মাসিক/পিরিয়ড কি?
বয়ঃসন্ধি কালে মেয়েদের শরীরে কিছু বিশেষ পরিবর্তন আসে,যার মধ্যে মাসিক বা ঋতুস্রাব অন্যতম।
বয়ঃপ্রাপ্ত নারীর সমগ্র যৌনজীবনে প্রায় নিয়মিত গড়ে ২৮ দিন পর পর জরায়ু থেকে রক্ত, মিউকাস, এন্ডোমেট্রিয়ামের ভগ্নাংশ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অনিষিক্ত ডিম্বাণুর চক্রীয় নিষ্কাশন হয় যা মাসিক বা পিরিয়ড নামে পরিচিত।
সাধারণত ১২-১৫ বছর বয়সে পিরিয়ড শুরু হয় এবং ৪৫-৫০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
পিরিয়ড কেন হয়?নিয়মিত পিরিয়ড একটি মেয়ের সুস্থ যৌন জীবনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।প্রতি মাসে জরায়ু এর প্লাসেন্টা বা অমরা ভ্রুণ ধারনের জন্য উপযুক্ত হয়। পুরুষ যৌনাঙ্গ হতে আগত শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে ভ্রূণ গঠন করে।
কিন্তু নিষেক(সেক্স) না ঘটলে শুক্রাণুর সাথে ডিম্বানুর মিলনের কোনো সুযোগ তৈরি হয় না সুতরাং ভ্রূণ ও তৈরি হয় না, তখন অনিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামসহ যোনিপথে রক্তাকারে বাহিরে বেরিয়ে আসে। এভাবেই মাসিক বা ঋতুস্রাব সম্পন্ন হয়। প্রতি মাসে একটি করে ডিম্বাণু বাহিরে নির্গত হয়।
পিরিয়ডের সময় কি কি করণীয় ?প্রতিটি মেয়েকেই পরিবার থেকে এই সময়ে সাপোর্ট দেওয়া খুবই জরুরি। বিশেষ করে প্রথম যখন একটি মেয়ে পিরিয়ডের সম্মুখীন হয় তখন সে মানসিক ভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পরে,,যদি পিরিয়ড বিষয়ে তাকে আগে থেকে অবগত না করানো হয়। তাই বয়ঃসন্ধি কালে পা দেওয়ার আগেই প্রতিটি পরিবারের উচিত মেয়েদের এ সম্পর্কে অবগত করানো।
এইসময় যৌনাঙ্গ বেশি ইনফেকশনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। কারণ অনেকেই অজ্ঞতাবশত পুরনো কাপড় ব্যবহার করে,যা আমাদের যৌনস্বাস্থের জন্য হানিকর। তাই পিরিয়ডের সময় আমাদের যা মেনে চলতে হবেঃ
**স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড বা স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে হবে। পুরাতন কাপড় ব্যবহার করলে তা অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
**প্যান্টি অপরিষ্কার থাকলে তা থেকেও ইনফেকশন হতে পারে। তাই এই সময়ে প্যান্টি পরিস্কার রাখতে হবে।স্যাভলন বা জীবাণু নাশক গরম পানিতে ছিটিয়ে ধৌত করলে ভালো হয়।
**পিরিয়ডের সময় সেক্স থেকে বিরত থাকতে হবে।
**যৌনাঙ্গ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
**বেশি বেশি পানি পান করতে হবে।
**পরিবারের সদস্যদের উচিত এই সময়ে মেয়েদের সাপোর্ট দেওয়া বা মানিয়ে নেওয়া কারণ হরমোনজনিত পরিবর্তনের কারণে এই সময়ে মেজাজ খিটখিটে থাকে এবং ম্যুড স্যুইং এর সম্ভাবনা থাকে।
পিরিয়ড হলে কি কি খাওয়া যাবেনা?
