শরীয়তপুর বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের একটি জেলা। ১৯৮৪ সালের পহেলা মার্চ এই স্থানটি জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শরীয়তপুরের নামকরণ হয় প্রখ্যাত নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহ’র নাম অনুসারে। তিনি ছিলেন ফরায়েজী আন্দোলনের আহবায়ক এবং পরিচালক। ব্রিটিশ শাসনামলে তিনি একজন ইসলাম ধর্ম সংস্কারক ছিলেন। শরীয়তপুরে ভ্রমণ বা পর্যটনের জন্য বেশকিছু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। এই পোস্টে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং তাদের সম্পর্কের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হলো। আশা করি এই পোস্টটি আপনার ভ্রমণকে স্বাচ্ছন্দময় করে তুলবে।
ধানুকা মনসা মন্দির
শরীয়তপুরের একটি প্রাচীন মন্দির ও বাংলাদেশের অন্যতম একটি সুরক্ষিত পুরাকীর্তি হল মনসা মন্দির বা ধানুকা মনসা মন্দির। শরীয়তপুর সদর থানার ধানুকা নামক স্থানে এটি অবস্থিত। সবগুলো মন্দির নিয়ে গঠিত বাড়িটিকে একত্রে ময়ূর ভট্টের বাড়িও বলা হয়। মুলত ময়ূর ভট্ট নামক এক ধনবান ব্যক্তি এই বাড়ি ও মন্দিরটির নির্মাতা। এ বাড়িতে আরও বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে।
প্রায় ১৫ শতকে ধানুকা অঞ্চলে তৎকালীন ধনাঢ্য ব্যক্তি ময়ূর ভট্ট শৈল্পিক সৌন্দর্যের নিদর্শন হিসেবে মনসা মন্দির তৈরি করেন। পরবর্তিতে তার বাড়িতে তৈরি মনসা মন্দিরটি তৎকালীন এ অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং ভারত থেকে লোকজন পাড়ি জমাত এখানে পূজা দেওয়ার জন্য। মনসা মন্দিরের জনপ্রিয়তার কারণে পুরো বাড়িটিই মনসা বাড়ি নামে খ্যাত। এই মন্দিরে রয়েছে পিতলের তৈরি একটি পুরাতন মূর্তি।
লোকমুখে শোনা যায় যে, অতীতেই মূর্তিটি একবার হারিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় জেলে সম্প্রদায়ের লোকজন এটি খুঁজে পান এবং ভক্তির সাথে এটি ফেরত নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই শৈল্পিক নিদর্শনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে ময়ূর ভোটের বংশধর শ্যামা প্রসাদ চক্রবর্তী এটির সংস্কার করেন এবং এখনও অবধি এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন। বিভিন্ন সময় বাড়ি থেকে এবং এর আশপাশ থেকে প্রাচীন ধর্মীয় পুথি উদ্ধার করা গেছে।
উক্ত স্থানটি নিয়ে অনেক জনশ্রুতি এবং লোককথা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, এলাকার এক ছোট কিশোর ময়ূরভট্টের বাড়িতে ফুল কুড়াতে বাগানে আসা-যাওয়া করত। কিছুদিন যাওয়ার পর সে পরপর দুদিন বাগানে সাপ দেখতে পায় এবং সেখান থেকে পালিয়ে আসে। কিন্তু তৃতীয় দিনে সে যখন সাপের দেখা পায় তখন সে পালানোর সাথে সাথে সাপটিও তার পিছু নেয়। কিশোরটি যখন বাড়িতে ফিরে আসে সে দেখতে পায় তার পিছনে সাপটি তাকে অনুসরণ করে চলে এসেছে। একটু পর সে দেখতে পায় সাপটি ছেলেটিকে ঘিরে নৃত্য শুরু করেছে।
কিশোরটি এই ঘটনা ময়ূরভট্টকে জানায় এবং ঘটনার আবহ ও গুরুত্ব বুঝতে না পেরে ময়ূরভট্ট বাড়িতে ফিরে যান। সেই রাতে ময়ূরভট্ট রাতে স্বপ্নে মনসা দেবীকে দেখতে পান এবং দেবী স্বপ্নে তাকে মনসা মন্দির বানানোর নির্দেশ দেন ও সেখানে নিয়মিত পূজা অর্চনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যও বলেন। ময়ূরভট্ট দেবীর আজ্ঞা পালন করেন এবং পূজা-অর্চনা নিয়মিত চালিয়ে যান। এমনকি বর্তমানেও শোনা যায় যে বাৎসরিক মনসা পূজার সময় এখানে সাপেরা উপস্থিত হয়।
