” অর্থ হচ্ছে “চলে যাওয়া” এবং “গণ” অর্থ হচ্ছে জোয়ার। পূর্বে কাঠ ব্যবসায়ীরা এখানকার জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন, যাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে কাঠ কাটতে পারে। এজন্য স্থানটি “বারো গণ” নামে পরিচিত ছিল, সেখান থেকে বরগুনা নামের উদ্ভব।

আবার অনেকের মতে এক বাউল সাধু এখানে বসবাস করতেন যার নাম ছিল বরগুনা, যা থেকে এই জেলার নামের উৎপত্তি। এটি সমুদ্র উপকূলবর্তী অনেক সুন্দর একটি এলাকা এবং আপনি যদি বরগুনা ভ্রমণ করতে চান সে ক্ষেত্রে এই পোষ্টের তথ্যগুলি আপনার ভ্রমণ চেকলিস্ট আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে বলে আশা করি।

ফাতরার চর

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে ইঞ্জিন বোটে মাত্র এক ঘন্টার পথ হচ্ছে ফাতরার চর। এটি ভ্রমণপিপাসু এবং বন প্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। ফাতরার চর সুন্দরবনের একটি অংশ এবং স্বভাবগতভাবেই এটি একটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এখানকার জীববৈচিত্র কিছুটা সরল প্রকৃতির। এখানকার বনে পাওয়া যায় অসংখ্য বন্য পাখি, অতিথি পাখি, খরগোশ, বানর, হরিণ, এবং অন্যান্য স্থানীয় প্রাণী। উদ্ভিদ জগতের মধ্যে বহুবর্ষজীবী বন্য গাছ এই চরের বৃহদাংশ দখল করে রয়েছে। এখানে সবচাইতে বেশি পাওয়া যায় শাল, সেগুন, ও কেওরা।

সারা বাংলাদেশে এইসব কাঠ সরবরাহ করা হয় এবং এখানকার কাঠের ব্যবসা ক্রমে বিস্তার লাভ করেছে। এই কাঠগুলো টিম্বার বা তক্তা এবং গৃহ নির্মাণের কাজে আসে বলে এখানকার কাঠের বিস্তৃত সুনাম রয়েছে। এখানে যেতে হলে আপনাকে ফরেস্ট ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে, কারণ অনেকে অবৈধভাবে এখানে গাছ কাটতে আসে। এখানকার বনাঞ্চল অতি মনোরম প্রাকৃতিক আবহ তৈরি করে, যারা আনন্দ গ্রহণ করতে সারা দেশ থেকে মানুষজন এখানে ছুটে আসেন ।

ফাতরার চরের সবচাইতে আকর্ষণীয় কার্যক্রম হচ্ছে নৌকা ভ্রমনের সাথে সাথে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করা ও প্রাণীবৈচিত্র্য বাস্তুসংস্থান পর্যবেক্ষণ করা। এটি একটি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বলে আপনি সুন্দরবনের সমতুল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। আপনি ইচ্ছা করলে নৌকার চালককে বলে বনাঞ্চলের গভীর অংশগুলোতে যাত্রা করতে পারেন এবং ঘন প্রাকৃতিক বনাঞ্চল দেখার আনন্দ উপলব্ধি করতে পারেন।

বঙ্গবন্ধু নৌকা জাদুঘর

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভাবে একটি নদীমাতৃক দেশ, যার অভ্যন্তরে ৭০০ টি নদী চলাচল করে এবং  নৌকা হচ্ছে বাংলাদেশের জলপথের প্রধান বাহন। এসব নৌকা বিভিন্ন আকৃতিতে এবং বৈশিষ্ট্যে নির্মিত হয়। ২০২০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ৩১ ডিসেম্বর বরগুনার জেলা সদরে এই নৌকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় দেশি এবং বিদেশি বৈচিত্র্যময় ১০০ টি নৌকার অনুকৃতি সংকলন এর মাধ্যমে এই জাদুঘর তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এই জাদুঘরটি দেশীয় নৌকার আদলে তৈরি করা হয়েছে।

জাদুঘরটি ১৬৫ ফুট লম্বা এবং ৩০ ফুট চওড়া। যদিও জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার সময় লক্ষ্য ছিল একশটি নৌকার অনুকৃতি গ্যালারিতে স্থাপন করা। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস এর প্রকোপ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারনে এখন পর্যন্ত ৭৫ টি নৌকার সংকলন করা সম্ভব হয়েছে। জাদুঘরে শুধুমাত্র নৌকাই নয় বরং আরো রয়েছে আধুনিক পাঠাগার, নৌকা গবেষণা কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার, ফুড কোর্ট, শিশু বিনোদন কেন্দ্র’, এবং আরো অন্যান্য আয়োজন।

বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও খুব অল্প সময়ে (৮১ দিন) জাদুঘরটি নির্মাণের কাজ শেষ করা হয়েছে। এই স্থানটি সমগ্র পরিবার নিয়ে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। এই জাদুঘরে  শিশু- কিশোরদের জন্য অনেক শিক্ষনীয় বিষয়বস্তু রয়েছে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে  বৈচিত্রের ও জ্ঞান আহরনের মাধ্যম।

শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত

বরগুনা জেলার অন্তর্গত তালতলী থানার নলবুনিয়া নামক গ্রামে শুভ সন্ধ্যা সমুদ্র সৈকতটি অবস্থিত। এই সমুদ্র সৈকতের নাম করা হয়েছে থানা নির্বাহী অফিসার বদরুদ্দোজা শুভ এর নাম অনুসারে।  তিনি অত্র এলাকায় বদলি হয়ে আসার পর, এই সমুদ্র সৈকত অলঙ্করণে ও সংস্কারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন। নলবুনিয়া গ্রামটি তালতলী থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের একটি অংশ।

এই সমুদ্র সৈকতটি গঠনগতভাবে ও প্রাকৃতিক দিক থেকে অন্যান্য বর্গীয় সৈকতগুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানকার এক পাশে রয়েছে বিস্তীর্ণ ঝাউবন আর অন্য পাশে রয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত সামুদ্রিক জলরাশি। ঝাউবনের মধ্যে ঢুকলে মনে হবে আপনি যেন নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করছেন। সমুদ্রের উপকূলের বালিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অগণিত লাল কাঁকড়া। এখানকার পর্যটকরা তাদের বাধভাঙ্গা আনন্দের কথা প্রকাশ করেন। আর সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ে তখন সমুদ্রের পানিতে সূর্যকিরণের বিকিরণ একটি কল্পনাতীত দৃশ্য তৈরি করে। সারা দেশ থেকে অসংখ্য প্রকৃতিপ্রেমী এখানে বেড়াতে আসেন, যা স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনীতিতে সাহায্য করে। এটি এখনো সরকারি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত নয়; এজন্য নিরাপত্তার খাতিরে এখানে রাতের বেলা ভ্রমণ বা বিচরণ না করার পরামর্শ দেওয়া হল।

বিবি চিনি মসজিদ

বরগুনার বেতাগী উপজেলায় বিবিচিনি মসজিদকে কেন্দ্র করে বিবিচিনি গ্রাম গড়ে উঠেছে। এই মসজিদটি বরগুনা জেলার একটি স্ট্যান্ড পয়েন্ট। এই মসজিদটি তৈরি হয়েছে মুঘল স্থাপত্যশৈলী অনুসারে। বরগুনার অন্যতম বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক নেয়ামত উল্লাহ, এই মসজিদের নির্মাতা। এই মসজিদটি ৩৩ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩৩ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার মসজিদ যা ৩০০ বছরেরও বেশি পুরাতন। পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে এই মসজিদটি প্রথমবারের মতো সংস্কার করা হয়। পরে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এই মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের দায়িত্ব নেয় এবং এটিকে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য হিসেবে নথিভুক্ত করে।

আন্ধারমানিক নদী

আন্ধারমানিক নদীটির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ভারতের গঙ্গা নদী। গঙ্গা থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে পদ্মা নদীতে আসে। পদ্মা নদীর বৃহত্তম উপকূলবর্তী নদী সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আন্ধারমানিক নদী। পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া দিয়ে এই নদীটি বরগুনাতে প্রবেশ করেছে। এটি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ যার মধ্যে ১৬ কিলোমিটার নদীগর্ভ পলিমাটি দ্বারা বিস্তৃত। কালের বিবর্তনের সাথে সাথে এই নদীতে প্রচুর পলিমাটি জমা হয়েছে এবং হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পলিমাটি পড়ার কারণে নদীতে অনেক জায়গাতে শুকিয়ে যাচ্ছে।

শুধু তাই নয়, ইদানিং লবণাক্ততা এত বেশি হয়ে গেছে যে কৃষকরা এর পানি কৃষি কাজে ব্যবহার করতে পারছেন না। এজন্য নদীর কূলবর্তী এলাকাগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। আন্ধারমানিক নদীর কূলগুলোতে বেশ কয়েকটি বাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে সবচাইতে সুন্দর বাঁধ হচ্ছে কচু পত্র বাঁধ। আপনি চাইলে কচু পত্র বাঁধ, আন্ধারমানিক নদী ও তার উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ একসাথে দেখে আসতে পারেন বিশেষজ্ঞরা এই নদীকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী হিসেবে দেখেন।

যাত্রা ও আবাসন

ঢাকা থেকে বরগুনা প্রায় ৩২০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এবং সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে, যা যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। তাছাড়াও আপনি রেলপথে বা বিমান পথে বরগুনা পৌছাতে পারেন। আর  বরগুনাতে থাকার জন্য দুটি উন্নত মানের হোটেল বর্তমান। সেগুলো হলো গ্র্যান্ড খান গেস্ট হাউস এবং হোটেল গ্রীন ভিউ ইন্টারন্যাশনাল।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*