**পিরিওড বা ঋতুস্রাব একটি বয়ঃপ্রাপ্ত নারীর জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। এ সময় যৌনস্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন থাকে। পরিষ্কার পরিছন্নতা এবং একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই যেকোনো ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব ।
ঋতুস্রাবের সময় কিছু খাবার দাবার এড়িয়ে চলতে হয়। যেমনঃ দুধ চর্বি জাতীয় খাবার ,শসা, জাঙ্ক ফুড,কোল্ড ড্রিংক, খালি পেটে থাকা ,শরীরচর্চা ইত্যাদি।
১/ দুধ , চিজ বা দই
পিরিয়ডের সময় দই বা ডেইরী জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খেলে আমাদের শরীরে কিছু হরমোনের মাত্রা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যায়। যার কারণে শারীরিক কিছু ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসাবিদরা পিরিয়ড কালীন সময়ে তাই নারীদের দুধ বা বেইরী জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেন।
২/ শসা
শসায় কিছু উপাদান থাকে যা পিরিওড কালীন স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ।তাই এই সময় শসা এড়িয়ে চলা উচিত।
৩/ কোল্ড ড্রিংক
কোল্ড ড্রিংক বা ঠান্ডা পানীয় জাতীয় খাবার পিরিয়ড কালীন সময়ে পান করলে জরায়ুতে স্বল্প পরিমাণে রক্ত থেকে যায়।৫-১০ বছর পরে যা ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে। তাই স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে চিকিৎসকেরা এ সময় কোল্ড ড্রিংক পরিহার করতে উপদেশ দেন।
৪/ জাঙ্ক ফুড
পিরিওড কালীন সময়ে জাঙ্ক ফুড বা অতিরিক্ত চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করে চলতে হয় । নতুবা বুকের ব্যথা সহ গ্যাস্টিকের প্রবলেম হতে পারে। এমনিতেও স্বাভাবিক জীবন চলাকালীন সময়ে আমাদের প্রত্যেকেরই জাঙ্ক ফুড কম খাওয়া উচিত।
খালি পেটে থাকার কুফলপিরিয়ড কালীন সময়ে আমাদের নারীদেহে অধিক পরিমাণে পুষ্টির প্রয়োজন। সুষম খাবার এ সময় অতিরিক্ত পুষ্টির যোগান দেয় কিন্তু অজ্ঞতা ও অসচেতনতাবসত অনেকেই এ সময় খালি পেটে থাকে যা স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয় ।
পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে এসময় অবশ্যই নিয়মিত খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
শরীরচর্চা করা যাবেনামাত্রাতিরিক্ত শরীরচর্চা এ সময় স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পিরিয়ড কালীন সময় প্রত্যেকেরই উচিত পরিপূর্ণ বিশ্রাম নেওয়া। এসময় শরীরচর্চা না করাই ভালো তবে অল্পবিস্তর শরীরচর্চা করা যেতে পারে।
পিরিয়ড কালীন সময়ে কি কি খাবার খেতে হবে?এ সময় খাবার গ্রহণে একটু অসাবধানতা হলেই মারাত্মক পুষ্টি ঘাটতি হতে পারে। বাংলাদেশের পুষ্টিবিদরা এসময় কিছু আবার সাজেস্ট করেন যেগুলো পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করে শরীরে অতিরিক্ত পুষ্টির যোগান দেয় যেমনঃ
১। কাঁচা পেঁপে
কাঁচা পেঁপে নিয়মিত পিরিয়ড হতে সাহায্য করে এবং ব্লিডিং ফ্লো ক্লিয়ার রাখতে ভূমিকা পালন করে। তাই এ সময়ে বেশি বেশি কাঁচা পেঁপে খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।
২। কলা
কলাতে প্রচুর এনার্জী রয়েছে ।এটি খাওয়ার সাথে সাথেই এনার্জি উৎপন্ন হয়। পিরিয়ড কালীন সময়ে রক্ত ক্ষরণের জন্য শরীর অনেকটা দুর্বল থাকে তাই শরীরে এনার্জি আনতে এ সময় কলা অতি প্রয়োজনীয় খাবার।
৩। ডার্ক চকলেট
ডার্ক চকলেট বা এ জাতীয় খাবার আমাদের নার্ভ বা স্নায়ু সিস্টেমকে উন্নত করে। যেহেতু পিরিয়ড কালীন সময়ে ম্যুড স্যুইং করে। মেজাজ খিটখিটে হয় তাই মেজাজ শান্ত রাখতে এ সময় ডার্ক চকলেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪। লেবু
লেবুতে ভিটামিন সি রয়েছে। রজঃচক্র চলাকালীন সময়ে পানির সাথে মিশিয়ে অথবা তরকারির উপর ছিটিয়ে লেবু খাওয়া যেতে পারে।
৫। আনারস
মাসিক অনিয়মিত হলে যদি আনারস খাওয়া হয় তাহলে নিয়মিত মাসি আশা করা যায় ।তাই নিয়মিত পিরিয়ড পেতে হলে আনারস খেতে হবে।
৬। ধনেপাতা
ধনেপাতা ভর্তা অনিয়মিত পিরিয়ড নিয়মিত হওয়াতে সাহায্য করে।
৭। গ্রীন ট্রী
এটিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। পিরিয়ডের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। তাই পিরিয়ডকালীন সুস্থ জীবন পেতে হলে নিয়মিত গ্রীন টি পানের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৮। হলুদ গুঁড়া
পিরিয়ডের সময় হলুদ গুঁড়া খাওয়া ভালো। তবে খেতে অসুবিধা হলে এটি পাতলা দুধের সাথে খাওয়া যেতে পারে।
৯। চিটাগুড়
চিটাগুড়ের প্রচুর পরিমাণ লৌহ এবং জিংক থাকে। চিটাগুড় লাল চা এবং মুড়ির সাথে মিশিয়ে খেলে পিরিয়ড নিয়মিত হবে।
১০। আদা
পিরিওড এর সুফল পেতে হলে দুধ-চায়ের পরিবর্তে আদা চা খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। তাহলে নিয়মিত পিরিয়ড আশা করা যায়।
এছাড়াও শাকসবজি এবং প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে এ সময়। বিভিন্ন চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে তাহলে নিয়মিত মিন্স্ট্রুয়েশন সাইকেল আশা করা যায়।
কি করলে পিরিয়ডকালীন তলপেটে ব্যথা কমানো সম্ভব?