মনসা বাড়ি ভ্রমণের জন্য আপনাকে শরীয়তপুরের ৭ নং ওয়ার্ডের ঐতিহ্যবাহী ধানুকা মনসা বাড়ি ঠিকানায় যেতে হবে। আপনি খুব সহজেই শহর থেকে রিকশা নিয়ে স্থানটি ঘুরে দেখতে পারেন। এত গুরুত্ববাহী একটি ভবন হওয়া সত্ত্বেও ৬০০ বছরের একটি পুরাতাত্ত্বিক মন্দির প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে। স্থানীয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের পিছনে এই স্থানটি; তারপরেও ময়ূরভট্টের উত্তরাধিকারে শ্যামা প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন যে, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকেরা এই বাড়ির আশপাশের জমিজমা অন্যায় ভাবে দখল করে নিচ্ছে। সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে এটি যেকোন সময় বেহাত হয়ে যেতে পারে এবং পুরো ঐতিহ্যটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
রুদ্রকর মঠ
শরীয়তপুর জেলার অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হল রুদ্রকর মঠ। পূর্বের ধারণা অনুযায়ী, নবাব আলীবর্দী খানের আমলে ১৩০৫ থেকে ১৩১৫ বাংলা সালের মধ্যবর্তী সময়ে শরীয়তপুরের তৎকালীন জমিদার বাবু গুরুচরণ চক্রবর্তী এই মঠটি গড়ে তোলেন। জমিদার গুরু চরণ চক্রবর্তী তাঁর বিদেহী মাতা রাসমণি দেবীর সমাধিকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে এই মসজিদটি উৎসর্গ করেন।
এই মঠের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে শ্মশান মন্দির। মূল মন্দিরের চারকোনে চারটি ছোট ছোট মন্দির বারান্দা দিয়ে সংযুক্ত। মূল মন্দিরটি প্রায় ২০ মিটার উঁচু এবং ছোট মন্দিরগুলো প্রায় ২ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট। মূল মন্দিরে, উপাসনা কক্ষে চারটি দেবীমুর্তির অলংকরণ উপস্থিত রয়েছে। এই প্রাচীন মন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি বড় পুকুর যার চারপাশে গাছ রয়েছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটি একটি পবিত্র প্রাকৃতিক অনুভূতি আপনার মধ্যে এনে দিতে সক্ষম।
ধারণা করা হয় যে উপাসনালয় এবং পুকুরটির একই সাথে কাজ শুরু করা হয়। প্রত্যেক বছর এখানে কীর্তন এবং সাড়ম্বর পূজার আয়োজন করা হয়। এটি অত্যন্ত পুরাতন একটি স্থাপত্য হওয়ার কারণে হাজার ১৮৯৮ সালে এই মন্দির টির সংস্কার করা হয়। মন্দিরের গঠনশৈলী দেখলে বলে দেওয়া সম্ভব যে গত ২০০ বছরেও এমন প্রাচীন নির্মাণশৈলীর পরিচয় নেই। স্থানীয় লোকজন একে বাবু বাড়ি মঠ নামেও চেনেন। যেহেতু গত এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এর কোনো সংস্কার করা হয়নি, ফলে পুরো স্থাপনাটি ভঙ্গুর অবস্থায় টিকে রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দিরের চারপাশ ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মন্দিরের ভিতরে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্লাস্টার ভেঙে পড়ছে, সাথে রয়েছে ছড়ানো-ছিটানো আবর্জনার স্তুপ। অল্প কয়েক বছর আগেও এই মন্দিরের দেয়ালে শিলালিপি উপস্থিত ছিল কিন্তু বর্তমানে তা বিলুপ্ত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই মন্দিরের বিভিন্ন জিনিস স্থানীয় লোকজন চুরি করে নিয়ে যায় এবং ক্রমান্বয়ে এর সৌন্দর্য লোপ পাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজনের