
দিনাজপুর বাংলাদেশের উত্তরে রংপুর বিভাগের অধীনস্থ একটি জেলা। দিনাজপুরের দর্শনীয় এবং প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানসমূহ সম্পর্কে এই পোস্টে তুলে ধরা হলো।
দিনাজপুরের রাজবাড়ী
দিনাজপুরের রাজবাড়ী একটি প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাসাদ যা ১৮০০ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের একটি ল্যান্ডমার্ক হিসেবে বিবেচিত হতো। রাজবাড়ীতে আয়নামহল নামে একটি সুসজ্জিত কাচের দরবার রয়েছে, যা দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী সেখানে ভিড় করেন। আয়নামহলে রয়েছে মার্বেল এবং কাঁচের কারুকাজ দিয়ে সজ্জিত। এখানে একটি গ্রন্থাগার, একটি দরবার ঘর এবং একটি গুপ্তধন ঘর বা তোষখানা রয়েছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে রানীমহল, যেটি পরবর্তীতে সম্বলহীন পরিবারের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তর দ্বারা পরিচালিত আরেকটি ভবন নির্মাণের জন্য, ত্রিশের দশকে এর পুরনো কাঠামোটিকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল । এছাড়াও জলসাঘর নামে পরিচিত একটি প্রদর্শনী সমাবেশ ছিল। ১৯৫১ সালে আয়না মহলের জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে এই প্রাসাদটিও পরিত্যক্ত হয়। দেশবিভাগের পর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজানাথ দেশ পরিত্যাগ করেন এবং ভারতে সপরিবারে চলে আসেন।
প্রাসাদটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন নিদর্শন। যদিও রাজবাড়ির উৎপত্তি খুব একটা স্পষ্ট নয়, তবুও স্থানীয় ঐতিহাসিকদের মতে রাজা দিনাজ এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে দলিলে পাওয়া গেছে যে রাজা শ্রী মত্ত দত্ত এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং আয়না মহলটি তৈরি হয়েছিল রাজা প্রমথ নাথ ও রাজা রামনাথের শাসনামলে। আবার এটিও বিশ্বাস করা হয় যে উক্ত রাজবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা গণেশ, যিনি ১৫ শতকের প্রথম দিকে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন জমিদার ও রাজাদের দ্বারাও রাজবাড়ির কাঠামোর কিছু অংশ নির্মিত হয়েছে বলে হয় লোকমুখে শোনা যায়।
১৯৫০ সালে পূর্ব বঙ্গ রাজ্য অধিগ্রহণ ও প্রজাতন্ত্র আইন এর মাধ্যমে রাজবাড়ীর মালিকানাসত্ত্ব সম্পূর্ণরুপে সরকারের কাছে হস্তান্তরিত হয়। রাজবাড়ীটি ১৬.৪১ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এর অনেক কাঠামো বর্তমানের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ।পূর্ব পাকিস্তান আমলে রাজবাড়ীর বিভিন্ন ব্রোঞ্জের পাত্র, আসবাবপত্র, রুপার অস্ত্র এবং ও অন্যান্য জিনিসপত্র আইয়ুব খানের আমলে বিক্রি করা হতো বলে দলিল রয়েছে ।
স্বপ্নপুরী
শুধু দিনাজপুর নয়, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বিনোদন উদ্যান হিসেবে পরিচিত হচ্ছে স্বপ্নপুরী বিনোদন উদ্যান। স্বপ্নপুরী রংপুর বিভাগের দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার আফতাবগঞ্জে অবস্থিত। এটি উপজেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন কুশদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোঃ দেলোয়ার হোসেন শ্রম ও অর্থের বিনিময়ে স্বপ্নপুরী নির্মাণের কাজ শুরু করেন।
