বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের একটি ছোট জেলা হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এটি বাংলাদেশের সর্ব পশ্চিমের জেলা। অনেকে এই জেলাকে আমের দেশও বলে থাকে। সংক্ষেপে এই জেলাকে অনেকে চাঁপাই নামে ডাকে। ব্রিটিশ শাসনামলে জেলাটি ভারতের মালদহ জেলার অন্তর্গত ছিল। ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পূর্ব- পাকিস্তানের একটি অংশ হিসেবে সংযুক্ত হয়, যা রাজশাহী মহাকুমার অন্তর্গত ছিল। ১৯৮৪ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রথমবারের মত জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের দর্শনীয় স্থানসমূহ নিয়ে এই পোস্টে আলোচনা করা হলো।
বাবু ডাইং পিকনিক স্পট
বাবুডাইং একটি চমৎকার পিকনিক স্পট এবং বনভোজনের যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য স্থানীয়দের প্রথম পছন্দ। এটি এক ধরণের পাহাড়ি ভূমি, যেখানে পুরো এলাকা জুড়ে গভীর সবুজের সমারোহ রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জিরো পয়েন্ট থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ঝিলিম ইউনিয়নে অবস্থিত এই স্থানটি। এই স্থানটি বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি উদাহরণ। গোদাগাড়ী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি স্বতন্ত্র এলাকা জুড়ে ৩০০ একর জমিজুড়ে বরেন্দ্র অঞ্চল ছড়িয়ে রয়েছে। আপনি যদি হাইকিং এবং অ্যাডভেঞ্চারের অনুরাগী হন তবে এটি আপনার জন্য একটি দুর্দান্ত ভ্রমণের জায়গা হতে পারে।
এখানকার পাহাড়ি ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে হাঁটা এবং প্রকৃতির সবুজ আবরণ দেখা আপনার হৃদয়কে মুগ্ধ করতে পারে। আপনি যদি বনের মধ্য দিয়ে যান, আপনি পাখিদের উড়ে যাওয়ার একটি দৃশ্য দেখতে পাবেন এবং তাদের মিষ্টি কিচিরমিচির শুনতে পাবেন। এখানে কয়েকটি জলপ্রপাত এবং মানুষের তৈরি লেক রয়েছে। যারা সাঁতার কাটতে চান, তাদের সুবিধার্থে ওই লেকগুলোতে সিমেন্টের ঘাট রয়েছে। এসবের পাশাপাশি প্রায় আড়াই কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ক্রস ড্যাম এখানে স্থাপন করা হয়েছে। এখানকার পুরো এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গাছপালা পাওয়া যায়।
আপনি স্থানীয় সাঁওতাল উপজাতি থেকে তাদের জীবনধারা দেখতে পারেন। তাদের জীবনযাপন খুবই সাধারণ, যা মানুষকে দর্শনের জন্য একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। আমরা যদি তাদের জীবনের মানগুলি দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারি তবে এটি আমাদের মনকে শান্তির আস্বাদন দিতে পারে বা সাধারণ জীবনধারা অনুসরণ করতে চালিত করতে পারে। বরেন্দ্র মাল্টিপারপাস ডেভেলপমেন্ট (বিএমডিএ) নামের উন্নয়ন গোষ্ঠী প্রায় ২৫ বছর আগে এই স্থানে ৫টি পুকুর খনন করে ও দেড় লাখ চারাগাছ রোপণ করেছে যা কালের পরিক্রমায় বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তবে আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনাকে একটি পরামর্শ হচ্ছে যে, আপনি যদি জঙ্গলের গভীরে যান, আপনার দলটিকে আপনার সাথে নিয়ে যান বা সাবধানে যান। কারণ আপনি কিছু খারাপ স্থানীয়দের দ্বারা লুণ্ঠনের শিকার হতে পারেন।
শাহ নেয়ামতুল্লাহ মাজার