মতানুসারে এই স্থানটি যথাযথ সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করলে এটিকে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। রুদ্রকর জমিদারবাড়ি কে ঘিরে বহুতল ভবন প্রতিষ্ঠিত ছিল। নিচের তিনতলা ছিল আবাসিক বসার ঘর, অন্য ঘরগুলো বিভিন্ন টি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হত। তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ছিল থিয়েটার, আদালত, গুদামঘর, রান্নাঘর, এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট উপসনালয়।
বুড়ির হাট জামে মসজিদ
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ থানায় এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত। এই মসজিদটির নির্মাণ হয় প্রায় ১০০ বছর আগে। শরীয়তপুরের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে বুড়ির হাট জামে মসজিদটি অন্যতম। এটি বাংলাদেশের অতি অল্প সংখ্যক কিছু ইসলামিক স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শনগুলোর একটি উদাহরণ। এই মসজিদের স্থাপনা এবং স্থাপত্য শিল্পের কারুকার্য শহরের বাকি সকল স্থাপত্য কলাকে হার মানায়। এই মসজিদে এত সুন্দর যে, এর শিল্প কলা বর্ণনাতীত।
স্থানীয়দের কাছ থেকে শোনা যায় যায় যে, পূর্ববর্তী শতকে এই মসজিদ নির্মাণের সময় কলকাতা থেকে দামি দামি পাথর আনা হয় এবং ইংল্যান্ড থেকে সিমেন্ট, কংক্রিট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমদানি করা হয়। এই মসজিদের চার কোণায় চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে এবং মসজিদের কেন্দ্রে একটি বড় গম্বুজ স্থান করে নিয়েছে। এই মসজিদটিতে আযানের জন্য দুটি উঁচু মিনার রয়েছে।
মসজিদের সামনে রয়েছে বড় একটি ফটক। ছোট উদ্যান পেরিয়ে মসজিদে গেলে মসজিদের শুভ্র ছটা চোখে পড়ার মতো। মূলত মসজিদটি সাদা রং দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, যা স্বর্গের শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়। মসজিদের দেয়ালে সাদা রঙের পাশাপাশি, মধ্যবর্তী স্থানসমূহ বিভিন্ন ধরনের নকশাখচিত। মসজিদের মিনার গুলোর অলংকরণ আরও জটিল এবং দেখতেও মনমোহক।
গমণ ও আবাসন
ঢাকা থেকে শরীয়তপুর মাত্র.২০৭ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। রাস্তার যানবাহনের ঘনত্বের উপর বিবেচনা করে, আপনার ঢাকা থেকে শরীয়তপুর যেতে চার থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে। ঢাকার উত্তরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী এবং গুলিস্তান থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ত সরাসরি বাস সার্ভিস পাওয়া যায়। সাধারণ বাসে আপনি মাত্র ১০০ টাকার মধ্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যেতে পারেন।
আর যদি আপনি ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া নেন তবে আপনাকে প্রায় হাজার টাকার উপরে গুনতে হতে পারে। শরীয়তপুরে থাকার জন্য ভালো হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে নুর হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল শের আলী হল, চন্দ্র রেস্ট হাউজ, ইত্যাদি। শরীয়তপুরে চাইনিজ এবং বাংলা খাবার এর ভালো দোকান থাকলেও চিকন্দি ফুড পার্ক এবং চিলেকোঠা ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট, স্থানীয়দের এবং ভ্রমণকারীদের কাছে অনেক জনপ্রিয়।
Leave a Reply