জামালপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

জামালপুর জেলার দর্শনীয় স্থান গুলো কি কি? প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

ঢাকা বিভাগের অন্যতম একটি জেলা হচ্ছে জামালপুর। রাজধানী শহর থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরত্বে (উত্তরে) এই জেলাটি অবস্থিত। মূলত জেলাটি ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে গঠিত। এই এলাকা অতীতকাল থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হল, ফকির-সন্ন্যাসী প্রতিরোধ, নীল বিদ্রোহ, ৭৪ এর মন্বন্তর এবং মুক্তিযুদ্ধ। এটি একটি অত্যন্ত ব্যস্ত শহর। কিন্তু শহরের বাইরে গেলে আপনি সবুজের সমারোহ দেখতে পাবেন। জামালপুরের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো আপনাদের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে এই পোস্ট।

লুইস ভিলেজ রিসোর্ট এন্ড পার্ক

জামালপুর সদরে বেলাতিয়া নামক স্থানে এই অতি মনোরম রিসোর্ট এবং পার্কটি নির্মিত হয়েছে। এটি শুধু জামালপুর নয় বরং বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগের সবচাইতে আধুনিক বিনোদন স্থান হিসেবে সারা দেশের মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এখানে সর্বমোট ১৪ টি রাইড রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাম্পার কার, ওয়ান্ডার হুইল, মেরি গো রাউন্ড, সুইং চেয়ার, কফি কাপ, মিনি ট্রেন, বোট রাইডিং, ইত্যাদি। এ পার্কটি সকল বয়সের মানুষের বিনোদনের জন্য উপযুক্ত।

এখানে আরো রয়েছে স্থানীয়দের তৈরি হস্ত শিল্পের পণ্য, যা আঞ্চলিক কুটির শিল্পের বৈচিত্রের প্রমাণ দেয়। শিশুদের জন্য বেশ কিছু আকর্ষণীয় খেলনাও রয়েছে এখানে। আপনার লম্বা ভ্রমণের ক্লান্তি মেটানোর জন্য একটি ফাস্ট ফুড কর্ণার খোলা হয়েছে। তাছাড়াও আপনি যদি পার্কে রাত্রি যাপন করতে চান, সেক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় রিসোর্ট সুবিধা রয়েছে এখানে। এ স্থানটি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্যও একটি উপযুক্ত স্থান। এখানে একটি কনভেনশন সেন্টার রয়েছে যাতে আপনি আপনার পছন্দমত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন।

প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত এই পার্কটি খোলা থাকে। পার্কে প্রবেশের টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা। সারাদিন কাজের চাপে থাকার পর কিছু বিনোদন বা মনোরঞ্জন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে আবার পূর্ণতায় ফিরিয়ে আনে, যাতে আমরা আবার সতেজ চিত্ত নিয়ে কাজে ফিরে যেতে পারি। এখনকার আধুনিক রিসোর্ট এবং পার্কগুলো আমাদের প্রকৃত বিনোদনের একটি সৌন্দর্যমণ্ডিত উপায়।

শহর এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন তাদের ক্লান্তি দূর করতে এই পার্কে বেড়াতে আসেন। অনেক লম্বা সময় ধরে জামালপুরে চিত্তবিনোদনের জন্য কোন উন্নত পার্ক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে লুইস ভিলেজ রিসোর্ট পার্ক এই শূন্যস্থান পূরণ করেছে। এমনকি এর আশে- পাশের দোকান থেকে ব্যবসা করে অনেক মানুষের ভাগ্য ফিরে এসেছে এবং তারা অর্থনৈতিকভাবে সচল হয়েছে।

গান্ধী আশ্রম

জামালপুরের মেলান্দহ থানার ঝাউগড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত কাপাস হাটিয়া নামক গ্রামে গান্ধী আশ্রম অবস্থিত, যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ ইংরেজ শাসনের অন্তর্গত ছিল, যারা ভারতীয়দের উপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার এবং উপনিবেশিক শাসন চালাত। ইংরেজদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের লোকজন স্বাধীনতাকামী হয়ে ওঠে এবং তাদের স্বাধীনতা দানে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। যিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ও তার হাত ধরেই সমগ্র ভারতবাসী স্বাধীনতা লাভ করে। সংগ্রামে পরাজয় বরণ করে ইংরেজরা তাদের শাসন গুটিয়ে, তাদের নিজের দেশে পশ্চাদপসরণ করে।

মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে, এলাকার কিংবদন্তি কৃষক নেতা নাসির উদ্দিন সরকার এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। তার বড় কন্যা রাজিয়া খাতুন এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। এই আশ্রমের বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম ছিল যার মূল উদ্দেশ্য ছিল এলাকার দরিদ্র জনগণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। তারা বিভিন্ন ধরনের কুটির শিল্প, হস্তশিল্প এবং ছোট ছোট পেশা ও সমাজ কল্যাণ কর্মকাণ্ডের কর্মসূচী হাতে নেন। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল খাদি কাপড় বোনা, হস্ত শিল্প, কারুশিল্প, বৃক্ষরোপণ, স্বাস্থ্য সেবা, পাঠাগার, স্বাবলম্বন এবং দেশের উন্নয়নে বিবিধ ভূমিকা রাখা।

