হবিগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

হবিগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের ছোট একটি জেলার নাম হবিগঞ্জ। মাত্র ৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই জেলা আয়তনের দিক থেকে ছোট হলেও এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে। তাছাড়াও এই শহরে রয়েছে অনেকগুলো চা বাগান। আপনি যদি হবিগঞ্জ বেড়াতে যান তাহলে আপনার জন্য পরামর্শ হচ্ছে অবশ্যই চা বাগানের সৌন্দর্য দেখে আসবেন এবং যদি সময় পান তাহলে টিপরা উপজাতির লোকজনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারেন। এই জেলায় যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে তার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা পোস্টটিতে শেয়ার করা হলো। আশা করি আপনার হবিগঞ্জ ভ্রমণকে পরিকল্পনামাফিক সাজাতে আপনার কিছুটা সুবিধা হবে।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটে অবস্থিত রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র বাংলাদেশের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক বনাঞ্চল। এই অভয়ারণ্যটি একই সাথে একটি সুরক্ষিত বন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করে। উদ্ভিদতত্ত্বের ভাষায় এটি একটি শুষ্ক বনাঞ্চল যা একই সাথে চিরহরিৎ বা এভারগ্রীন। চিরহরিৎ বলতে বুঝায় যে বনাঞ্চল সবসময় সবুজে ঢাকা থাকে। অন্য ক্ষেত্রে শুষ্ক বনাঞ্চল হচ্ছে যেখানে ভূগর্ভস্থ পানি তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায়।

সাধারণত এই ধরনের বনাঞ্চল কম গঠিত হয় কিন্তু যদি একবার এই বনাঞ্চল গঠিত হয়ে যায় এবং বৃক্ষ সমূহ যথাযথ শেকড় ছড়িয়ে ফেলে তখন এটি স্থায়ী বনাঞ্চল হিসেবে রূপ লাভ করে। কারণ ভূগর্ভস্থ পানি কম হলেও বৃক্ষের মূল যথেষ্ট মাটির গভীরে চলে যায় ফলে গাছগুলো ভূমির অনেক নিচ থেকেও পানি সংগ্রহ করতে সক্ষম। এইজন্য রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি পতিত ভূমিসমূহে এই ধরনের বনাঞ্চল স্থাপন করতে পারি, (যা বিদেশের মাটিতে সচরাচর বাস্তবিক রূপ লাভ করে) তাহলে দেশের জন্য অনেক সুফল বয়ে নিয়ে আসা সম্ভব।

১৯৮২ সালে এই বনাঞ্চলটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে কৃত্রিমভাবে এই বনাঞ্চলটিকে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বর্তমানে প্রায় হাজার ১৮০০ হেক্টর বা সাড়ে পাঁচ হাজার একর এলাকাজুড়ে এই অভয়ারণ্যটি বিস্তৃত। তবে প্রশাসনিক ক্ষমতার দুর্বলতার কারণে স্থানীয় লোকজন ব্যাপক হারে বৃক্ষ নিধন করছে এবং বন উজাড় করে দিচ্ছে। এর জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে পুরো বনাঞ্চলটি ক্ষতি বা বিলুপ্তির সম্মুখীন হবে।

এই বনাঞ্চলটি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তর- পূর্বে এর অবস্থান।পুরো বনাঞ্চলটি হবিগঞ্জ জেলার ৪ টি গ্রাম নিয়ে বিস্তৃত, যা হলো রেমা, চানবাড়ি, কালেঙ্গা এবং রশিদপুর।