পিরিয়ড কালীন সময়ে অনেকেরই তল পেটে অসহ্য কর ব্যথা অনুভূত হয়। পিরিয়ডের ব্যথা কমানোর ওষুধ কোনগুলো? তলপেটে ব্যথা কমাতে পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগেই বা নির্ধারিত তারিখে কিছু পেইন কিলার খেতে হয় যেমনঃ
1.ibuprofen(Advil, Motrin IB) এবং
2.Naproxen sodium(Aleve)
তবে চিকিৎসকরা আজকাল পেইন কিলার না খেয়ে লাইফস্টাইল পরিবর্তনের উপর বেশি জোর দিচ্ছে। কিছু খাবার রয়েছে যেগুলো খেলে তলপেটে পিরিয়ড কালীন সময়ে পেইন হয় না।
আবার কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি রয়েছে যেগুলো ফলো করলে পেইন কিলার এর প্রয়োজন হয়না। সেগুলো হচ্ছেঃ
ল্যান্ড এভার অয়েলঃ
পিরিওড এর ব্যথা সময় তলপেটে কয়েক ফোঁটা ল্যান্ড এভার অয়েল দিয়ে 10 থেকে 15 মিনিট মাসাজ করুন তাহলে অনেকটাই পেট ব্যথা কমে যাবে।
গরম জলের সেকঃ
তলপেটে ব্যথা হলে গরম জলে সেক দিতে পারেন। এক্ষেত্রে হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি পিরিওড কালীন ব্যথা অনেকটাই উপশম করে ।এছাড়া গরম জলে স্নান করতে পারেন।
আদাঃ
পিরিয়ড ব্যথা কমাতে প্রতিদিন মধু ও গরম জলের সাথে আদার রস পানের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। দিনে ৩-৪ বার পান করলে ব্যথা থেকে অনেকটা উপশম পাওয়া যায় ।এছাড়া প্রতিদিন আদা চা পানের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
পেঁপেঃ
কাঁচা পেঁপে পেট ব্যথা কমায়। পিরিয়ডের সময় নিয়মিত কাঁচা পেঁপে খেতে পারেন। কাঁচা পেঁপে পিরিওড ব্যথা কমিয়ে দেয়।
অ্যালোভেরা রসঃ
পিরিয়ডের সময় মধুর সাথে অ্যালোভেরার রস মিশিয়ে শরবত করে খেয়ে ফেলতে পারেন । পিরিয়ডের ব্যথার সময় এটি দিনে কয়েকবার পান করুন । ব্যথা অনেকখানি কমিয়ে দেবে অ্যালোভেরার রস।
এভাবে খাদ্যাভাস পরিবর্তন করলে বা লাইফস্টাইল চেঞ্জ করলে পিরিয়ডকালীন তলপেটে যে অসহ্যকর ব্যথা অনুভূত হয় তা পেইনকিলার না খেলেও উপশম করা সম্ভব হবে।
পিরিয়ডের সময় কি তেঁতুল বা টক জাতীয় খাবার খাওয়া যাবে?
হ্যাঁ , অবশ্যই যাবে। অনেকেই মনে করেন টকজাতীয় খাবার খেলে পিরিয়ড কালীন সময়ে রক্ত ক্ষরণের মাত্রা বেড়ে যায়, এটি ভুল ধারণা।
স্বাভাবিক সময়ের মতোই মাসিক বা ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে টকজাতীয় ফল খাওয়া যাবে যা আমাদের প্রয়োজনীয় মিনারেলস এবং ভিটামিন জোগান দিবে। তবে হ্যাঁ, এসব ফলের সাথে লবণ মিশিয়ে খাওয়া যাবেনা।
লবনজাত খাবার পিরিয়ডকালীন সময়ে ব্যাথাসহ বিভিন্ন যন্ত্রনা বাড়িয়ে দেয়। তাই মাসিক চলাকালীন সময়ে টকজাতীয় ফল খাওয়া যেতেই পারে কিন্তু লবণ সহ খাওয়া যাবেনা। তাছাড়াও টকজাতীয় ফল যেমনঃ তেতুল,আমড়া,কামরাঙ্গা প্রভৃতির আচার বানিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে রাখা হয়।
আচার তৈরির সময় এতে প্রচুর পরিমাণে তেল এবং লবণ ব্যবহার করা হয়। সুতরাং পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে আচার জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। তবে এমনিতেই টকজাতীয় খাবার কাঁচা খাওয়া যাবে। এতে আমাদের শরীরের মিনারেল ঘাটতি পূরণ হবে।
Leave a Reply