স্বপ্নপুরী বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান পিকনিক স্পট প্রতিবছর এখানে লক্ষাধিক দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। এই পার্কে রয়েছে বিভিন্ন রাইড, রেস্ট হাউস, ‘রংধনু আর্ট গ্যালারি, ‘মহামায়া ইন্দ্রজাল’ নামক জাদুর গ্যালারি, কৃত্রিম চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট, বাগান, হ্রদ এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।
রামসাগর জাতীয় উদ্যান
দিনাজপুরের আরেকটি বিখ্যাত জায়গা হল রামসাগর জাতীয় উদ্যান। বাংলাদেশের একটি জাতীয় উদ্যান এটি। ২৭.৭৬ হেক্টর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই এই উদ্যানটি একটি বড় জলাধারার কাছে নির্মিত যা রামসাগর ট্যাংক নামে পরিচিত। তার চারপাশে নির্মিত এই হ্রদটির দৈর্ঘ্য ১০৮০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯২ মিটার। এটির মাটি এঁটেল এবং রং হচ্ছে লাল হলুদ । রাজা রামনাথ ১৮০০ শতকে তৎকালীন সময়ের প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে এবং কয়েক লক্ষ শ্রমিক নিয়োজিত করে এটি নির্মাণ করেছিলেন। দিনাজপুরের এই রাজা পলাশীর যুদ্ধের আগে এই হ্রদটি খনন করেছিলেন বলে ধারণা করা হয় ।
এই সুন্দর পার্কটি প্রথম ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বিনোদন ও শিক্ষার জন্য ক্লাস বি জাতীয় উদ্যান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এই পার্কটিকে সুপারিশ করেছিলেন । ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংশোধনী আইনের অধীনে এটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
বিশাল হ্রদ ও বাঁধ দ্বারা ঘেরা এই পার্কটিতে বড় কোনো গাছ নেই এবং এখানকার অধিকাংশ প্রাণী ও উদ্ভিদ জলাভূমির বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। ১৩২ টি পরিবারের অন্তর্গত ২৭২ টি উদ্ভিদ প্রজাতি এর অভয়ারণ্যে রেকর্ড করা হয়েছে। এখানকার জলাশয়টি বিভিন্ন মৎস্যসম্পদ দ্বারা পরিপূর্ণ রয়েছে। এই উদ্যানটিতে যেসব প্রাণী পাওয়া যায় সেগুলো হল কচ্ছপ, মিঠা পানির কুমির, নীল ষাঁড়, বুনো শুয়োর, এশিয়ান ব্ল্যাক বিয়ার এবং স্লথ বিয়ার। জলজ পাখির মধ্যে মূলত রয়েছে সাদা জলের মুরগি, রিভার টার্ন, জাকানাস, রিংড প্লোভার, বেগুনি হেরন, কিংফিশার, এবং গ্রে হেরন।
বাংলাদেশের এই সুন্দর জাতীয় নিদর্শন এর ক্ষতির অন্যতম কারণ হলো স্থানীয় গ্রামবাসীরা খাবার, আসবাবপত্র তৈরি, পশুখাদ্য, ঔষধ ও জ্বালানোর জন্য এর ভেতরের গাছপালা সরিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত আহরণের কারণে হ্রদের অভ্যন্তরে দেশীয় মাছের প্রজাতিও দিন দিন কমে যাচ্ছে। কৃষি দূষণ, পলিরোগ এবং বন্যা এই পার্কের জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয়কে তরান্বিত করছে এবং এটিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
নয়াবাদ মসজিদ