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হচ্ছে শাহ নেয়ামতুল্লাহ মাজার। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত তোহাখানা নামক স্থানে এই মাজারটি অবস্থিত। উক্ত মাজারটি সোনামসজিদ থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। শিলালিপি এবং নথিপত্র থেকে জানা গেছে যে, এটি একটি মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন। ষোড়শ শতাব্দীর অন্যতম বিখ্যাত সাধক ছিলেন হযরত শাহ সৈয়দ নেয়ামতুল্লাহ রহঃ। তার বংশ পরিচয় হতে জানা যায় যে, তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সঃ- এর একজন সরাসরি বংশধর ছিলেন এবং একই সাথে ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক গুরু ও পন্ডিত।
মুঘল আমলে বঙ্গ এলাকার সম্রাট ছিলেন সুলতান শাহ সুজা। শাহ সৈয়দ নেয়ামতুল্লাহ সেই সময় দিল্লির করোনিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচার করেন এবং ফিরোজপুর নামক স্থানে সম্রাটের রাজপ্রাসাদে পৌঁছান। বঙ্গ সম্রাট সুলতান শাহ সুজা সর্বোচ্চ সম্মানের সাথে তাকে গ্রহণ করেন এবং তার কাছে থেকে দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি গৌড়ের উপকণ্ঠে অস্থায়ী আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করেন এবং দীর্ঘ ৩৩ বছর সুনামের সহিত ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে সক্ষম হন।
১০৮০ সালে তার মৃত্যুর পর তাকে গৌড় উপকণ্ঠে সমাহিত করা হয়, যা বর্তমানে শিবগঞ্জ থানার অন্তর্গত। তার সমাধিকে ঘিরে একটি গম্বুজ বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সমগ্র ভবনের চারপাশে প্রায় ২৫০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে ইট ও গাছ দিয়ে ঘেরা সমাধিস্থল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভবনটিতে বারোটি খিলান পথ রয়েছে, যার কারণে এই মাজারকে অনেক স্থানীয় লোকজন বারোদুয়ারী নামে চেনে। সমাধিস্থলের চারপাশে বিভিন্ন ফুল লতাপাতার অলংকরণ করা হয়েছে।
তোহাখানা
চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি মুঘল ঐতিহ্য হচ্ছে তোহাখানা। শিবগঞ্জের শাহবাজপুর নামক স্থানে এই প্রাচীন ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক, যা প্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করে। তোহাখানা শব্দটি এসেছে একটি ফারসি শব্দ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে ঠাণ্ডা ভবন বা প্রাসাদ। এই ভবনটির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে যে, মুঘল আমলে এমন একটি ভবন তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল যা সেই আমলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করত; যা এখনকার আধুনিক স্থাপত্য শিল্পীর কাছেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ঐতিহাসিক তথ্যানুসারে, তোহাখানা নির্মিত হয়েছিল ১৬৫৮ সালে যার নির্মাণ করেছিলেন মুঘল শাসনকর্তা সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। এই ভবনের ভিতরে প্রবেশ করলে আপনি দেখতে পাবেন কয়েকটি সমাধিস্থল যা ফলকহীন। তবে ধারণা করা হয় যে, সমাধিস্থলগুলো হচ্ছে শাহ নেয়ামতুল্লাহ’র খাদেম বা ধর্ম প্রচারে সাহায্যকারী। সমগ্র কমপ্লেক্সটিতে রয়েছে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ, একটি গম্বুজবিশিষ্ট সমাধি এবং একটি কূপ।
ছোট সোনা মসজিদ
তোহাখানা’র নিকটেই শিবগঞ্জের শাহবাজপুর ইউনিয়নে এই প্রত্নতাত্ত্বিক মসজিদটি অবস্থিত। এটিকে সুলতানি আমলের স্থাপত্য শিল্পের একটি অনন্য নিদর্শন বা রত্ন সমতুল্য নির্মাণকার্য হিসেবে গণনা করা হয়। ভারতবর্ষের সুলতানি আমলে মনসুর মুহাম্মদ বিন আলী এই ছোট সোনা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদের গম্বুজে সোনা বসানো ছিল বলে জানা যায়। আরো জানা যায় যে, মসজিদের অভ্যন্তরে মূল প্রার্থনা কক্ষে দুইটি বড় সোনার ফলক ছিল যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা দখল করে নিয়ে গেছে।