বিভিন্ন ধরনের বিরল প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদের বাস্তুসংস্থান বা উপস্থিতি রয়েছে এখানে। ২০০৯ সালের জরিপ অনুযায়ী এই বনাঞ্চল ১৬৭ প্রজাতির পাখি, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং প্রায় ৬৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এই বনে। প্রচুর উদ্ভিদ থাকলেও এই বনাঞ্চলটি সবচাইতে বেশি মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হবার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির পাখির উপস্থিতি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে র‌্যাকেট তোতা, রেড হেডেড ট্রোগন, কালিজ ফিজ্যান্ট, রেড হুইস্কার্ড বুলবুলি, হিল ময়না, ঈগল, লেজযুক্ত ড্রঙ্গো, রেড জঙ্গল ফাউল, পেঁচা, হোয়াইট-রাম্পড ভলচার, কিংফিশার, ইত্যাদি।

তাছাড়াও এখানে রয়েছে তিন প্রজাতির বানর, যথা রাতের বানর, কুল্লু এবং লজ্জাবতী রেসাস বানর। খুঁজে পাওয়া কাঠবিড়ালির প্রজাতিগুলোর মধ্যে পাঁচটি প্রজাতি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে পুরো বনাঞ্চলের শুধুমাত্র মালয় অংশে এসব কাঠবিড়ালি দেখতে পাওয়া যায়। মুখ পোড়া বন্যপ্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে উল্লুক, মায়া হরিণ, হেজহগ, হনুমান, বন্যাসুকরা, হনুমান চশমা, মেছোবাঘা, ফিচ, ওয়েসেল, ইত্যাদি। এখানে আরো রয়েছে প্যারাডাইস ফ্লাইক্যাচার, কোবরা, দামরাসা এবং আরও অন্যান্য প্রজাতির সাপ।

লোকমুখে শোনা যায় যে, ষাটের দশকে এই বনে বাঘ এবং চিতাবাঘ বিচরণ করত। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোন বাঘের আনাগোনা খেয়াল করা যায়নি। যদিও স্থানীয় পত্রিকায় মাঝেমধ্যে খবর এসেছে যে, কিছু প্রাণী এবং মানুষ বাঘের আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু যথাযথ খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায় যে, বাঘগুলো মূলত ভারতের সীমানা পেরিয়ে মাঝেমধ্যে আক্রমণ করে থাকে। এই বনের টারশিয়ারি লেভেলের খাদকদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিয়াল এবং বন্য বিড়াল। ৯০ এর দশকের পূর্বে এখানে বন্য কুকুর বসবাস করত যা এখন বিলুপ্তপ্রায়।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানটি মূলত একটি পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র ও পিকনিক স্পট। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানাড় পাইকপাড়া ইউনিয়নে এই জাতীয় উদ্যানটি অবস্থিত। উদ্যানটি মূলত রঘুনন্দন পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই উদ্যানের নিকটবর্তী এলাকায় সব মিলিয়ে নয়টি চা বাগান রয়েছে। চা বাগানের কাজের দায়িত্ব প্রধানত টিপরা উপজাতির পরিবারবৃন্দের উপর।

প্রধানত ২৪ টি পরিবার এবং তাদের সহযোগীরা প্রত্যক্ষভাবে চা বাগানের কাজের সাথে জড়িত। এই এলাকাতে সাতটি প্রবহমান জলধারা উপস্থিত, যা থেকে এর নাম হয়েছে সাতছড়ি। এই স্থানের সমস্ত উদ্ভিদ এবং প্রাণী হাজার ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় সুরক্ষিত। সমগ্র উদ্যানের বিস্তৃতি হচ্ছে প্রায় আড়াইশ হেক্টর বা প্রায় ৭৫০ একর।

পুরো এলাকাজুড়ে দুইশরও বেশি প্রজাতির গাছ উপস্থিত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো শাল, গর্জন, সেগুন, চাপালিশ, আগর, মেহগনি, ডুমুর, কৃষ্ণচূড়া, আউয়াল, জারুল, জামরুল, আকাশমনি, ইউক্যালিপটাস, বাঁশ গাছ, বেত গাছ, ইত্যাদি। শুধুমাত্র উদ্ভিদ নয় বরং অনেক প্রজাতির বন্যপ্রাণীও রয়েছে এই প্রকৃতি ঘেরা বাস্তুসংস্থানের অভ্যন্তরে। যেমন রেড- হেডেড ট্রোগন, ওরিয়েন্টাল পাইড হর্নবিল, রেড জঙ্গলফাউল, জাপানিজ পিগমি উডপেকার, ইত্যাদি।

