
বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিম অংশে অবস্থিত খুলনা বিভাগের একটি বৃহৎ জেলা হচ্ছে কুষ্টিয়া। সমগ্র বাংলাদেশের পৌরসভাগুলোর মধ্যে কুষ্টিয়া হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ১৯৪৭ সালে প্রথম বারের মত এটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কুষ্টিয়া তথা মুজিবনগর হয়ে ওঠে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী। কুষ্টিয়ার নাম আসলে সাথে লালন শাহের মাজারের নাম উঠে আসে। তবে লালন শাহের মাজার ছাড়াও এই শহরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পুরাতাত্ত্বিক এবং পর্যটন কেন্দ্রসমূহ। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে কুষ্টিয়া সারাদেশে পরিচিত। এই পোস্টে কুষ্টিয়ার জনপ্রিয় পর্যটন স্থল সমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
লালন শাহের মাজার
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী নামক উপজেলায় বাংলাদেশের অন্যতম বাউল সাধু লালন শাহের মাজার অবস্থিত। লালন শাহ ছিলেন একজন বাউল সম্রাট এবং একই সাথে ধর্ম ও দেহতত্ত্বের একজন বিশারদ। তার জীবিত অবস্থায় তিনি কুমারখালী উপজেলাতে তার শিষ্যদের ধর্মীয় নীতি এবং আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রদান করতেন। প্রতিবছর শীতকালে তিনি তার আখড়াতে উৎসবের ব্যবস্থা করতেন, যেখানে তার হাজার হাজার শিষ্যরা আলোচনায় যোগ দিতে বিভিন্ন দেশ থেকে পাড়ি জমাতো।
একই সাথে সেখানে আধ্যাত্মিক সঙ্গীত এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হতো। লালন শাহ মারা যাওয়ার পর তাকে কবরস্থ করা হয় এবং তার সমাধিস্থলে স্থাপনা করা হয় একটি মিলনস্থলের যা আখড়া নামে পরিচিত। তার সমাধীস্থলের নিকটে তার অনুগত শিষ্যদের কবরস্থান রয়েছে।
বর্তমানে প্রত্যেক বছর লালন শাহের মাজারে দুইবার করে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের মধ্যে একটি হচ্ছে দোল পূর্ণিমার উৎসবের সমসাময়িক সময়ে এবং আরেকটি হচ্ছে কার্তিক মাসের প্রথম তারিখে। এই উৎসবে দেশ- বিদেশ থেকে হাজারো লালন ভক্ত এখানে উপস্থিত হন এবং আধ্যাত্মিক বাউল গানের আসরে যোগ দেন। তাছাড়াও আরো অন্যান্য আলোচনা সভায় বিভিন্ন সাধকরা লালনের ধর্মতত্ত্ব ও পুথি নিয়ে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা করেন।
মেলাতে আগমনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে লাইটিং, সামিয়ানা, আর্চিং ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করা হয়। মেলা চলাকালীন সময়ে একই সাথে গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়। মূলত এটি স্থানীয় কুটির শিল্পের প্রদর্শনী এবং এই মেলা স্থানীয়দের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে।
ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া নামক গ্রামে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির নির্মাণ কাঠামো বিশেষ চিনামাটি, ইট, পাথর এবং বালি দিয়ে তৈরি হলেও মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। এই মসজিদ সম্পর্কে অনেক লোককথা প্রচলিত রয়েছে। স্থানীয়দের জনশ্রুতি অনুসারে, এই মসজিদটি কোন অলৌকিক শক্তি দ্বারা নির্মিত হয়েছে। ইরাকের রাজা সুফি আদারি অত্র স্থানে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। এটি একটি নিখুঁত পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত এবং কুষ্টিয়ার অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের একটি নিদর্শন।
মসজিদটির শিল্প কাঠামো অনন্য। মসজিদে রয়েছে তিনটি গম্বুজ, নামাজের জন্য তিনটি সারি এবং তিনটি দরজা। তাছাড়া মসজিদের চূড়াতে ৫ টি গম্বুজ এবং প্রবেশপথের দরজায় দুইটি মিনার বিদ্যমান। মসজিদটি চুন ও সুরকি দিয়ে নির্মিত হওয়ায়, মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ বেশ ঠান্ডা থাকে। মসজিদের দেয়ালগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক আলপনা অলঙ্কৃত রয়েছে। ১৯৬৯ সালে এই মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি পুরাতাত্ত্বিক মসজিদ হিসেবে নিবন্ধিত হয়। মসজিদের নিকটেই রয়েছে সাধক সুফির সমাধি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই মসজিদে নামাজ পড়তে ও প্রার্থনা জানাতে আসেন।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা
কুষ্টিয়া সদরে লাহিনিপারা গ্রামে মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা অবস্থিত। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় উপন্যাসিক, নাট্যকার এবং প্রবন্ধের লেখক। মীর মশাররফ হোসেন ১৮৪৭ সালের ১৩ নভেম্বর লাহিনিপারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন জমিদার মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের পুত্র। তার শিক্ষার জন্য তার বাবা একজন মুন্সির ব্যবস্থা করেন, যার কাছ থেকে তিনি ফারসি ও আরবি ভাষা শিখেছিলেন।
স্থানীয় পড়াশুনা শেষ করে তিনি কলকাতার কালীঘাট স্কুলে অধ্যয়ন করতে যান এবং সেখানেই তাঁর শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। জীবনের শুরুর দশায় তিনি তার পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা উত্তরাধিকার করেন। এরপর তিনি একটি চাকরিতে যোগদান করেন এবং কিছু সময় পর তিনি ভাগ্যের সন্ধানে কলকাতায় পাড়ি জমান।