দিনাজপুরের আরেকটি বিখ্যাত পর্যটন নিদর্শন হল নয়াবাদ মসজিদ। এটি দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত। নয়াবাদ গ্রামের নামান্তরে এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়। এটি ঢেপা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এবং জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক মসজিদটি বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে এবং সামনে একটি মাদ্রাসা মসজিদ স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদটি প্রায় ১.১৫ বিঘা জমির উপর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। নয়াবাদ মসজিদটির প্রবেশ দ্বারে এর ইতিহাস সম্পর্কে ফরাসি ভাষায় বর্ণনা লিখিত রয়েছে।
প্রবেশদ্বারের এই লিপি দ্বারা জানা যায় যে, সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম এর সময় বাংলা ১২০০ সনের ২ জ্যৈষ্ঠ (১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ) মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আরো জনশ্রুতি রয়েছে যে, বিখ্যাত কান্তজি মন্দির আঠারো শতকের মধ্যভাগে যখন নির্মিত হয় তখন পশ্চিমা দেশ থেকে আগত মুসলিম স্থাপত্য কর্মীরা পার্শ্ববর্তী গ্রামে মোকাম তৈরি করেন এবং এই মসজিদটিও নির্মাণ করেন। নয়াবাদ মসজিদ টি আয়তাকার এবং তিন গম্বুজবিশিষ্ট।
চারটি অষ্টভুজাকৃতির টাওয়ার এর চার কোনায় রয়েছে। মসজিদের দৈর্ঘ্য বাইরের দিক থেকে ১২.৪৫ মিটার এবং প্রস্থ ৫.৫ মিটার পুরুত্ত্ব ১.১০ মিটার। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি খিলান, যেগুলো মসজিদের পূর্বদিকে অবস্থিত। এই তিন খিলানের মাঝের উচ্চতা ১.৯৫ মিটার প্রস্থ ১.১৫ মিটার। অপর ২ টি খিলান হচ্ছে সমমাপের, যেগুলো আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট। মসজিদের দক্ষিণ ও উত্তর দিকে একটি করে মোট দুটি জানালা রয়েছে।
জানালার খিলান এবং প্রবেশদ্বারগুলো বহু খাজযুক্ত। মসজিদের অর্ধগোলাকৃতি তিনটি গম্বুজের মধ্যে মাঝেরটি আকারে বাকি দুটো গম্বুজের তুলনায় কিছুটা বড়। এছাড়াও মসজিদের ভিতরে রয়েছে তিনটি মেহরাব যেগুলো পশ্চিম দিকে অবস্থিত। মাঝের মেহরাবের উচ্চতা ২.৩ মিটার এবং প্রস্থ ১.৮ মিটার। মসজিদের প্যারাপেট ও কার্নিশ পরস্পর সমান্তরাল। মসজিদের চার কোণের কর্নার টাওয়ারের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম কোণ এবং উত্তর-পূর্ব কোণের টাওয়ারের উপর কুলপি রয়েছে এবং বাকি দুটো উপরে রয়েছে ছোট গম্বুজ। গম্বুজদ্বয় বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
সাদামাটা ইট ও পলেস্টার দিয়ে তৈরি হয়েছে এর কর্নার টাওয়ারগুলো। কর্নার টাওয়ারের গায়ে চারটি ব্যান্ড রয়েছে যেগুলো ক্রমশ সরু এবং উপরে রয়েছে ছোট গম্বুজ । মসজিদের সমস্ত দেয়ালজুড়ে ১০৪ টি আয়তাকার পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। যদিও এই পোড়ামাটির ফলকের অলংকরণ প্রায় অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। ফলকগুলির অলংকরণ মূলত ফুলের নকশা এবং লতা- পাতা। তবে একটিতে জোড়া ময়ূরের প্রতিকৃতি বিদ্যমান। পোড়ামাটির ফলকগুলোর দৈর্ঘ্য ০.৪০ মিটার ও প্রস্থ ০.৩০ মিটার। পোড়ামাটির নকশাগুলো বর্তমানে বহু জায়গায় খুলে পরেছে।
দিনাজপুরে থাকার স্থানগুলো’র মধ্যে রয়েছে হোটেল শীতল, হোটেল মণ্ডল আবাসিক এবং হোটেল হ্যাপি ট্রি। ঢাকা থেকে দিনাজপুর যেতে হলে আপনি সহজেই বাস পেয়ে যাবেন আর ট্রেনের জন্য কিছুদিন আগে বুকিং দিতে হবে। তাছাড়াও আপনি চাইলে প্লেনে সৈয়দপুর যেতে পারবেন এবং সেখান থেকে বাসে দিনাজপুর যেতে পারবেন।
Leave a Reply