জানা যায় যে এখানে বিলুপ্তপ্রায় হুলক গিবনও রয়েছে। এসব ছাড়া অন্যান্য সাধারণ প্রাণী যারা অল্প সংখ্যায় রয়েছে তারা হল- পাতার বানর, ল্যাঙ্গুর এবং এশিয়ান কালো ভাল্লুক। বর্তমানে জাতীয় বনবিভাগের পাশাপাশি একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা বা এন.জি.ও. এই পার্কে তাদের কার্যক্রম বজায় রেখেছে। পার্কটির পর্যবেক্ষণ এর পাশাপাশি তারা ভ্রমণকারী পর্যটকদের ইকো ট্যুর প্রদান করে সাথে। তারা বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় মনোহারী পণ্যও বিক্রয় করে থাকে। এই এনজিওর নাম হল নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প।

শংকরপাশা শাহী মসজিদ

হবিগঞ্জের সদর উপজেলায় রাজিউড়া ইউনিয়নে শংকরপাশা নামক স্থানে এই বিখ্যাত মসজিদটি অবস্থিত। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টীয় ১৫ শতকে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। মসজিদে খোদাইকৃত ফলক এবং শিলালিপি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে সুলতান আলাউদ্দিন শাহ ১৫১৩ সালে তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা মজলিস আমিন দ্বারা এই মসজিদ নির্মাণের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। মসজিদের পাশেই রয়েছে সুলতান আলাউদ্দিন শাহ এর কবরস্থান। অনেক লম্বা সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার কারণে এলাকাটি বনভূমি দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। সম্প্রতি স্থানীয়দের সাহায্যে এই মসজিদটির পুনর্বার সন্ধান পাওয়া গেছে।

মসজিদ ভবনটি মূলত একতলা এবং আকারে বর্গাকার। মসজিদের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ উভয়ই ২১ ফিট ৬ ইঞ্চি। মসজিদ সংলগ্ন একটি বারান্দা রয়েছে যা তিন ফুটের সামান্য বেশি চওড়া। সম্পূর্ণ মসজিদের মোট গম্বুজ রয়েছে ৪ টি। মসজিদের মূল কাঠামোতে একটি বৃহদাকার গম্বুজ এবং এর বারান্দাতে ছোট ছোট তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের দরজার সংখ্যা তিনটি এবং জানালার সংখ্যা মোট ১২ টি।

মসজিদে ছোট ছোট ৬ টি মিনার রয়েছে; যার মধ্যে মসজিদের চার কোণায় চারটি এবং বারান্দাতে দুইটি। তাছাড়া মসজিদের পিছনে বড় একটি দীঘি রয়েছে। এই মসজিদটি গৌড় আমলের স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। মসজিদের অলংকরণ দেখে বুঝা যায় যে, এটি নির্মাণের সময় যথেষ্ট কারিগরি দক্ষতার সাথে তৈরি করা হয়েছে যা এখন পর্যন্ত তার জৌলুস বজায় রেখেছে।

হবিগঞ্জে থাকার জন্য সবচাইতে উত্তম আবাসিক হোটেল হল দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট। তাছাড়াও নিকটবর্তী হোটেল গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রীনলীফ গেস্ট হাউস, গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্ট, রেস্ট ইন হোটেল, ইত্যাদি। ঢাকা থেকে হবিগঞ্জ যাবার জন্য সাধারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা হচ্ছে বাস এবং ট্রেন। তাছাড়াও আপনি চাইলে বিমানে সিলেট যেতে পারেন এবং সেখান থেকে বাস বা কার ভাড়া করে হবিগঞ্জ পৌছাতে পারেন।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*