দেশ সেবায় তরুণ সমাজকে প্রেরণা দেওয়া এবং স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা ছিল এই আশ্রমের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে পাকিস্তানি শাসকরা ১৯৪৮ সালে বারবার এই আশ্রম এর উপর আঘাত হানে এবং প্রায় সমস্ত ব্যবস্থাপনা ও স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। সমগ্র কার্যালয় এর অফিস গৃহটি শুধুমাত্র টিকে রয়েছে। নিকট অতীতে ২০০৭ সালের ২ অক্টোবর স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে জাতিসংঘের অহিংস দিবস উদযাপনের জন্য এই আশ্রমের শুভানুধ্যায়ী কার্যক্রম নতুন করে শুরু হয়। এই আশ্রম এর পাশে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম জাদুঘর।

দয়াময়ী মন্দির

জামালপুর জেলা শহরের জিরো পয়েন্টে এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরটি অবস্থিত। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর আমলে শ্রীকৃষ্ণ রায় চৌধুরী নামক স্থানীয় জমিদার এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে ৬৫ শতাংশ জমির উপর এই মন্দিরটির স্থাপনা করা হয়। এই মন্দিরে পৃথকভাবে কালী মন্দির, শিব মন্দির, নাটমন্দির, এবং মনসা মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। এই মন্দিরটি ৩০০ বছরেরও বেশী পুরাতন হওয়া সত্বেও, প্রতিদিন এই মন্দিরে পূজা অর্চনা করা হয়ে থাকে। এই মন্দিরের প্রধান বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার অষ্টম দিনে বা অষ্টমীতে। এই দিনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ জন এখানে পুজা দিতে আসেন এবং তাদের মানত পালন করতে আসেন। এই মন্দিরটি সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে।

লাউচাপড়া পিকনিক স্পট

জামালপুর জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় বকশীগঞ্জ থানার অন্তর্গত একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট হচ্ছে লাউচাপড়া পিকনিক স্পট। লাউচাপড়া পিকনিক স্পটটি বকশীগঞ্জ থানা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে। পুরো এলাকাটি প্রায় ১০ হাজার একর স্থান জুড়ে বিস্তৃত। সমগ্র এলাকাটি পাহাড় ঘেরা এবং সবুজের সমারোহ পূর্ণ। পিকনিক স্পটের পাশেই রয়েছে গারো পাহাড়। গারো পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এই বিনোদন কেন্দ্র যা রিসোর্ট হিসেবেও চমৎকার একটি স্থান।

যদিও এখানে যেতে হলে আপনাকে যোগাযোগ পথে কিছুটা কষ্ট করতে হতে পারে কিন্তু একবার এখানে পৌঁছে গেলে আপনি দারুণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন এবং অকৃত্রিম মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারবেন। পিকনিক স্পট এর ভিতরে রয়েছে কৃত্রিম একটি লেক। যদিও এখানে বন্যপ্রাণী নেই কিন্তু ১৫০ ফুট পাহাড়ি উচ্চতায় স্থাপিত ৮০ ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠলে প্রায় এক প্রকার সবুজের সমুদ্র দেখা যায়।

এখান থেকে চারদিকের পরিবেশ যেন ছবি মনে হয়। এখানে ওঠার সিঁড়ি ও বৈচিত্র্যময়। একটি জিগজাগ পাহাড় ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয় এই ওয়াচ টাওয়ারে। তবে ধানের মৌসুম আপনাকে একটু সতর্ক থাকতে পারে কারণ পাহাড়ি হাতি এখানে চলে আসতে পারে। তাছাড়াও হলুদ পাখি, কলিম পাখি, কাঠঠোকরাসহ, আরো বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এখানে দেখা যায়। এখানকার প্রবেশমূল্য মাত্র ২০ টাকা।

পীর শাহ জামালের মাজার

১৫৮৬ সালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে হযরত শাহ জামাল ধর্ম প্রচারের জন্য ইয়েমেন থেকে এখানে আসেন। তিনি ছিলেন একজন সুফি দরবেশ। তিনি বাদশাহ আকবরের মুঘল দরবারে ধার্মিক বক্তৃতা দিতেন এবং ধর্ম প্রচার করতেন। তার কর্মে খুশি হয়ে সম্রাট আকবর অত্র খানকা শরীফের যাবতীয় খরচ বহন করেন এবং সম্রাট তার স্বীকৃতি স্বরূপ জামালকে এখানকার কয়েকটি এলাকার কর দান করতেও ইচ্ছা প্রকাশ করেন ও সনদ পাঠান।

কিন্তু পীর শাহ জামাল এই বিশাল অঙ্কের টাকা গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পীর শাহ জামালের নাম অনুসারেই এই এলাকার নাম হয় জামালপুর। বর্তমান সময়ে স্থানটির যথাযথ সংস্কার করা হয়েছে। প্রতিবছর এখানে ধর্মীয় মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় এবং অসংখ্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষজন এখানে ধর্মযাত্রা করতে আসেন। তাছাড়াও এটি জামালপুরের অন্যতম বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র।

যাত্রা এবং অবস্থান

ঢাকা থেকে সরাসরি জামালপুর পর্যন্ত বাস এবং ট্রেন সার্ভিস বর্তমান। তবে ট্রেনের যাত্রা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক এবং ভাড়া কম। জামালপুরে থাকার জন্য বেশকিছু আধুনিক মানের হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। আধুনিক মানের কয়েকটি হোটেল যা আপনার থাকার জন্য উপযুক্ত হবে সে হোটেলগুলো হল হোটেল গ্র্যান্ড সাফির, হোটেল রাইয়ান, হোটেল রওশন, হোটেল আল সামাদ, ইত্যাদি।

About শাহরিয়ার হোসেন 4780 Articles
Shahriar1.com ওয়েবসাইটে আপনার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার সবকিছুই পাবেন।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*