মসজিদের সামনে রয়েছে ফাঁকা উদ্যান এবং শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের সমাধিস্থল। বর্তমান সময়ে মসজিদটিতে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কাজ চালানো হয়েছে। সোনামসজিদে একটি বড় গ্রানাইটের টাইল বসানো রয়েছে। এই মসজিদের মোট গম্বুজ সংখ্যা হচ্ছে ১২ টি এবং প্রত্যেকটি ইট দিয়ে তৈরি। সমগ্র মসজিদে মোট আটটি দরজা রয়েছে।
তার মধ্যে পাঁচটি দরজা দক্ষিনে এবং তিনটি উত্তরে অবস্থিত। মসজিদের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে একটি অতিথিশালা যা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব কর্তৃপক্ষ আধুনিকতার সহিত সম্পন্ন করেছে। মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে একটি বিশাল দিঘী এবং দিঘীর উপকূলে স্থানীয় কুটির শিল্পের কিছু দোকান রয়েছে। বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর এই পুরাতাত্ত্বিক মসজিদের সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে।
সাফিনা পার্ক
চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোদাগাড়ী নামক উপজেলার খেজুরতলা গ্রামে মোট ৪০ বিঘা জমির উপর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক এই বিনোদন পার্ক। এই পার্কে সকল বয়সের ব্যক্তিদের ও শিশুদের জন্য রয়েছে আনন্দ ও বিনোদনের উপকরণ। রাইড ব্যতীতও এই পার্কের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও মূল আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এখানে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রজাতির ফল, ফুল ও ঔষধি গাছ। বিশেষ করে শিশুদের বিনোদনের লক্ষ্যে নির্মিত এই পার্কে রয়েছে দোলনা, ট্রেন, নাগরদোলা, থ্রিডি সিনেমা এবং ছোট বাচ্চাদের স্পোর্টস জোন।
কানসাট আমের বাজার
বাংলাদেশের আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত শহর হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এখানকার সবচাইতে বড় আমের বাজার বসে কানসাটে, যা বাংলাদেশের সবচাইতে বড় আমের বাজার। প্রতিবছর আমের মৌসুমে এখানে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যমানের আমের লেনদেন হয়। ভোর থেকে চালু হওয়া এই বাজার বিশ্রাম নেয় শুধুমাত্র গভীর রাতে। এখানে গেলে আপনার মনে হবে আপনি একটি বিশাল আমের রাজ্যে প্রবেশ করেছেন। এখানে আপনি একই সাথে পেয়ে যাবেন হরেক জাতের তাজা আম। আপনি এই বাজারকে আমের জাদুঘর বলতে পারেন। আপনি যদি আমের মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ভ্রমণ করেন তাহলে এখানে আসতে ভুলবেন না।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে আপনি সরাসরি বাসে বা ট্রেনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসতে পারবেন। আর আপনি যদি বিমানে আসতে চান, সেক্ষেত্রে আপনি নিকটবর্তী রাজশাহী জেলায় অবতরণ করতে পারেন এবং সেখান থেকে বাস বা ট্রেন বা গাড়িতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌঁছে যেতে পারেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি ছোট শহর হলেও এতে বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, স্কাই ভিউ ইন, হোটেল আল নাহিদ, পর্যটন কর্পোরেশন হোটেল, হোটেল স্বপ্নপুরী, সরকারি ডাকবাংলো, হোটেল রংধনু, ইত্যাদি।
Leave a Reply