
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বিভাগের একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা হচ্ছে মানিকগঞ্জ। ১৮৪৫ সাল থেকে এটি ঢাকা বিভাগের একটি মহাকুমা হিসেবে পরিগণিত হতো। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় ১৯৮৪ সালে মানিকগঞ্জ বাংলাদেশের একটি জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই শহরে দেখার মত বেশ কয়েকটি পৌরাণিক ও পুরাতাত্ত্বিক পর্যটন স্থল রয়েছে। আপনার মানিকগঞ্জ ভ্রমণের সুবিধার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণ বিষয়ক তথ্য ও ঐতিহাসিক তথ্য, এই পোষ্টে তুলে ধরা হল।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
মানিকগঞ্জ থানার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সাটুরিয়ার, বালিয়াটি নামক গ্রামে এই পৌরাণিক জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। সম্পূর্ণ প্রাসাদটির আয়তন প্রায় ছয় একর এবং সমগ্র রাজবাড়িটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে দুই শতাধিক কক্ষ বিদ্যমান। প্রাসাদের পেছনের প্রাঙ্গণে একটি পরীখা বা দিঘী রয়েছে। এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান গোবিন্দ রাম সাহা, প্রথমবারের মতো অত্র এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এই জমিদার বাড়িটি তারই তৈরি। জমিদার হবার পর তিনি তার পারিবারিক ব্যবসার আরো অধিক পরিমাণে সম্প্রসারণ ঘটান, যা নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৮ শতাব্দীর শেষের দিকে জমিদার রাম সাহার উত্তরাধিকারী জমিদার হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী নারায়ণগঞ্জের কিছু অংশ বিক্রয় করে দেন, যা সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করার পর, তাদের সমস্ত পরিবার ভারতে পাড়ি জমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশ সরকারের দখলে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই জমিদার বাড়িটি পরিচালনা করে এবং এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেয়।
নাহার গার্ডেন পিকনিক স্পট
সাভার স্মৃতিসৌধ থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরবর্তী মানিকগঞ্জের কামতা থানায় প্রায় শতাধিক বিঘা জমির উপর নাহার গার্ডেন পিকনিক স্পট অবস্থিত। সমগ্র গার্ডেন সর্বমোট নয়টি ছোট-বড় পিকনিক স্পট রয়েছে। অর্থাৎ একই সাথে অনেক লোক এখানে বনভোজনে আসতে পারেন। এখানে ছোট একটি চিড়িয়াখানাও রয়েছে। আর এখানকার বৃক্ষ সমূহে রয়েছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আনাগোনা। এসব পাখির কলতান সব সময় এলাকাটিকে মুখরিত করে রাখে। এখানে প্রদর্শনের জন্য রয়েছে খরগোশ, বানর, হরিণ, ময়ূর, মাছ ও পাখি।
যারা এখানে পিকনিক করতে চায়, তাদের সুবিধার জন্য রন্ধন সামগ্রী, আসবাবপত্র ও খাবার-দাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। শিশুদের খেলার জন্য রয়েছে মাঠ এবং ফুলের বাগান। তাছাড়াও বিশেষ করে কিশোরদের ও শিশুদের বিনোদনের জন্য গার্ডেন এর অভ্যন্তরে শিশু পার্ক খোলা হয়েছে। বাগানের শেষ অংশে রয়েছে টাইটানিক জাহাজের একটি ছোট প্রতিকৃতি, যা ছবি তোলার জন্য এবং দর্শকদের আনন্দ দেওয়ার জন্য নির্মিত। পার্কটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এখানে একটি কৃত্রিম ঝর্ণা রয়েছে এবং ভ্রমণকারীরা চাইলে পার্কের অভ্যন্তরস্থ বাগানের নারিকেল গাছ থেকে পেড়ে আনা নারিকেল খেতে পারেন।
তাছাড়া পার্কে ছোট একটি মসজিদ রয়েছে। আগত অতিথিরা যদি রাত কাটাতে চায় বা বিশ্রাম নিতে চায়, সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক বিশ্রামাগারের। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা প্রদানের উদ্দেশ্যে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং নিরাপত্তাকর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখানকার পিকনিক স্পটগুলোর ভাড়া সাধারণত স্পটের আকারের উপর নির্ভর করে। সাধারণত পিকনিক স্পটগুলোর ভাড়া ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ এর মধ্যে। তাছাড়াও আপনি কর্মদিবসে স্পট ভাড়া নিলে কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে বিশেষ ছাড় পেতে পারেন।
মত্ত মঠ
প্রায় আড়াইশো বছর পূর্বে মানিকগঞ্জ জেলা সদরের পটল গ্রামে হেম সেন নামক এক জমিদার ছিলেন। কথ্যসূত্র অনুসারে, সে জমিদার ছিলেন ভীষণ অত্যাচারী এবং অহংকারী। তার সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, জমিদারের দাপটে এলাকার কেউ জুতা পায়ে দিতে পারত না বা মাথায় ছাতা দিয়ে হাঁটতে পারত না। কেউ তা করলে, তাকে শাস্তির সম্মুখীন হতে হত। তারপরেও হেম সেন তার পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে, পিতার শেষকৃত্য স্থলে একটি মঠ বা উপাসনালয় নির্মাণ করেন। এই মঠটি মত্ত মঠ নামে পরিচিত।