১৯ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলিম সাহিত্যের একজন অগ্রদূত ছিলেন মীর মশাররফ হোসেন। ক্রমান্বয়ে তিনি শুদ্ধ বাংলায় ধ্রুপদী গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক ও পদ্য লিখেছেন। তার বিখ্যাত একটি সাহিত্যকর্ম হচ্ছে জমিদার দর্পণ এবং এই নাটকের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হন। কবির জন্মস্থানকে ঘিরে রয়েছে একটি জাদুঘর, একটি অডিটোরিয়াম, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি গ্রন্থাগার। উল্লেখ্য যে এই ঐতিহাসিক কবির জন্মস্থান বা বাস্তুভিটা পরিদর্শনের জন্য প্রতিদিন অসংখ্য দেশী ও বিদেশী পর্যটক বেড়াতে আসেন।
ঠাকুর লজ বা টেগর লজ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবদ্দশায় ১৮৯৫ সালে ঠাকুর এন্ড কোম্পানি কুষ্টিয়া শহরে একটি লজ নির্মাণ করেন, যা আজ পর্যন্ত কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভবনটি কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়া নামক গ্রামে অবস্থিত। এটি একটি দ্বিতল ভবন যার নিচতলায় রয়েছে বড় একটি হল রুম ও উপরের তলায় রয়েছে তিনটি কক্ষ। দোতলায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বারোটি চিত্রকর্ম এবং একটি বইয়ের পান্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে।
নিচতলা থেকে দুতালায় ওঠার জন্য ভবনের পশ্চিম প্রান্তে একটি সুদৃশ্য লোহার প্যাচানো সিড়ি বিদ্যমান। ঠাকুর লজের অভ্যন্তরীণ ভাগে একটি ছোট খোলামঞ্চ এবং সবুজ ঘাসে ঢাকা সুদৃশ্য উঠান রয়েছে। এখানকার খোলা মঞ্চে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে ও বিশ্বকবির অন্যান্য সাহিত্য কর্মের উপর অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এখানে অবস্থানকালে কবিগুরু অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। এসব সাহিত্যকর্ম পরবর্তীতে ক্ষণিকা হিসেবে এবং “কথা ও গল্প” নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
লালন শাহ সেতু
কুষ্টিয়ার বিখ্যাত বাউল সাধক লালন শাহের নামানুসারে কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার সংযোগ সেতুটিকে লালন শাহ সেতু নাম দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের কাছে এটি পাকশী সেতু নামেও পরিচিত। ২০০১ সালের ১৩ জানুয়ারি এই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ২০০৮ সালের ১৮ মে এই সেতুটি জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য ও যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এই সেতুটি প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা এবং প্রায় ১৮ মিটার প্রশস্ততা বিশিষ্ট।
এই সেতুর মোট সতেরোটি স্প্যান রয়েছে, যাদের প্রত্যেকটির মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১১০ মিটার। এটি একটি দুই লেন বিশিষ্ট সেতু এবং লেন দুটিকে ডিভাইডার দিয়ে পৃথকীকরণ করা হয়েছে। এই সেতুটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং পরিবহন ব্যবস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখানকার সার্বিক প্রাকৃতিক আবহের জন্য সেতুটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এখানে রয়েছে পদ্মা নদীর উত্তাল ঢেউ, প্রবল বাতাস, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং শান্তিময় প্রকৃতি।
কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী শিশু পার্ক
কুষ্টিয়া শহরের জিরো পয়েন্টে এই সুদৃশ্য এবং মনোরম পার্কটি অবস্থিত। কুষ্টিয়া শহরের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী’র নামানুসারে এই পার্কের নামকরণ করা হয়েছে। তার নামানুসারে কুষ্টিয়াতে ঈদগাহও রয়েছে। শহরের মানুষজন সাধারণত বিকেলের পর বিনোদনের জন্য পরিবারসহ এখানে বেড়াতে আসেন। এই পার্কে প্রবেশের মূল্য মাত্র ৫০ টাকা। এখানে শিশু ও কিশোরদের আনন্দের জন্য কয়েকটি রাইড রয়েছে। পার্কটিকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য স্থাপন করা হয়েছে থ্রিডি মুভি থিয়েটার এবং কেবল কার। এখানকার প্রত্যেকটি রাইডের জন্য ৫০ টাকা মূল্যমানের টিকেট কাটতে হয়। এখানে একটি মিনি চিড়িয়াখানাও রয়েছে। এটি কুষ্টিয়ার একমাত্র বিনোদন পার্ক হবার কারণে ছুটির দিনে এখানে প্রচণ্ড ভিড় থাকে।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
আপনি চাইলে ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন এবং বিমানে কুষ্টিয়া যেতে পারবেন। তবে বিমানে যেতে হলে আপনাকে ঢাকা থেকে যশোর যেতে হবে এবং যশোর থেকে লোকাল ট্রান্সপোর্ট অথবা গাড়ি ভাড়া করে কুষ্টিয়া পৌঁছাতে হবে।
কুষ্টিয়াতে বেশ কয়েকটি ভালো মানের আন্তর্জাতিক হোটেল রয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হোটেল নূর ইন্টারন্যাশনাল, রত্নদ্বীপ রিসোর্ট, আজমেরী রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, রূপকথা ইকো রিসোর্ট, পাকশী রিসোর্ট, ইত্যাদি।
Leave a Reply