এটি নির্মাণের সময় সুদূর ইরাক থেকে কারিগর নিয়ে আসা হয়েছিল। মঠের পাশে রয়েছে একটি বিশাল দিঘী, যা নিটোল দিঘী নামে পরিচিত। এই মঠের উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। ১৯৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন ভ্রমণকারী হেলিকপ্টারে এই মঠ পরিদর্শন করতে আসেন এবং এর অলঙ্করণের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে, তারা স্বেচ্ছায় এই মঠের সংস্কার কাজ করতে চান। কিন্তু সেই সময়কার স্থানীয় কিছু গোড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাধা দেওয়ার কারণে, এর সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে চীনের কিছু পর্যটক এটি পর্যবেক্ষণের জন্য আসেন এবং এত সুন্দর নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করে।
শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির
বাংলাদেশের অন্যতম পুরাতন একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে এই শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। এই মন্দির কখন ও কিভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হয় যে, রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। এই মন্দিরের ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিকৃতি এবং মূর্তি। তাছাড়াও রয়েছে ভাস্কর্যশিল্পের উপস্থিতি এবং অষ্ট ধাতু দ্বারা তৈরি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী দুর্গার মূর্তি।
মন্দিরের কেন্দ্রীয় স্থানে রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মা কালির মূর্তি। দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কয়েক বছর পূর্বে মন্দিরের অনেক কিছু চুরি হয়ে যায়। মন্দিরটির নিজস্ব কোন আয় না থাকার কারণে মন্দিরের সংস্কার করা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। মন্দিরটি অনেক সুন্দর হবার পরেও, বর্তমানে সংস্করণের ও সংস্কারের অভাবে এর ছাদের গঠন প্রায় ধ্বংস হবার উপক্রম। তারপরেও এখানে নিয়মিত পূজা অর্চনা করা হয়।
বেতিলা জমিদার বাড়ি
মানিকগঞ্জ সদর থানার বেতিলা গ্রামে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। প্রাকৃতিক পরিবেশে অত্যন্ত নির্মল ও সবুজে ঘেরা গ্রাম হচ্ছে বেতিলা, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেতিলা খাল। পূর্বের জমিদারি আমলে এইখানে খালে খরস্রোত প্রবাহিত হত এবং এই জলপথে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছিল। এখানকার জমিদার ছিলেন সত্য বাবু, যিনি প্রকৃতপক্ষে একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার কর্মের সুবিধার্থে এবং ব্যবসার উন্নয়নার্থে, তিনি এখানে জমিদার বাড়িটি স্থাপন করেন। পাশাপাশি দুটি সুদৃশ্য স্থাপনা নিয়ে জমিদারবাড়িটি গঠিত।
তেওতা জমিদার বাড়ি
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সহধর্মিনী আশা লতা সেনগুপ্ত ওরফে প্রমীলা দেবীর বংশগত পৈতৃক বাড়ি, তেওতা জমিদার বাড়ির নিকটে অবস্থিত। সেজন্য কাজী নজরুল ইসলাম এবং তার স্ত্রীর বিভিন্ন স্মৃতিবিজড়িত পুরাকীর্তি হচ্ছে তেওতা জমিদার বাড়ি। মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার অত্যন্ত সুন্দর তেওতা গ্রামে জমিদার শ্যাম শংকর রায়, যমুনা নদীর কূল ঘেষে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
জনশ্রুতি অনুসারে, জমিদার একসময় দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু তামাকের ব্যবসা তাকে প্রচুর অর্থ ও বিত্ত এনে দেয়; যা তাকে জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। জমিদারি পাবার পর প্রায় ৭ একর জমি নিয়ে এই জমিদার বাড়িটি গঠন করেন তিনি। মূল প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন প্রকৃতির নির্মাণ ও স্থাপনা। প্রাসাদ প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি বড় পুকুর বা দিঘী। এখানে ৭৫ ফুট উঁচু নাটমন্দির রয়েছে এবং প্রাসাদের ভেতরে ৫৫ টি কক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। মূল ভবনটিকে লালদীঘি ভবন বলে ডাকা হয়।
মাচাইন মসজিদ
মানিকগঞ্জের অধিকাংশ পুরাকীর্তি সুলতানি শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। মানিকগঞ্জে অবস্থিত একটি সুলতানি আমলের প্রসিদ্ধ স্থাপনা হচ্ছে মাচাইন মসজিদ। কথিত আছে যে, একজন দরবেশ বাঁশের মাচায় বসে সাধনা করতেন, যার নাম ছিল শাহ রুস্তম এবং তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা, তাকে ইসলাম ধর্ম প্রচারে সাহায্য করেছিল এবং আশেপাশের মানুষজন ভক্তি সহকারে তাকে দেখতে আসতেন। তৎকালীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, নিকটবর্তী নদীপথে গমনের সময় এই বিখ্যাত সাধককে দেখতে এসেছিলেন। পরবর্তীতে ১৫ শতাব্দীতে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার ভক্তি প্রদর্শনপূর্বক এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।
কিভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
ঢাকা থেকে বাসে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে মানিকগঞ্জ পৌঁছে যাওয়া যায়। তাছাড়াও আপনি চাইলে ক্যাব অথবা গাড়ি ভাড়া করতে পারেন। মানিকগঞ্জের অভ্যন্তরে আপনি রিক্সা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশাতে ভ্রমণ করতে পারেন।
মানিকগঞ্জে কয়েকটি ভালো মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বৈকালী রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, সিটি ড্রিম হোটেল এন্ড কনভেনশন সেন্টার, সেন্ট্রাল পার্ক রেসিডেন্সিয়াল হোটেল, রাজ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, ইত্যাদি।
Leave a Reply